মুরারিচাঁদ কলেজ ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তৎকালীন সিলেটের প্রখ্যাত শিক্ষানুরাগী রাজা গিরিশচন্দ্র রায় (১৮৪৫ - ১৯০৮) -এর অনুদানে। কলেজটির নামকরণ করা হয় তার প্রপিতামহ মুরারিচাঁদ এর নামে। পূর্বে কলেজটি সিলেটের বন্দর বাজারের নিকট রাজা জি সি উচ্চ বিদ্যালয় এর পাশে অবস্থিত ছিল।

১৮৯১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটিতে এফ. এ. ক্লাস খোলার অনুমতি দিলে ১৮৯২ সালের ২৭ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে মুরারিচাঁদ কলেজের যাত্রা শুরু হয়। সেসময় ছাত্রদের বেতন ছিল ৪ টাকা এবং ১ম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশকৃতদের জন্য বিনা খরচে পড়ার ব্যবস্থা ছিল।


১৮৯২ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত রাজা গিরিশচন্দ্র রায় নিজেই কলেজটির সকল খরচ বহন করেন। ১৯০৮ সালে রাজা মারা গেলে কলেজটি সরকারি সহায়তা চায়। তখন থেকে কলেজটি সরকারি সহায়তায় পরিচালিত হতে থাকে। এরপর ১৯১২ সালে কলেজটি পূর্ণাঙ্গ সরকারি কলেজ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। একই বছর তৎকালীন আসামের চিফ কমিশনার স্যার আর্চডেল আর্ল কলেজটিকে ২য় শ্রেণির কলেজ থেকে ১ম শ্রেণির কলেজে উন্নীত করেন। ১৯১৩ সালে কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান ক্লাস চালু হয়। পরবর্তীতে জননেতা আব্দুল মজিদ (কাপ্তান মিয়া) সহ আরো অনেকে মিলে ১৮০০০ টাকা অনুদান দিলে কলেজটিতে স্নাতক শ্রেণি চালু হয়।

১ম বিশ্বযুদ্ধ ও অন্যান্য নানা সমস্যার কারণে কলেজের ক্যাম্পাস পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন কলেজ থেকে ৩ কি. মি. দূরে থ্যাকারে টিলায় (বর্তমান টিলাগড়) ১২৪ একর ভূমি নিয়ে বিশাল ক্যাম্পাসে কলেজ স্থানান্তর করা হয়। সে সময় কলেজের ছাত্রসংখ্যা ছিল ৫৬৮ জন। বর্তমানে কলেজটির শিক্ষার্থীসংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। ১৯২১ সালে তৎকালীন আসামের গভর্নর স্যার উইলিয়াম মরিস কলেজের নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯২৫ সালে ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হলে তা উদ্বোধন করেন তৎকালীন আসামের গভর্নর স্যার উইলিয়াম রীড।

১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। দেশ বিভাগের পর এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৬৮ সালে কলেজটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়, এবং সর্বশেষ ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এর মত মুরারিচাঁদ কলেজটিকেও বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর অধিভুক্ত করা হয় এবং অদ্যাবধি রয়েছে।

কলেজের সুবিশাল ক্যাম্পাসে রয়েছে একটি ক্যান্টিন(বর্তমানে নবায়নরত), একটি মসজিদ, ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক হোস্টেল, বিভিন্ন বিভাগীয় ভবন এবং একটি খেলার মাঠ রয়েছে। ক্যাম্পাসের পূর্বে রয়েছে সিলেট সরকারি কলেজ এবং উত্তরে রয়েছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। এছাড়াও কলেজের পাশেই রয়েছে টিলাগড় ইকো পার্ক। কলেজের ভিতরে একটি পুকুরও রয়েছে।
কলা, বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদ মিলিয়ে কলেজটিতে প্রায় ১৬ টি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স বিভাগীয় শিক্ষার্থীসহ সারাদেশের শিক্ষার্থীদের অন্যতম একটি ভরসাস্থল।

এই কলেজের লাইব্রেরিটি সমগ্র সিলেটের এমনকি বাংলাদেশেরই একটি অন্যতম প্রাচীন লাইব্রেরি। বর্তমানে এই লাইব্রেরিতে ৬০,০০০-এর অধিক বই রয়েছে। একই সাথে সকল বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নিজস্ব সেমিনার লাইব্রেরি রয়েছে ।

কলেজ ক্যাম্পাসে ১টি ছোটখাট বোটানিক্যাল গার্ডেন আছে। এই বোটানিক্যাল গার্ডেনটি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। এটি সমগ্র সিলেটের একমাত্র বোটানিক্যাল গার্ডেন। এছাড়া কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগে একটি জ্যুওলজিক্যাল মিউজিয়াম আছে। এতে বিভিন্ন ধরনের প্রাণির একটি বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাকরনের ফলে বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদগুলোর সংগ্রহ ও এদের সাথে জিনগত বৈসাদৃশ্যকে সাদৃশ্যকরণে দেশীয় বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণার সুযোগ পান।

