দুর্যোগ দুর্বিপাকে ভরা বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের আগে থেকেই বারবার এই ভূখণ্ডে প্রকৃতি নানারূপে, নানা ধরনে আঘাত হেনেছে।

বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের আঘাতটা বেশ ভয়ঙ্কর। যেমন ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দেড় লাখ মানুষ মারা যায়। এভাবে বারবার ঘূর্ণিঝড় আসে উপকূলে প্রকৃতির নিয়মে।


ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাস, তা দুর্বল বা শক্তিশালী যাই হোক না কেন, প্রথমেই আঘাত করে বেড়িবাঁধকে। বেড়িবাঁধ নতুন অবস্থায় মজবুত ছিল, তাই জোয়ারের ধাক্কা সামলাতে পেরেছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাঁধ ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে, পানির ধাক্কায় অনেক জায়গা ভেঙে যায় বা ক্ষয়ে যায়। লোনা পানি গ্রাম, লোকালয়, জনপদ প্লাবিত করে, ফসলের ক্ষতি করে।

জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষার জন্য তৈরি করা হয় বেড়িবাঁধ। বাংলাদেশের উপকূলে বেড়িবাঁধ তৈরির কাজ শুরু হয় ষাটের দশকে। ষাট বছর আগের এ বাঁধের অবস্থা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখন জরাজীর্ণ, বিশেষ করে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে। ভাঙাচোরা বাঁধ যে প্রবল জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে অক্ষম তা বারবার প্রমাণিত।

বাংলাদেশের বেড়িবাঁধগুলো ষাট-সত্তরের দশকে নির্মিত। সেসময়ে বড় দুইটি ঘূর্ণিঝড়ের পর জনজীবনের নিরাপত্তা ও কৃষি সুরক্ষার জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে নির্মিত হয়েছিল এসব বেড়িবাঁধ। দৈর্ঘ্যে এই বাঁধ ৫ হাজার ৭৫৭ কিলোমিটার। যার বড় অংশ আজ দুর্বল ও ভঙ্গুর প্রায়। কার্যত এই দীর্ঘসময়ে ওই সব বেড়িবাঁধের কোনো উন্নয়ন হয়নি, তবে কখনো কখনো প্রচুর অর্থ অপচয় হয়েছে। অন্যদিকে নদীতে জমেছে প্রচুর পলি। বাঁধ ক্ষয়ে গেছে, বেড়েছে পানির উচ্চতাও। এর মধ্যে আগের তুলনায় অল্প সময়ের ব্যবধানে আঘাত হানছে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়। ফলে ওই পুরোনো বাঁধ দিয়ে এখন অতিরিক্ত ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আটকানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, বিগত ত্রিশ বছরে বাংলাদেশে ২৩৪টি ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এতে অন্তত দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এ সময়ে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতি বছর পাঁচ শতাংশ লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা ক্রমাগত দেশের মধ্যাঞ্চলের দিকে প্রবেশ করছে। ইতিমধ্যে দেশের প্রায় ২৪০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে লবণাক্ততা। অন্যদিকে প্রত্যক্ষ হিসেবেও প্রাকৃতিক দুর্যোগে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বর্ণনাতীত। শুধু সিডরেই ক্ষতি হয়েছে জিডিপি’র অন্তত ৩% যা আজও পূরণ করা সম্ভব হয়নি।

সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র এক সমীক্ষায় বলছে, ২০৭০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্য আরেকটি গবেষণা বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে আমাদের ১৭ শতাংশ ভূমি হারিয়ে যাবে এবং এই সময়ে আমরা ৩০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদন সক্ষমতা হারাবো। ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে এবং শুধু এই একটি কারণে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়বে প্রায় ২ শতাংশ। আরও দুঃখজনক খবর হলো, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ৪৭ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে।

টেলিভিশনের নিউজ বুলেটিনে এবং সংবাদপত্রের পাতায় আমরা দেখেছি জোয়ারের পানি যখন বাড়তে শুরু করে; তখন সেখানকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শতশত মানুষ লড়াই করছেন বাঁধ বাঁচানোর জন্য। আমরা দেখেছি মানুষ জীবন-জীবিকা-বাসস্থান বাঁচানোর জন্য মাথায় করে মাটির বস্তা, বালির বস্তা নিয়ে বাঁধের ওপর ফেলছেন বাঁধ রক্ষা করতে। কোদাল দিয়ে মাটি কেটে আনছেন বাঁধের জন্য। বাঁশের খুঁটি, গাছের ডাল বসিয়ে দিচ্ছেন বাঁধের পাশে, যাতে বাঁধ ভেসে না যায়। এ হলো বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।

উপকূল এলাকার মানুষ যখন বাঁধ রক্ষার জন্য প্রাণপণ লড়াই করছিলেন, সে সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তথা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), জেলা বা উপজেলা প্রশাসনের কেউ সেখানে এসেছিলেন কিনা জানি না। সংবাদপত্র বা টিভির রিপোর্টে তার উল্লেখ নেই।

