‘রাজনীতি করতে চাইলে দুর্নীতি ছাড়তে হবে। আর দুর্নীতি করলে রাজনীতি ছাড়তে হবে-’ উক্তিটি আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের। এই চমৎকার উক্তিটি বেশ মনে পড়তো কানাইঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জমির উদ্দিন চাচার কাছে গেলে। কেন মনে পড়তো?

জমির উদ্দিন প্রধানের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দুর্নীতির কোন গন্ধ নেই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি মহান পেশা শিক্ষকতা ছেড়ে আমৃত্যু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অত্যন্ত সাদাসিধে ও সুশৃংখল জীবন-যাপন করতেন। তাঁর দল বার বার ক্ষমতায় এসেছে; এবং দল ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়েও তিনি দলের একজন ত্যাগী ও একনিষ্ঠ নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারতেন। অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পকেট ভারী করার রাজনীতি করেননি জমির উদ্দিন প্রধান।


ইদানীং অনেককেই দেখা দেখা যায় রাজনীতিতে নেমে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান। কিন্তু অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে টানা রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থেকে কোন কিছুই করেননি জমির উদ্দিন প্রধান। কারণ রাজনীতিকে তিনি নিয়েছিলেন নেশা হিসেবে, জনগণের জন্য কাজ করার মাধ্যম হিসেবে; আয়-ইনকামের মাধ্যম হিসেবে নয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কানাইঘাটের এই ত্যাগী রাজনীতিক মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করেছেন; আর রাজনীতি করেছেন আওয়ামী লীগের জন্য নিবেদিত হয়ে। কানাইঘাট উপজেলায় তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কাণ্ডারি। এক সুবক্তা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। কানাইঘাটে আওয়ামী লীগ সংঘটিত করতে তিনি অপরিসীম ভূমিকা পালন করেছেন।

আওয়ামী লীগের প্রতি একনিষ্ঠ এই মানুষকে দলের তুলনামূলক প্রতিকূল সময়ে নমিনেশন দেওয়া হয়। ১৯৮৬ সালে সিলেট-৫ আসন থেকে আওয়ামী লীগ মনোনীতি প্রার্থী হিসাবে নৌকা প্রতীক নিয়ে তিনি নির্বাচন করেন। এরশাদ সরকারের আমলের সেই নির্বাচনে তিনি জিততে পারেননি। পরবর্তীতে ১৯৯১ সাল থেকে তাঁর দল বিভিন্ন সময় নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং এই আসনটি আওয়ামী লীগ একাধিকবার পেয়েছে। টাকা-পয়সার অভাবে হয়তো জমির উদ্দিন প্রধান পরবর্তীতে আর নির্বাচন করতে পারেননি। কিন্তু প্রতিকূল সময়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হয়ে দলের জন্য নির্বাচনী একটি ভিত্তি তৈরী করেছিলেন তিনি কানাইঘাট ও জকিগঞ্জে।

কানাইঘাটের নিজ চাউরা দক্ষিণ কান্দেবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী সদ্য প্রয়াত এই ত্যাগী রাজনীতিবিদের পারিবারিক নাম ছিলো জমির উদ্দিন। ১৯৭০ সালে কানাইঘাটে একটি নির্বাচনী জনসভায় যোগ দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিনই তিনি তৎকালীন ত্যাগী ছাত্রলীগ নেতা জমির উদ্দিনকে ‘প্রধান’ উপাধি দিয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি ‘জমির উদ্দিন প্রধান’ হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সেই সুপরিচিত ও সুবিদিত মানুষটি সবাইকে কাঁদিয়ে বৃহস্পতিবার (৮ জুন) ভোর ৪টার দিকে নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

৭৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে শুধু আওয়ামী লীগের লোকজনই নয়; এলাকাবাসী থেকে শুরু করে সব মহলের লোকজন শোকাহত হয়। সবাই বলছে, একজন সৎ ও ত্যাগী রাজনীতিবিদ বিদায় নিলেন। সত্যিই কানাইঘাটের রাজনীতির অঙ্গন থেকে চলে গেলেন একজন সজ্জন, সৎ ও নির্লোভ রাজনীতিবিদ।

তাঁর সততা ও রাজনীতির প্রতি একনিষ্ঠতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত হওয়া। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা দীর্ঘদিন ধরে নানা রোগে ভুগছিলেন। অনেক টাকা খরচ করে যে তিনি চিকিৎসা করাবেন, তাঁর সেই সামর্থ্যও ছিলো না। সামর্থ্য কেমন থাকবে? একটানা ১৩ বছর থেকে তাঁর দল ক্ষমতায় এবং আরো আগেও তাঁর ক্ষমতায় ছিলো; কিন্তু তিনি নিজেকে সামর্থ্যবার সামান্যতমও চেষ্টা করেননি। আওয়ামী লীগ করে তিনি আওয়ামী লীগকে দিয়েছেন, নেননি কিছু। ফলে ত্যাগী এই নেতার অসুস্থতার খবর শুনে ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জমির উদ্দিন প্রধানের হাতে ২০ লাখ টাকার চেক তুলে দেন। এই চেকপ্রাপ্তি শুধু সাহায্যপ্রাপ্তি নয়; এ যে তাঁর ত্যাগের রাজনীতিরও একটি স্বীকৃতি। আর তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে। মৃত্যুকালে দল-মত নির্বশেষে বিভিন্ন মহলের লোকজন করোনা সময়ের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে তাঁর জানাযায় উপস্থিত হয়।

লেখক: সহ-সাধারণ সম্পাদক, কানাইঘাট প্রেসক্লাব।