এই কলেজেরই শিক্ষার্থী ছিলেন- মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল আবু তাহের বীর উত্তম, বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান, বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক, সাহিত্যিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, সাংবাদিক আলতাফ হোসেইন, পাকিস্তানের শিল্পমন্ত্রী-১৭ আগস্ট ১৯৬৫ – ১৫ মে ১৯৬৮।
নুরুল ইসলাম নাহিদ, বাংলাদেশের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী, জয় ভদ্র হগজর, (১৯১৪–১৯৭৩) ভারতের সাবেক এমপি ; প্রাক্তন ভেটেরিনারি মন্ত্রী, আসাম সরকার, নীহার রঞ্জন রায়, বিখ্যাত ঐতিহাসিক
মোহাম্মদ আতাউল করিম, বাংলাদেশী পদার্থবিজ্ঞানী, এম এ রশীদ , বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রথম উপাচার্য, মোহাম্মদ আতাউল করিম, (জন্ম: ৪ মে, ১৯৫৩) বাংলাদেশী-মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার নরফুকে অবস্থিত ওল্ড ডোমিনিয়ন ইউনিভার্সিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট (গবেষণা) হিসেবে কর্মরত এই বিজ্ঞানী ইলেক্টো-অপটিক্সের গবেষণায় অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য।
আব্দুল মালিক, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় অধ্যাপক, খলিল উল্লাহ খান, প্রখ্যাত অভিনেতা। মুফতি নুরুন্নেছা খাতুন, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, শিক্ষক এবং উদ্যানবিদ্যাবিদ। নীহাররঞ্জন রায়, ইতিহাসবেত্তা, সাহিত্য সমালোচক।
ময়নুল হক চৌধুরী , (১৯২৩-১৯৭৬) আসাম মন্ত্রী সভায় প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, গল্পকার সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়। শানারেই দেবী শানু, অভিনেত্রী ও মডেল, লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার মুকুট বিজয়ী।

বর্তমানে কলেজে ২টি হোস্টেল রয়েছে। একটি ছাত্রদের ও অপরটি ছাত্রীদের জন্য। ছাত্রদের হোস্টেলটি ৬ টি ব্লকের সমন্বয়ে গঠিত যার মধ্যে ১টি ব্লক হিন্দু ছাত্রদের জন্য এবং বাকি ৫টি ব্লক মুসলমান ছাত্রদের জন্য। ছাত্রাবাসের পুকুরের পূর্বপাশে নতুন ৪তলা বিশিষ্ট আরো একটি ছাত্রাবাস চালু হয়েছে ছাত্রদের জন্য।
শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত অবদান রেখে যাচ্ছে কলেজটির অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন থিয়েটার মুরারিচাঁদ ও মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন। ১২৪ একরের এই ক্যাম্পাসে যে দিকেই চোঁখ যায়, সবুজের সমারোহ যেন আন্তরিক বন্ধু হয়ে বরণ করে নেয় সুবিশাল বুকের খাম। একপসলা বৃষ্টির পরে ভেজা রাস্তার সাথে উসকোখুসকো চুলের মতো সবুজ গাছগুলো প্রতিনিয়ত হৃদয়ে নাড়া দেয়, হাত বাড়িয়ে ডাকে প্রাণের পরে। ছোটছোট টিলার সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত— এই কলেজের শিক্ষার্থীদের চোঁখ ও মন কিছুতেই ভরে উঠেনা তাতে,এ-যেন জন্মান্তরের ভ্রমে বাঁধা অনুপম নৈসর্গই স্বয়ং স্থপতি হৃদয়ের।
প্যারিস নিয়ে অন্নদাশংকর রায়ের পথে-প্রবাসে ভ্রমণকাহিনীতে একটা উক্তি ছিল এরকম যে— "পারীর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বড় হবো কিন্তু বৃদ্ধ হবোনা"।

নীল ও মেঘেদের খেলায় সদ্য বেড়ে উঠা হোস্টেল ক্যাম্পাসের ফুলগাছগুলোর দিকে থাকলে যেন নবপ্রাণের সঞ্চার ঘটে। মহামারী প্রাক্কালে ছাত্রাবাসের মধ্যে রোপনকৃত ফুলগাছগুলো বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের শৈল্পিক ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ বলতেই হবে। প্রকৃতির অপরুপতা মনের মালিন্যকে ছাই করে মুহুর্তেই, না দেখলে বিশ্বাস হবেনা হয়ত, কত কাছাকাছি স্বগীয় বাতাস, সুমিষ্ট পাখির কিচিরমিচিরে মুগ্ধ করে চিলতে রুদ্দুরে পাতার শব্দে বিবশ করে মনের রঙ্গিনত্বকে। রাধাচূড়ার লাল ও হলদেটে আভায় নীলিমারা এতো কাছাকাছি ডেকে উঠে একলা-একা, নির্জনতার সঙ্গে আলিঙ্গন করলেই তা স্পষ্ট হয়। রৌদ্রস্নাত বিকেলে রবির আলো সুবর্ণময় হয়ে উঠায় প্রকৃতির পরতে লুকিয়ে থাকা পরিচ্ছন্নতা যেন বৃদ্ধ পাতাদের ঝরে পড়ায় সামিল করে কদাচিৎ সমীরণকে। তারপর বৃক্ষগুলো আরো সবুজ হয়ে ফুঠে উঠে।

অসমিয়া ধাঁচে তৈরিকৃত ছাত্রাবাসের পুরাতন টিনের দিকে তাকালেই চোঁখে পড়ে এক রাজমুকুট যেন জেগে থাকে দিবারাত্রি। বিশাল হরিৎপ্রান্তরে ঘাসফড়িংগুলো ছুটোছুটি করে ঘাসফুলে ও সবুজ ঘাসে; হয়ত ওরা সাড়া দেয় প্রকৃতির শুদ্ধতম ডাকে। ইউক্যালিপটাসের শুকনো শাখায় কাঠঠোকরার ঠুকঠুক শব্দ নির্জনে কোন মিষ্ট রাগের অনুকরণে মাঝেমাঝে তানসেন হয়ে যায়। এতো স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকৃতির মিশেল নবনৃত্যের বিশ্বস্তরূপে মানব হৃদয়ের সাময়িক অবকাশ, অনুভূতির গন্ডিকে বাড়িয়ে তুলে ঠিকই। কিন্তু মানুষ কতটুকু ভালবাসে প্রকৃতিকে?

লেখক: সাংবাদিক