আজ থেকে প্রায় অর্ধ-শতাব্দিরও বেশী সময়কাল আগের কথা। অনেক পূর্বের ঘটনা বলে সন-তারিখটি এখন আর মনে নেই। স্বাধিকার আন্দোলনের উত্তাল সময়। আমি তখন মফস্বল শহর বারহাট্টার একমাত্র হাই স্কুলের নিচু ক্লাসের ছাত্র। মাত্র কিছুদিন আগে আরেক অতি অজপাড়াগাঁয়ের ছাপড়া ঘর সম্বলিত প্রাইমারি স্কুল ডিঙ্গিয়ে ওখানে এসে ভর্তি হয়েছি। প্রতিদিন বাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে তিন মাইল পথ হেঁটে আসা-যাওয়া করি। সেদিন স্কুলে এসেই শুনি, আজ কোন ক্লাস হবে না, পরিবর্তে স্বৈরাচারী পাক-সরকার বিরোধী আন্দোলন ও মিছিল হবে, ছাত্রনেতাদের নির্দেশ। মনের মাঝে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলো। হঠাৎ খবরটি জেনে মনের মাঝে আনন্দ এবং আতঙ্ক, দুটোই কাজ করছিল। আবার কিছুটা উত্তেজনাও। কারন, ইতিপূর্বে ‘আন্দোলন ও মিছিল’ শব্দ দুটির নাম শুনলেও পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার কারনে কেমন করে এসব করতে হয়, তা জানা ছিল না। আনন্দ এজন্য যে, দীর্ঘক্ষন বসে ক্লাস করতে হবে না। আবার মিছিল এবং গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে শ্লোগান, এ দুটি সম্পর্কে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, তাই কিছুটা উত্তেজনা। আবার পিঠের উপর পুলিশের পিটুনিও পড়তে পারে, এজন্য আতঙ্ক।

কিছুক্ষনের মধ্যই স্কুলের ওপড়ের কøাসের বেশ কয়েকজন সিনিয়র ছাত্রনেতা এলেন। তাদের করা নির্দেশ, কেউ যেন পালিয়ে না যায়, মিছিলে অংশ নিতে হবে। আর মিছিল কীভাবে করতে হবে এবং কি বলতে হবে, তার একটি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিলেন। খুব যে বেশি কিছু বলতে হবে এমন নয়, অল্প ক’টি কথা মাত্র। তাদের কয়েকজন হাত উঁচিয়ে চিৎকার করে বলবেন, ‘১৪ই ফেব্রুয়ারি, ১৪ই ফেব্রুয়ারি’। সাথে সাথেই আমাদের সবাইকে সমস্বরে বলতে হবে, ‘হরতাল, হরতাল’ ।


অনতিবিলম্বে নেতারা আমাদের ক্লাসের সবাইকে ডেকে নিয়ে গেল স্কুলের মাঠে। ওখানে গিয়ে দেখি ইতোমধ্যে স্কুলের প্রায় সকল ছাত্র-ছাত্রী জড়ো হয়েছে। উল্লেখ্য, তখনকার দিনে সাধারণত স্কুলের নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এবং পড়াশুনায় আগ্রহ কম শুধু এমন ছাত্ররাই রাজনীতি করত ও ছত্রদেরকে নেতৃত্ব দিত। অধিকন্তু যদিও তাদের সাথে আমাদের শিক্ষাক্রমের ব্যবধান ৪-৫ ক্লাস, কিন্তু বয়সক্রমের ব্যবধান ১০ বছরের কাছাকাছি। ফলে চেহারায়, উচ্চতায় এবং অবয়বে তারা আমাদের চাইতে অনেকটাই বড় ছিল। তাই, তাদের নির্দেশ অমান্য করার মত বুকের পাটা আমাদের কারো ছিল না। একজন বয়স্ক রাখাল বা গো-রক্ষক যেমন করে তার পশুপালকে দাপিয়ে এবং তাড়িয়ে নিয়ে যায়, তেমনি করে ছাত্র-নেতারাও আমাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে আমাদেরকেও অনেকটা ছাগল-খেদার মত করে তাড়িয়ে নিয়ে সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিল। স্কুলের সকল ছাত্র-ছাত্রী মিলে সংখ্যায় প্রায় সাত’শ। দুই লাইনের মাঝখানে, ফাঁকা জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে একজন নেতা তাঁর বজ্রমুষ্টি উঁচিয়ে হুঙ্কার ছাড়ল, ‘১৪ই ফেব্রুয়ারি, ১৪ই ফেব্রুয়ারি’। আমরাও নির্দেশমত সকলে মিলে মুষ্ঠীবদ্ধ হাত উঁচিয়ে সমস্বরে ও ততোধিক উচ্চস্বরে, গগন-বিদারী আওয়াজ তুললাম, ‘হরতাল, হরতাল’। বিদ্যুৎবেগে ছোট্ট মফস্বল শহরটির আকাশ-বাতাস শ্লোগানে-শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল।


