জেদান আল মুসা ::  ১২ই আগস্ট ছিলো বিশ্ব হাতি দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য “হাতি করলে সংরক্ষণ, রক্ষা পাবে সবুজ বন”। এর অর্থ আমাদের হাতিকে সংরক্ষণ করতে হবে এবং প্রাকৃতিক সবুজ বনকে রক্ষা করতে হবে। স্থলজ প্রাণীদের মধ্যে হাতি সবচেয়ে দীর্ঘাকার ও বিশালদেহী। এটি অত্যন্ত নিরীহ প্রাণীও বটে। হাতি তৃণভোজী এবং লতা-পাতা, গাছের নরম কান্ড ইত্যাদি হাতির প্রধান খাবার। দলবেধে চলতে এরা পছন্দ করে।

হাতি অত্যন্ত মূল্যবান প্রাণী। আমরা কথায় বলি “ হাতি মরলেও লাখ টাকা, বাঁচলেও লাখ টাকা"।


অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই মহা মূল্যবান প্রাণিটি আজ হুমকির মুখে। বাংলাদেশে বিপন্ন প্রায়ই প্রাণির তালিকাতে হাতির নাম আছে। বিশ্বে বর্তমানে হাতির সংখ্যা ৪ লাখের বেশি হবেনা। যেটি গত শতাব্দীতেও ১কোটিরও বেশি ছিল। প্রতি বছর বিশ্বে ২০ হাজারের বেশি হাতি চোরাকারবারিদের দ্বারা শিকারে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা কত সেটির হিসাব না থাকলেও সংখ্যাটা ৩০০/৪০০ এর বেশি হবে না। অথচ আজ থেকে ৬০/৭০ বছর আগেও আমাদের দেশে হাতির অবাধ বিচরণ ছিল। হাতির দাঁতই তার নিধনের অন্যতম কারণ। অনেকে বলে হাতির দাঁত স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবান। চীনে হাতির দাঁতের চাহিদা অনেক বেশি। এই জন্য শিকারী এবং চোরা কারবারিরা হাতি নিধনে ব্যস্ত থাকে।

সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে মাঝে মাঝে মানুষ ও হাতির বিরোধের খবর পাওয়া যায়। বন ধ্বংসের ফলে হাতির জন্য উপযুক্ত পরিবেশের সংকট তৈরি হয়েছে। হাতির আবাসস্থলের বেদখলের ফলে হাতি ও মানুষের বিরোধ তৈরি হয়। এর ফলে হাতি লোকালয়ে এসে ফসলের মাঠ ও বাড়ীঘরে আক্রমন করে। অনেকক্ষেত্রে মানুষের হাতে মারাও পড়ে। বাংলাদেশের শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলায় অনেক সময় বন্য হাতি লোকালয়ে চলে আসে এবং ক্ষেতের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে থাকে। এলাকাবাসির অনেকে  হাতির আক্রমন হতে রক্ষা পেতে  আলো জ্বালিয়ে রাত জেগে পাহারা দেয়। এর কারণ হলো হাতির আবাস সংকট। হাতির জায়গা মানুষ দখল করেছে, তাই হাতিগুলো বিতাড়িত হয়ে লোকালয়ে চলে আসে।

বাংলাদেশেও হাতি অনেক জনপ্রিয় ছিল। জমিদার ও রাজা-বাদশারা তাদের রাজরাড়ীতে হাতি পুষতেন। এগুলো এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। ভাওয়াল জমিদারের হাতিগুলো হাতির ঝিলে এসে গোসল করতো, যে রাস্তা দিয়ে আসতো সেই রাস্তার নাম এলিফ্যান্ট রোড। হাতির নামে বাংলাদেশে অনেক জায়গার নামও আছে। যেমন-হাতিরপুল, হাতির ঝিল, হাতি বান্ধা, হাতিয়া, হস্তিপুর ইত্যাদি। আগের আমলে রাজা বাদশাদের যুদ্ধের জন্য শক্তিশালী হস্তিবাহিনী ছিল। এগুলোকে যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষিত করা হতো। হাতিদের যারা যত্ন নেন তাদের বলা হয় “মাহুত” । আওয়াজ শুনে কমান্ড মেনে চলতে, হাতিদের ভালো মন্দের খেয়াল রাখতে মাহুতদের ভূমিকা অনেক। এদের কাছে হাতি গৃহপালিত পশুর মতোই বড় হয়।

আমরা অনেক সময় বলি “হাতির খোরাক অথবা হাতির মতো দেহ, হাতির পাল, হাতির শক্তি ইত্যাদি। এক্ষেত্রে হাতিকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের শিশুরাও কমবেশি হাতির সাথে পরিচিত। বাংলার সাহিত্যে হাতিকে নিয়ে অনেক গল্প, ছড়া ও কবিতা রচিত হয়েছে। একটা সময় আসবে হাতি তার প্রাকৃতিক পরিবেশ হতে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তখন হাতিকে শুধু চিড়িয়াখানায় দেখা যাবে। ইকো সিস্টেম ধ্বংস করে কোন উন্নয়ন করা উচিৎ নয়। বাংলাদেশে হাতিকে বাচাঁতে হলে হাতির চলাফেরার পথ নির্বিঘ্ন করতে হবে। তবে হাতির চলাচলের জন্য উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গাদের বসবাস একটি বড় অন্তরায়। এক্ষেত্রে বিকল্প ভাবতে হবে। নিশ্চয় বন অধিদপ্তর বিষয়টি নিয়ে ভাবছে। আমার মনে হয় উখিয়া ও টেকনাফের প্রাকৃতিক বনে হাতির অভয়ারণ্য করা যেতে পারে। তাছাড়া হাতির জন্য দরকার টেকসই পরিবেশ এবং তাদের খাদ্য ও সুরক্ষা নিশ্চত করা। আশার কথা হলো বন অধিদপ্তরের বন্য প্রানী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ হাতি সংরক্ষণ, হাতির প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও অবাধ বিচরনের জন্য ইতিমধ্যে নানা উদ্যোগ ও কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা ও বনবিদ হিসেবে আমার মনে হয় শুধু আইন দিয়ে হাতি রক্ষা করা যাবে না। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুসারে শাস্তির বিধান আছে, কিন্তু প্রয়োগ কম। শুধু বন বিভাগের উপর দায় চাপালে হবে না। এটা আমাদের সকলের দায়িত্ব। প্রকৃতিকে বাঁচাতে হলে, বনকে বাঁচাতে হলে সর্বপ্রথম দরকার Natural Protector তথা  বন্য-প্রানীকে বাঁচানো। হাতি দিবসে সকলে হাতির বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। আসুন আমি, আমরা,  আপনিসহ সকলে মিলে হাতি তথা বন্যপ্রাণিকে রক্ষা করি।

জেদান আল মুসা
পুলিশ সুপার (ক্রাইম এনালাইসিস)
রেঞ্জ ডিআইজি এর কার্যালয়
সিলেট।

 

সিলেটভিউ২৪ডটকম/ইদ্রিছ/মিআচৌ