১. তমাল ভট্টাচার্য নামের এক বাঙালি বাবু আফগানিস্তানের আন্তর্জাতিক ইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তিনি দেশে ফেরার সময় তালেবান জঙ্গিদের সামনে পড়েছিলেন। তালেবানদের মধুর ব্যবহারে তিনি মুগ্ধ হয়ে তাদের গুণগান গাইছেন এখন। তালেবান জঙ্গিরা ভোটে জিতে নয়, বন্দুকের নল ঠেকিয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় বসেছে, জঙ্গিরা ১৪০০ বছরের পুরোনো শরিয়া আইন জারি করবে, শরিয়া আইন কীভাবে মেয়েদের পাথর ছুড়ে হত্যা করে, মেয়েদের বোরখার অন্ধকারে বন্দি করে, মেয়েদের ইস্কুল কলেজে যাওয়ার, উপার্জন করার, স্বনির্ভর হওয়ার অধিকার ছিনিয়ে নেয়, বাঙালি বাবুটি নিশ্চয়ই জানেন, তারপরও কী করে তিনি বলেন, নব্বই দশকের তালেবান আর এখনকার তালেবানে বিস্তর তফাৎ! তাদের ব্যবহারে তিনি তফাৎ দেখেছেন, কিন্তু যে শরিয়া আইনের অধীনে দেশ শাসন করতে তারা বদ্ধ পরিকর, সেই শরিয়া আইন তো একই আছে, নব্বই দশকে যা ছিল, এখনও তো তাই। তালেবান যদি আগের চেয়ে ভালো হতো এখন, যদি সত্যিই তাদের পরিবর্তন হতো, তাহলে শরিয়া আইনের নাম তারা মুখে আনতো না।

ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘পুট ইয়রসেলফ ইন মাই সুজ’। তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে বলে তালেবান ভালো? তারা অন্যের সঙ্গে কী ব্যবহার করছে তা দেখে তো তাদের সম্পর্কে রায় দিতে হবে! আফগান মেয়েরা যদি বলে আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে তালেবানদের সম্পর্কে মন্তব্য করো, তাহলে? তমাল যদি বাঙালি বাবু না হয়ে কোনও স্বাধীনচেতা আফগান মেয়ে হতেন, যে মেয়ে বোরখা বা হিজাবের শৃঙ্খল পছন্দ করেন না, তমাল ভট্টাচার্যের মতোই আন্তর্জাতিক ইস্কুলে শিক্ষকতা করতে চান, স্বনির্ভর হতে চান, তাহলে?
২. আফগানিস্তানের জেল থেকে বন্দি জঙ্গিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। জঙ্গিরা দেশ চালাবে। দেশে দেশে জঙ্গিরা স্বপ্ন দেখছে তালেবান হওয়ার, ক্ষমতা হাতে পাওয়ার। জঙ্গিরা একবিংশ শতাব্দীকে টেনে সপ্তম শতাব্দীতে নিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় মুসলিম দেশগুলো ধর্মীয় বিধান অনুসরণ করে চলুক, সপ্তম শতাব্দীর আইন জারি হোক সেসব দেশে। তারপর একসময় নিজেরাই বুঝুক সপ্তম শতাব্দীর আইন একবিংশ শতাব্দীতে কতটা খাপ খায়। এরপর সিদ্ধান্ত নিক, জঙ্গির পক্ষ নেবে নাকি প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আগেও এসেছে, এবারও এলো। বার বার হয়তো আসবে না।


৩. তালেবান বলেছে মেয়েদের ঘরের বাইরে বেরোনোর দরকার নেই। চাকরি করার দরকার নেই। ঘরে বসে থাকলেই নাকি তাদের বেতন দেওয়া হবে। তবে পুরুষেরা চাকরি করার জন্য ঘরের বাইরে বেরোবে, তারা চাকরি করবে। মেয়েরা কখনও কোনও কারণে বাইরে বেরোতে চাইলে সঙ্গে পুরুষ থাকতে হবে। পুরুষই মেয়েদের অভিভাবক। তিরিশোর্ধ্ব এক মেয়ে সেদিন বললো, সে কিছু খাবার কিনতে গিয়েছিল দোকানে, চার বছরের একটি বাচ্চা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়েছিল। ওই ছেলে বাচ্চাটিই ছিল তার অভিভাবক। ওই অভিভাবকটি না থাকলে একলা বেরোনোর অপরাধে মেয়েটিকে চাবুকের মার খেতে হতো।

