২০১৭ সালে সুনামগঞ্জে অসময়ে হাওর ডুবি হয়। সকল হাওরের বোরো ফসল কাঁচা অবস্থায় থলিয়ে যায়। সময় মতো বাঁধের কাজ না করা ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম দুর্নীতির কারনেই হাওর ডুবি হয়। যাঁকে আমরা বলছি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ।

হাওর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেলা শহরে যে কয়েকজন মানুষ শুরু থেকে সোচ্চার ছিলেন তাদেন মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা মালেক হোসেন পীর একজন। অসীম সাহস আর আপোষহীন। আমার দেখা সৎ নিষ্ঠাবান ব্যক্তির মধ্যে মালেক পীর অন্যতম। কিশোর বয়সে ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের জীবনবাজি নিয়ে যে লোকটি যুদ্ধে অংগ্রহণ করেছিলো সেই লোকটি স্বাধীনতা পরবর্তী ৫০ বছর অনিয়ম আর অসতের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়েছেন। পাহাড় সমান শক্তির বিরুদ্ধে সঙ্গে কেউ থাকুক আর না থাকুক একাই লড়েছেন। অনিয়ম-নিয়ম করতে নিম্ন আদালত থেকে হাইকোর্ট কোথায় যাননি তিনি? কার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেননি? সরকারের দাপটে কর্মকর্তা, ডিসি বলি আর এসপি বলি এমনকি জজ। নিশ্চিত আগুন জেনেও ঝাঁপ দিয়েছেন। কথা বলেছেন সত্যের পক্ষে। ক্ষমতাধর শক্তির বিরুদ্ধে লড়েছেন, লেগে থেকেছেন। কেউ কেউ তাঁর প্রসংশা করে বলতেন 'বাঘে ধরলে ছাড়ে, মালেক পীরে ধরলে ছাড়ে না'।


সত্যি বলছি, এমন অসাধারণ ব্যক্তি'র সান্নিধ্য পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। হাওর ডুবির পর গেল চার বছর সাংগঠনিক সম্পর্ক ছিলো মালেক হোসেন পীর চাচা'র সাথে। হাওর দুর্নীতির বিরুদ্ধে গড়ে উঠা হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সাংগঠনিক কার্যক্রম, কর্মসূচি বাস্তবায়ন, বিভিন্ন আন্দোলনে যার সক্রিয় অবস্থান ছিলো। হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ তদারকিতে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা মালেক হোসেন পীর চষে বেড়িয়েছেন।

গেল দুই বছর ধরে তিনি লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত ছিলেন। মরণব্যাধি এই রোগ নিয়ে এই অদ্যম মানুষটি সকল অনিয়ম দুর্নীতিতে সোচ্চার ছিলেন। চলতি বছরের এপ্রিলের দিকে দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের একটি বাঁধের কাজের অনিয়মের নিউজ করেছিলাম। বাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে কাজটি ফেইসবুক লাইভে তুলে ধরে ছিলাম। মাস চারেক আগে মালেক চাচা অফিসে আসলেন। কাছে এসে সুন্দরভাবে বললেন, বাবাজি ভিডিওটা আমারে দিবায়নি। মামলার করবো। সব কাগজপত্র রেডি। ভিডিও দিলে সিডি করে আনতাম।

বললাম চাচা, প্রোফাইলে ডুকে ডাউনলোড দিতে হবে। ভিডিও নামিয়ে আপনারে ফোন দিব। নাছোড়বান্দা চাচা ভিডিও উদ্ধারের জন্যে একেক ফোন। কয়েক তারিখ করার পর মালেক চাচাকে বাঁধটির ভিডিও দিলাম।
নিজের খেয়ে পরের মহিষ তাড়ানো প্রবাদ শুনেছি মুক্তিযোদ্ধা মালেক হোসেন পীর ছিলেন এর জলজ্যান্ত প্রমাণ। প্রতি মাসে যে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেতেন তার বেশিরভাগ ব্যায় করতে বিভিন্ন অভিযোগ ও আবেদনের জন্য, নিজের টাকা খরচ করে সিলেট, ঢাকার বিভিন্ন অফিস আদালতে ছুটে বেড়াতেন।
এসব ব্যয় নির্বাহ করতে অনেক জায়গায় জমি বিক্রি করতে হয়েছে। এতো কিছুর পরও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে পচন্দ করতেন তিনি। পরিবার, গোষ্ঠী, বন্ধুমহলে নিরুৎসাহ পেলেও হার ছাড়েননি। একাই লড়ছেন নিশ্চিত পরাজয় জেনেও।

জীবন সংগ্রামে লড়াকু এই বীরের প্রস্তান। বড় অসময়ে চলে গেলেন। যেই সময়টাতে নীতি নৈতিকতার বড়ই আকাল। ক্ষমতাকে নমস্য জানানোর লোকের অভাব নেই। এমন একজন সংগ্রামী বীরের মহা প্রস্তানে অপূরনীয় ক্ষতি হলো। যে ক্ষতি পুষিয়ে উঠা সম্ভব নয়।

আদর্শিক পুরুষ মালেক হোসেন পীরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। সাহসের বাতিঘরের স্মরণে নতজানু হয়ে কুর্নিশ করি বারংবার। তিনি বেঁচে রবেন সকল প্রতিবাদে। সকল আন্দোলন সংগ্রামে।
লেখ-সাংবাদিক ও সংগঠক।

লেখক- সাংবাদিক