মিছিল সদর রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল। ম:স্বলের ছোট্ট এই শহরের রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করতে বেশি সময় লাগল না। এক পর্যায়ে মিছিল এগিয়ে চলল থানার সামনের রাস্তাটি ধরে। পাশফিরে তাকিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন পুলিশ রাইফেল হাতে থানার গেট পাহারা দিচ্ছে। ভয়ে শরীরে কাঁটা দিল। কারন অজপাড়াগাঁয়ে বড় হওয়া তখনকার বয়েসে এক-একটা বন্দুকধারী পুলিশ আমার কাছে এক-একটা মুর্তিমান আতঙ্কের নামান্তর। ইতোপূর্বে দেখতাম, যখন পুলিশ রাইফেল হাতে গ্রামে যায়, তখন চোর-সাধু-অপরাধী-নিরপরাধ নির্বিশেষে সকলে দৌঁড়ে পালাতে। রাস্তার ঐ অংশটুকু পার না হওয়া পর্যন্ত আমার কন্ঠে স্বর ফুটছিল না। ভয়, শেষে আমার শ্লোগান যদি ওদের কানে পেঁঁৗঁছে যায়, যদি শুনে ফেলে আমার কন্ঠ, যদি ধরে থানায় নিয়ে চোরের মত পিটুনি দেয়, পিঠের ওপর রাইফেলের বাট দিয়ে দু’ঘা বসিয়ে দেয়, কিংবা গুলিই করেফেলে। তখন কি হবে?

যা হোক সদর রাস্তার থানার অংশটুকু আমরা পার হলাম নির্বিঘ্নেই। পুলিশ কিছুই না বলে অনেকটা নির্বাক দর্শক হয়েই রইল। আমরা সবাই বীরদর্পে মিছিল শেষে আবার স্কুল মাঠে জমায়েত হলাম। নেতাদের নির্দেশে সবাই মাঠের ঘাসের উপর গাদাগাদি বসে পড়লাম। শুরু হলো নেতাদের সব অগ্নিঝরা জ¦ালাময়ী বক্তৃতা, আর সভা মুখরিত হলো তুমুল করতালিতে। লক্ষ্য করলাম, বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রায় সকল বক্তাই একটি নাম নয়, একটি উপাধি উল্লেখ করছেন এবং তাঁর নির্দেশের কথা বলছেন। সেই উপাধিটি ‘বঙ্গবন্ধু’। সবেমাত্র পাড়াগাঁয়ের স্কুল ছেড়ে ওখানে ভর্তি হয়েছি। এই উপাধিটি সম্পর্কে পূর্ব পরিচিতি ছিল না। কারণ, সময়টা ছিল পাকিস্তানি আমল। পশ্চিমাদের শাসন বিধায় বই-পুস্তকেও নামটা সেভাবে আসত না। যে নামগুলি তখন ঘুরেফিরে আসতো এবং যাদের গান করা হতো, তার মধ্য রয়েছেন; পাকিস্থানের জনক কায়দে আযম মোহম্মদ আলি জিন্নাহ, কায়েদে মিল্লাত লিয়াকত আলি খান, পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা চৌধুরী রহমত আলি, স্ব-ঘোষিত ফিল্ড মার্শাল এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আইয়ুব খান, ইত্যাদি। আর বাঙালিদের মাঝে আছেন গভর্নর মোহাম্মদ মোনায়েম খান, গণপরিষদের প্রাক্তন স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরী, মোহাম্মদ নুরুল আমীন, খান আবদুস সবুর খান, ইত্যাদি নাম। সেইসাথে ১৯৬৫ সনে সতের দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানের ভারত জয়ের কাহিনি। সেখানে অন্তত বই-পত্রে বঙ্গবন্ধুর নাম তেমন করে আসত না। পত্র-পত্রিকা থাকলেও পড়ার সুযোগ নেই। স্কুলে গিয়ে তৎকালিন সময়ে লাইনে দাঁড়িয়ে উচ্চকন্ঠে গাইতে হত, ‘পাক-ছার জমীন সাদ বাদ, কিশওয়ারে আশীন সাদ বাদ .......’।