৪. বাল্যবিবাহের জন্য চাপ আসছে। কোনও বাড়িতেই যেন আঠারো বছর হয়ে যাওয়া কোনও অবিবাহিত মেয়ে না থাকে। আঠারো বছরের আগেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার মানে জেনেশুনে মেয়েদের বিষ খাওয়ানো, মেয়েদের যাবতীয় উজ্জ্বল সম্ভাবনা ধ্বংস করে দেওয়া।

৫. তালেবান সন্ত্রাসীরা আফগানিস্তানে মুসলিম ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে বলে ভারতের মুসলিম ধর্মীয় নেতারা, অল ইন্ডিয়া মুসলিম ল’ বোর্ডের কর্তারা সকলে আনন্দে আত্মহারা। অথচ এরাই কিন্তু ভারতে হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রচÐ বিরোধী, এরা চায় ভারত সেক্যুলার থাকুক, ধর্মনিরপেক্ষ থাকুক, চায় ভারতে গণতন্ত্র থাকুক। কিন্তু মুসলিম দেশগুলোর ধর্মনিরপেক্ষ না হওয়া নিয়ে, গণতন্ত্র না থাকা নিয়ে এরা মোটেও বিচলিত নয়। এরা অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতা চায়, আর মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে চায় ধর্মের শাসন। এই হিপোক্রেসিটা এরা বড় নির্লজ্জভাবে করে।

৬. নব্বই দশকের তালেবান আর এবারের তালেবানে তফাৎ কিছু নেই। একসময় সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছিল তালেবান। মঞ্চে গান Bangladesh Pratidinগাওয়া, গানের সিডি বিক্রি করা, এমনকী ঘরে বসে গান গাওয়াও ছিল নিষিদ্ধ। কাবুলের জাতীয় সঙ্গীত ইন্সটিটিউট কিন্তু এবারও বন্ধ। কিছুদিন আগে সেই ইন্সটিটিউটে ঢুকে বাদ্যযন্ত্র সব ভেঙে গুঁড়ো করে এসেছে তালেবান। এর আগে সঙ্গীত শিল্পীদের অনেককে হুমকি দেওয়া হয়েছে, অপহরণ করা হয়েছে, এমনকী খুনও করা হয়েছে। একবার তো এক আত্মঘাতী বোমারু বসেছিল এক কনসার্টে। বোমায় উড়ে গেল এই আত্মঘাতী, কান নষ্ট হয়ে গেল সঙ্গীত ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ সারমাস্তের। সেদিন কনসার্টে যারা উপস্থিত ছিল, তাদের আতঙ্ক হয়তো যতদিন তারা বাঁচে থাকবে। বাড়িতে যাদের গিটার বেহালা ইত্যাদি আছে, তারা এখন ভয়ে তটস্থ। তালেবান ঘরে ঘরে হানা দিতে পারে বাদ্যযন্ত্রের খোঁজে। কারও বাড়িতে পেলে বাদ্যযন্ত্র ভাঙবে তো বটেই, সঙ্গীতশিল্পীকে হত্যাও করতে পারে। মানুষ যে দেশ ত্যাগ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, সে কি এমনি এমনি!

