বেশ কয়েকদিন হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, স্থানীয় পত্রিকা, জাতীয় পত্রিকা ও বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে একটা বিষয় নিয়ে জোরেশোরে হইচই শুরু হয়েছে। বিষয়টি এতদূর গড়িয়েছে যে, সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই মন্ত্রীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে।

হাওর-বাওড়ের দেশ সুনামগঞ্জ। আউল-বাউলের দেশ সুনামগঞ্জ। পির-ফকির-দরবেশের দেশ সুনামগঞ্জ। ধান আর মাছের দেশ সুনামগঞ্জ। এই সুনামগঞ্জের রয়েছে বিস্তৃত ইতিহাস। হাছন রাজা, দুর্বিনশাহ, রাধারমণ, শাহ আবদুল করিমের মতো জগতখ্যাত মানুষেরা এই সুনামগঞ্জেই জন্মেছিলেন। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই অঞ্চল বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর নিকট ছিল আকর্ষণীয়।


সিলেট বিভাগের মধ্যে ছাতক শিল্পনগরী হিসেবে পরিচিত। ছাতকে রয়েছে বিখ্যাত চুনাপাথর, সবচেয়ে ভালোমানের বালু, পাথর, সিমেন্ট। কাগজের কলও ছিল কিন্তু সেটা একসময় বন্ধ হয়ে যায়। সিলেট পাল্প এন্ড পেপার মিল ছিল দেশের মধ্যে সবচেয়ে উন্নতমানের কাগজের কল। বর্তমানে সেটি নিটল টাটা আবার চালু করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ছাড়াও লাফার্জ সিমেন্ট কোম্পানি রয়েছে এই ছাতকেই। ছাতকে রোপলাইন চালু ছিল, যা কাঁচামাল পরিবহনে ব্যবহৃত হতো।

অর্থাৎ, নানাবিধ কারণে ছাতক হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ একটা উপজেলা শহর। গুরুত্ব বুঝেই সিলেট থেকে সরাসরি ছাতক পর্যন্ত রেললাইন চালু হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। বিশেষ করে, বিভিন্ন মালামাল আদান-প্রদানের কাজে ব্যবহৃত হতো এই লাইনটি। মানুষেরা যে ব্যবহার করতো না, তা নয়। বিশেষ করে, নিম্নবর্গের মানুষেরা এই রুটটি ব্যবহার করতো বেশি।

বিভিন্ন সময়ে, ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ রেললাইনের দাবি উত্থাপিত হয়েছে এবং এমপি -মন্ত্রীরা কথাও দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষকে। সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিভিন্ন জনসভায় নিজ থেকেই ছাতক -দোহালিয়া-সুনামগঞ্জ রেললাইন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এমনকী, তিনি মন্ত্রী হবার পর সিলেট স্পাইসি রেস্টুরেন্টে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ছাতক-দোয়ারাবাজার-সুনামগঞ্জ-মোহনগঞ্জ রেললাইন চালু হবে।

ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জের পাঁচজন এমপি রেলমন্ত্রী বরাবর চিঠি পাঠিয়েছেন রেললাইনটি ছাতক-দোয়ারাবাজার -সুনামগঞ্জ পর্যন্ত স্থাপনের জন্য। ওই সংসদ সদস্যরাই মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করে, রেলমন্ত্রী বরাবর একটি ডিও লেটার পাঠানোর ব্যবস্থাও করেছেন। এসবই তাঁরা করছেন রেলের প্রকৃত সুবিধা যাতে সাধারণ জনগণ ভোগ করতে পারেন। কারণ, ওই রুটে বেশি মানুষের বসতি।

সর্বশেষ, তিনটি এলাইনমেন্টে জরিপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সরকার এবং জনগণের সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে জরিপ অনুযায়ী দেখা গেছে, সবচেয়ে সুবিধা হবে ছাতক-শিবপুর-হরিপদনগর- পাঠানবাড়ি-হাসননগর-সুনামগঞ্জ রুটে রেললাইন চালু করলে। এই পথে দূরত্ব মাত্র ২৭ কিলোমিটার, অন্য দুটি রুটে দূরত্ব একটু বেশি। সেই জরিপে গোবিন্দগঞ্জ -শান্তিগঞ্জ-সুনামগঞ্জ নামে কোনও রুট ছিলনা। এই জরিপটি ২০১৫ সালের ৩১ আগস্টের স্বাক্ষরিত। বাংলাদেশ রেলওয়ে, ঢাকার বিভাগীয় প্রকৌশলী আরমান হোসেন স্বাক্ষরিত এই চিঠিটির প্রাপক ছিলেন রেলওয়ে পূর্ব এর প্রধান প্রকৌশলী।