দেখলাম আশেপাশের অনেক সহপাঠীরাও বঙ্গবন্ধুর কথা বলছে। আমি ব্যগ্র হয়ে উঠলাম তার প্রকৃত নামটি জানার। কিন্তু কোন বক্তাই তাঁর নামটি বলছেন না। প্রবল ঔৎসুক্য নিয়ে কাটছিল সময়। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে, সাহস করে যে কাউকে জিজ্ঞেস করব, সেই ভরসাও পাচ্ছিলাম না। একে ত গ্রামের স্কুলের ছাত্র, ততোধিক গাঁ-গেড়ামে জন্ম, পাছে সবাই মিলে হাসাহাসি করে, “এখনও বঙ্গবন্ধুর নাম জানিস না, গাধা কোথাকার!”। নামটি জানার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে বাকি সময়টা কাটালাম।

এক সময় বক্তৃতা-বিবৃতি শেষ করে নেতৃবৃন্দ মিটিং এর সমাপ্তি ঘোষনা করলেন। মিছিলে শ্লোগান দিতে-দিতে কেন যেন নিজের অবচেতন মনেও কিছুটা নেতা-নেতা ভাব কাজ করছিল। এরকম একটি ফুরফুরে অনুভুতি নিয়ে রওয়ানা হলাম বাড়ির পথে। পথিমধ্য মুখোমুখি হলাম আমার অত্যন্ত কড়া মেজাজের আজন্ম ছেলে শাসানো স্কুল শিক্ষক বাবার। অসময়ে বাড়ির পথে আমাকে দেখতে পেয়ে বাবার সন্ধিগ্ধ চোখের জিজ্ঞাসা, কেন ছুটির পূর্বেই বাড়ি ফিরছি। তাঁর ধারণা, আমি স্কুল পালিয়েছি। জবাবে বললাম, আজকে স্কুলে কোন ক্লাস হয়নি, স্ট্রাইক হয়েছে এবং হরতাল আহবান করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। আমি আরও কিছু আগোছালো জবাব দিয়ে স্কুলে ক্লাস না হওয়ার বিষয়টি পরিস্কার করতে চেষ্টা করলাম। মনে হল আমার কথাগুলি তাঁর কাছে কিছুটা হলেও বিশ^াসযোগ্য হয়েছে। সম্ভবত বুঝতে সক্ষম হলেন যে, ছেলে যা বলছে তা আর যাই হোক, এটি কোন স্কুল পালানো ছাত্রের বানোয়াট কল্প-কাহিনি নয়। লক্ষ্য করলাম, কথা প্রসঙ্গে তিনিও বারকয়েক ‘বঙ্গবন্ধ’ু কথাটি উল্লেখ করলেন, কিন্তু তার প্রকৃত নামটি এক বারের জন্যও উচ্চারন করলেন না।

আমার স্কুল জীবনে পড়া-শুনার একটা নির্দিষ্ট রুটিন ছিল। তন্মধ্যে সন্ধাবেলায় এক ঘন্টার একটি পিরিয়ড বরাদ্দ ছিল আমার ¯ু‹ল শিক্ষক পিতার জন্য। তিনি রোজ সন্ধাবেলায় একটু চিকন গোছের একটি বাশেঁর কঞ্চি নিয়ে আমাদের পড়াতে বসতেন। ঐদিন বিকেলে বাড়ি ফেরার পূর্বে শহর থেকে বোধ হয় তিনিও আন্দোলন, হরতাল ও মিছিল-মিটিং এর খবর জেনে এসেছিলেন। তাই, পড়াতে বসে, তিনি নিজেই এর কিছুটা তাৎপর্য ব্যাখ্যা করলেন। সেই সুযোগে আমি বঙ্গবন্ধুকে চেনারও সুযোগ পেয়ে গেলাম।

সেদিন বাবা নিত্যদিনের অংক-বিজ্ঞান ফেলে রেখে তখনকার দিনের পশ্চিমাদের অপশাসন, বাঙ্গালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলন, সে আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভুমিকা ও নেতৃত্ব দান, তিলে তিলে তার ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠা, ইত্যাদি নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ ক্লাস নিলেন। আমি মুগ্ধ চিত্তে শুনছিলাম সে কাহিনি। এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম, বঙ্গবন্ধু কে, তাঁর প্রকৃত নাম কি? আর এমনি করেই আমার বাবার কাছেই জেনে নিলাম সেই অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর নাম। সেই নামটি, ’শেখ মুজিবুর রহমান।’

লেখক: অধ্যাপক, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।