৭. আফগান মেয়েদের নিরাপদ দেশগুলোয় সরিয়ে নেওয়া উচিত। তাদের বাঁচার অধিকার আছে। তালেবান যে বলেছে তারা মেয়েদের আগের মতো অত্যাচার করবে না, হত্যা করবে না, তাদের আদৌ বিশ্বাস করছে না মানুষ। বিশ্বাস করছেন না বিমানবাহিনীর প্রথম আফগান মহিলা পাইলট নিলুফার রাহমানি। নিলুফার বলেছেন, খুব শিগগিরই কাবুল স্টেডিয়ামে নিয়ে মেয়েদের পাথর ছুড়ে হত্যা করবে তালেবান। মেয়েদের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাতটা খুব শিগগিরই আসবে।

৮. কোনও দেশেরই তালেবানদের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত নয়। তালেবান কোনও জনগণের সরকার নয়। তালেবান আগাগোড়া একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক কোনও সম্পর্ক রাখা মানেই তাদের সন্ত্রাসকে মেনে নেওয়া, তাদের নারীবিদ্বেষ এবং নারীহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়া। সভ্যতাবিরোধী তালেবানের সঙ্গে কোনওরকম আপোস চলতে পারে না। তালেবানদের যে করেই হোক বিদেয় করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে আফগানিস্তানে। আফগান নারীদের ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের প্রাপ্য অধিকার। আফগান নারীরা তালেবানের ভয় বাধা তুচ্ছ করে কিছুদিন আগে রাস্তায় নেমেছেন তালেবানবিরোধী প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষকে সামনে এগোতেই হয়।

৯. সমস্ত নারী সংগঠনগুলোকে আফগান মেয়েদের পক্ষে সরব হতে হবে। আফগান মেয়েরা কোথায় কেমন আছে, সে খবর নিতে হবে। খবর বিশ্বময় প্রকাশ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এই মেয়েদের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। শুধু মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে আজকে তাদের অসহনীয় অত্যাচার সহ্য করতে হবে কেন!

১০. বাংলাদেশের প্রচুর লোক শুনেছি তালেবানদের আফগানিস্তান দখল কথায় রীতিমতো উৎসব করছে। এদের অনেকেই নানা বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে আফগানিস্তানে গিয়ে তালেবানি ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। এরা আরও যাবে, চেষ্টা করবে নিজের দেশটিকেও তালেবানের দেশ বানাতে। সরকার কি একেবারেই সচেতন হবে না?

১১. ভারতের দেওবন্দিরা কোনও সন্ত্রাস করেন না। কিন্তু ভারতের বাইরে দেওবন্দিদের আদর্শে যারা বেড়ে ওঠে, তারা সন্ত্রাস করে বেড়ায়। যেমন বাংলাদেশের হেফাজত, যেমন আফগানিস্তানের তালেবান। দেওবন্দিদের আদর্শে নিশ্চয়ই কোনও গলদ আছে। তাঁরা ধর্মগ্রন্থের আক্ষরিক অর্থকে মূল্য দিয়েছেন বলে ওটিকেই শিরোধার্য করে কিছু মানুষ সন্ত্রাসের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নারী এবং নাস্তিকতার বিরুদ্ধে, সংখ্যালঘু এবং সমানাধিকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছে। হয় দেওবন্দিদের নিষিদ্ধ করা হোক, নয়তো তাদের রিফর্মেশানের কাজে নিয়োজিত করা হোক।

১২. আমেরিকা আফগান ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে চলে যাচ্ছে, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে চলে যাচ্ছে, তালেবানদের ক্ষোভ। কিন্তু এ তো এমন নয় বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমেরিকা যত অভিজ্ঞ লোক পাচ্ছে, উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে বিশেষজ্ঞরা তালেবান শাসিত আফগানিস্তানে বাস করতে চাইছেন বা বলে চলে যাচ্ছেন।

যাদের কাছে বিজ্ঞানের মূল্য নেই, শুধু আছে ধর্মের মূল্য, তাদের কাছে বিজ্ঞানী থাকতে চাইবেন কেন! যদি স্বেচ্ছায় বাস করতে চায় কেউ আফগানিস্তানে, সে মৌলবাদী বা সন্ত্রাসবাদী ছাড়া আর কেউ নয়।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।