আমরা জানি, সরকার বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততা, উপকারভোগীর সংখ্যা, সরকারের সীমিত ব্যয়ের উপায় খোঁজা, প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতিসাধন না করা ইত্যাদি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়। আর, বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা এসব বিষয়ে আরও বেশি যত্নশীল। তিনি পরিবেশের ক্ষতি হোক এসব সিদ্ধান্ত তিনি গ্রহণ করতে চান না।
রেললাইন নিয়ে আলোচনায় আসার কারণ হয়ে গেল মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রীর মন্তব্য।

গোবিন্দগঞ্জ থেকে শান্তিগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জে রেললাইন স্থাপনের দাবি কোনও যুক্তিতেই ঠেকে না। কারণ এই রুটে দূরত্ব হবে ৫০ কিলোমিটার। শুধু তা-ই নয়, এই রুটে মানুষের বসতিও কম। গোবিন্দগঞ্জে রেল থামার পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় গোবিন্দগঞ্জ পয়েন্ট থেকে বেশ দূরে আফজালাবাদ নামক জায়গায় রেলের স্টপেজ দেয়া হয়েছিল। সেটা এমন দূরে যে, ওই জায়গা থেকে না আসা যায় পায়ে হেটে, না ব্যবহার করা যায় কোনও গাড়ি! এই কারণে গোবিন্দগঞ্জ এলাকার কেউই খুব বড় বিপদে না পড়লে রেল ব্যবহার করেন না। অর্থাৎ, এখনই এই জায়গাটি জনবিচ্ছিন্ন। একটা উপজেলা সদর থেকে নিশ্চয়ই একটা পয়েন্ট গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না।

ছাতক উপজেলা সদর হয়ে রেলটি যখন সুনামগঞ্জ জেলা শহরে যাবে তখন এই রেললাইনের গুরুত্ব নিশ্চয়ই বেশি থাকবে। উপজেলা পর্যায়ের সরকারি -বেসরকারি অফিস-আদালতের লোকজন এই ট্রেন ব্যবহার করতে পারবেন, সাধারণ জনগণ এই ট্রেন ব্যবহার করতে পারবেন, বিভিন্ন কাঁচামাল আদান-প্রদানে এই ট্রেন ব্যবহার করা যাবে। অপরপক্ষে, ট্রেনটি যদি সিলেট থেকে গোবিন্দগঞ্জ-শান্তিগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জ যায় তাহলে বিশাল জনগোষ্ঠী এই ট্রেনের সুফল ভোগ করতে পারবে না।

এবার আসুন, সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাবে। গোবিন্দগঞ্জ থেকে শান্তিগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জ রেললাইন চালু হলে ৫০ কিলোমিটারের জন্যে সরকারকে ছাতক-দোহালিয়া-আমবাড়ি-সুনামগঞ্জের চেয়ে নিশ্চয়ই দ্বিগুন ব্যয় গুনতে হবে। তা-ও হবে, জনসম্পৃক্ততা ছাড়া একটা রেললাইন। পরিবেশের কথা যদি বলি, তাহলে বলব, হাওরের ইকোসিস্টেম নষ্ট হবে। মাছের নিরাপদ অভয়াশ্রম নষ্ট হবে।

আমরা জানি, মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রী উন্নয়নে বিশ্বাসী একজন মন্ত্রী, কাজপাগল একজন মহান মানুষ। তিনি ইতোমধ্যে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। এসব উন্নয়ন আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি শুধু জগন্নাথপুর -দক্ষিণ সুনামগঞ্জের মন্ত্রী নন, তিনি শুধু সুনামগঞ্জের মন্ত্রী নন, তিনি বাংলাদেশের মন্ত্রী। বাংলাদেশের জনগণের সুবিধা -অসুবিধা নিশ্চয়ই ভাবেন এবং ভাববেন।

সাধারণ জনগণের কথা চিন্তা করে, মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রী ছাতক-দোয়ারাবাজার-সুনামগঞ্জ রুটে রেললাইন স্থাপনের মত দেবেন-এটা আমাদের বিশ্বাস।

লেখক: শিক্ষক ও সাহিত্যিক