খোয়াই। একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আঠারমুড়া পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বাল্লা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মেঘনায় মিশেছে। নদীটির গড় প্রস্থ ১০৬ মিটার। বাংলাদেশ অংশে রয়েছে নদীটির ৯৪ কিলোমিটার। এটি কেবল হবিগঞ্জের প্রধান নদী নয়; ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের তৃতীয় বৃহত্তম নদী। সর্পিলাকার এ নদীটি ভারতের ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার বিশাল জনপদের সুখ-দুঃখের সাথি, যা দু'দেশের বিশাল জনপদের কৃষি ও মৎস্যসম্পদের আধার। এক সময় এতদঞ্চলের পণ্য পরিবহন থেকে লোক চলাচলে নৌপথ হিসেবে খোয়াই নদী কাজ করত। বর্তমানেও গরুরবাজার এলাকা থেকে ভাটি অঞ্চলে নৌকা ছেড়ে যায় যাত্রী নিয়ে।

খোয়াই নদী বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃক চতুর্থ শ্রেণির নৌপথ হিসেবে স্বীকৃত। ত্রিপুরার খোয়াই শহরের নাম থেকেই নাকি এ নদীর নামকরণ। এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হতে পারে। তবে খোয়াই নামের নদীর উৎপত্তি নিয়ে কয়েক ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়, যা লোককাহিনির পর্যায়ে পড়ে। ২০১৪ সালে কুলাউড়ার মুরাইছড়া খাসিয়াপুঞ্জিতে আমার পিএইচডি গবেষণার ফিল্ডওয়ার্কের সময় খোয়াই নদীর নামকরণ নিয়ে খাসিয়া এক প্রবীণ ব্যক্তির মুখে একটি লোককাহিনি শুনেছি। উইকিপিডিয়াতেও তার এন্ট্রি রয়েছে। লোককাহিনির সারবস্তু হলো- খোয়াই একটি খাসিয়া শব্দ, যা এসেছে ক্ষমা বা ক্ষেমা থেকে। জনশ্রুতি রয়েছে, এ নদীতে পানসি নৌকায় এক ভিনদেশি বণিক যাত্রাকালে নোঙর করেন। সে সময় এ নদীতীরে বসবাসরত খাসিয়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমা বা ক্ষেমা নামের এক অভিজাত যুবতীর সঙ্গে ওই ভিনদেশি যুবকের প্রণয় হয়। কিন্তু ক্ষেমার পরিবার ও সম্প্রদায়ের কেউ তা মেনে নেয়নি; বরং তাকে খাসিয়া এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। ভিনদেশি যুবকের রূপে মুগ্ধ ক্ষমা বা ক্ষেমা নামক যুবতী রাগ, দুঃখ, ক্ষোভে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেন। ওই যুবতীর নামানুসারে নদীটির নামকরণ হয় ক্ষমা বা ক্ষেমা। এই ক্ষমা বা ক্ষেমা নদীই কালের বিবর্তনে খোয়াই নাম ধারণ করে। আবার খোয়াই রিভারকিপার তোফাজ্জল সোহেলের কাছে খোয়াই নদীর নামকরণে আরেকটি ব্যাখ্যা শুনেছিলাম। তা হলো- খোয়াই ত্রিপুরা ভাষার একটি শব্দ, যা 'খো' এবং 'য়াই'-এর সমন্বয়ে গঠিত। 'খো' অর্থ 'উপর' আর 'য়াই' অর্থ ধারা'। সে অনুযায়ী খোয়াই মানে হলো 'উপর থেকে নেমে আসা জলের ধারা।' পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে এসেছে বলেই নদীটির নামকরণ করা হয় খোয়াই।