ইয়াসের কিছু ছবি আমাদের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। অসংখ্য স্থানে বুক দিয়ে বাঁধ বাঁচানোর চেষ্টা করেছে সাধারণ মানুষ। পিঠ দিয়ে উত্তাল ঢেউ থামানোর চেষ্টা করেছে তারা। এসব প্রচেষ্টা কোথাও কোথাও সফল হয়েছে, কোথাও হয়েছে ব্যর্থ। তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করা এসব বাঁধ দিয়ে এভাবে আর কত দিন? এই ভাঙা-গড়ার খেলা আর কত দিন দেখতে হবে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে? টেকসই বেড়িবাঁধ, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার প্রচণ্ড অভাব কিংবা অনীহা আজ তাদের এই অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

সাধারণ মানুষ যখন বুঝতে পেরেছে মহাবিপদ আসন্ন, তখনই তারা কোদাল হাতে, মাটির ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বাঁধ রক্ষায় নেমেছে। হয়তো সফল হয়েছে, অথবা হয়নি, প্রাণপণ চেষ্টা তো করেছে। পাউবোর প্রকৌশলী বা কর্মকর্তারা তখন কেন এগিয়ে আসেননি? তারা কি ডেল্টা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছেন?

উপকূলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ মেরামত করা হোক। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়েছে, সে কারণে বাঁধ মজবুত করার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধের উচ্চতাও বাড়াতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে, যাতে জোয়ার যত বেশিই হোক, বাঁধ উপচিয়ে যেন পানি আসতে না পারে। কিন্তু উপকূলবাসীর আবেদন, নিবেদন, দাবি কর্তৃপক্ষের কানে কতটা প্রবেশ করে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

জরাজীর্ণ বাঁধ মেরামত বা পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থের বরাদ্দ কত আছে আমার জানা নেই। তবে ধারণা করতে পারি, এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজে বরাদ্দ নিশ্চয়ই কম নয়। তা কি সঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে, সে প্রশ্ন জনগণের মনে রয়েছে। সঠিকভাবে ব্যয় হলে বাঁধের এত দুরবস্থা হবে কেন?

খোদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের মোট ১৬ হাজার ২৬১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। এর মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা অত্যন্ত ভঙ্গুর, নাজুক।

যদি নদীগুলোর পলি সরানো যেতো। ঠিক মতো ড্রেজিং করা হতো তাহলে সংকট ‌অনেকটাই কাটতো। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে খুলনা অঞ্চলে। ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডারে কাজগুলো পেয়েছে চাইনিজ কোম্পানি। ম্যাক্সিমাম প্রোফিট মার্জিন রেখে এই চাইনিজ কোম্পানিগুলো কাজ দিয়েছে দেশীয় ঠিকাদারদের। তারা আবার সাব কন্ট্রাক্ট দিয়েছে স্থানীয় ঠিকাদারদের। এভাবে ৩ হাত ঘুরে যখন কাজটা হচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই কাজটা হয়েছে দায়সারা গোছের। কোথাও কোথাও স্থানীয়রা প্রতিবাদ করেছে। সেই জায়গাগুলোতে কিছুটা ভালো কাজ হয়েছে। চাইনিজ কোম্পানিকে যদি বাধ্য করা যেতো- যাতে তারা কাজগুলো নিজেরা করে এবং সঠিক নজরদারি করা যেতো তাহলে এই দুরঅবস্থা হতো না।

বাঁধগুলোর নাজুক অবস্থার পেছনে আরও দুইটি কারণ আছে বলে আমি মনে করি-
১. বিভিন্ন জায়গায় মাছের ঘের করার জন্য লবণাক্ত পানি ঢুকানোর জন্য পাইপ বসানোর কারণে বাঁধ কাটা হয়েছে। ফলে বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়েছে।

২. বাঁধের উপরে ইঁদুর বাসা বেঁধে ছোট ছোট গর্ত করে। এই ছোট ছোট গর্ত দিয়ে পানি ঢুকে পরে বড় ক্ষতি করে।

ভবিষ্যতে টেকসই বাঁধ নির্মাণে এই বিষয়গুলোও মাথায় রাখতে হবে।

জন্ম থেকেই এ অঞ্চলের মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে করতে আজ ক্লান্ত। তারা এখন আর ত্রাণ চায় না, চায় পরিত্রাণ, চায় স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ। তারা আর বুক দিয়ে বাঁধ বাঁচাতে চায় না, চায় সরকার তাদের বেড়িবাঁধ বেঁধে দিক। বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করুক। ঘূর্ণিঝড় আরও আসবে, আসতেই থাকবে। তাদের ঘাম, চোখের পানি এবং ভিটেমাটি হারানোর কষ্ট নাড়া দিক শহুরে বাবুদের মনে। এবার একটা স্থায়ী সমাধান হোক।

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট


সূত্র : বিডি-প্রতিদিন