খোয়াই নদী নিয়ে হবিগঞ্জ ও ভারতের ত্রিপুরায় অনেক রূপকথা রয়েছে। ত্রিপুরার এলাকায় খোয়াই নদীর কূল ঘেঁষে যেমন রয়েছে অনেক মন্দির, আশ্রম ও চার্চ; তেমনি বাংলাদেশ অংশে রয়েছে অনেক পীর-দরবেশের আস্তানা। এতদঞ্চলে খোয়াইয়ের নামে নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। হবিগঞ্জ শহরকে বলা হয় খোয়াই নগরী। আর ত্রিপুরার অন্যতম শহর হলো খোয়াই। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে এই আন্তঃসীমান্ত নদীটি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ১৯৯০-এর দশকে ত্রিপুরার চাকমাঘাটে ব্যারাজ নির্মাণ শুধু খোয়াই নয়; এতদঞ্চলের জলাশয় ব্যবস্থাকে সঙ্গিন করে তুলেছে। শীতকালে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশ অংশে পলি জমে ভরাট হয়ে নাব্য সংকট দেখা দেয়, যা মৎস্য ও কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আবার বর্ষাকালে ব্যারাজ খুলে দেওয়ায় অতিরিক্ত পানির চাপ নিতে না পেরে বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়। ফলে কৃষকরা হাওর ও বিধৌত এলাকার ফসল তুলতে না পেরে সারাবছর মানবেতর জীবন কাটান। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল ও এতদঞ্চলের প্রবল বৃষ্টিপাতে খোয়াই নদীতে বান এলে হবিগঞ্জ জেলা শহরসহ বিস্তীর্ণ জনপদের দুশ্চিন্তা ও দুর্ভোগের সীমা থাকে না। এভাবেই বিপুল সম্ভাবনার নদীটিকে অপবাদ দিয়ে বলা হয়ে থাকে 'হবিগঞ্জের দুঃখ'।

হবিগঞ্জ অংশে অপরিকল্পিত মাটি ও বালি উত্তোলনও খোয়াই-এর চিরায়ত ধারা পরিবর্তনের জন্য দায়ী। নদীগর্ভ থেকে মাটি ও বালি উত্তোলন নদীখননে সহায়ক হলেও নদীতীর ও বাঁধ-সংলগ্ন ভূমি থেকে তা উত্তোলন অনুচিত। নিষিদ্ধ শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে পাইপের সঙ্গে বালু ও মাটি স্থানান্তর, ট্রাক্টর দিয়ে তা বহনের জন্য নদীর পাড় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি শহর ও ফসল রক্ষা বাঁধ আজ হুমকির সম্মুখীন। আর প্রতি বছর সেই বাঁধ মেরামতে প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। অপরিকল্পিত মাটি ও বালু উত্তোলন সর্পিলাকার নদীটির গতিপথ পরিবর্তনের জন্যও নেতিবাচক। এ ছাড়া নদীটির বিভিন্ন স্থানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে দূষিত করা হচ্ছে।


একটি বাস্তব কিন্তু চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে লেখাটির ইতি টানব। তা হলো হবিগঞ্জ জেলা শহর থেকে খোয়াই নদীর উচ্চতা কয়েক মিটার বেশি। ইউরোপের নেদারল্যান্ডসের বেশিরভাগ ভূমিই যেমন সমুদ্র সমতলের নিচে অবস্থিত, ঠিক তেমনি হবিগঞ্জ শহরও খোয়াই নদী থেকে কয়েক মিটার নিচে অবস্থিত। সুউচ্চ বাঁধের মাধ্যমে পুরো শহরটিকে খোয়াইয়ের প্লাবন থেকে রক্ষা করা হয়েছে। শহরের কোল ঘেঁষে যে খোয়াই নদী তা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট নয়; বরং হবিগঞ্জ শহরকে বন্যার প্রকোপ থেকে রক্ষার জন্য ১৯৭৬-৭৭ সালে মাছুলিয়া থেকে রামপুর এবং ১৯৭৭-৭৮ সালে রামপুর থেকে গরুরবাজার পর্যন্ত স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে লোপ কাটিংয়ের মাধ্যমে নদীর গতিপথকে পরিবর্তন করা হয়। একবার যদি শহরের দিকে খোয়াই বাঁধ ভেঙে যায়, পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা পানি উন্নয়ন বোর্ডও সমীক্ষা করেছে বলে জানা নেই।

হবিগঞ্জের সুখ-দুঃখ মিশে আছে খোয়াইয়ের স্বাভাবিক বয়ে চলার সঙ্গে। একটি যুগোপযোগী প্রকল্প গ্রহণ করে নয়নাভিরাম নদীটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এতদঞ্চলের নদী, হাওর, জলাশয়, কৃষি ও জীবন-জীবিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনলে বাল্লা স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ভূমিকা রাখতে পারে; অভ্যন্তরীণ নৌ রুট হিসেবেও কাজ করতে পারে।

অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]