শরতের নীল আকাশে অরুণ আলোর অঞ্জলিতে বাংলার স্নিগ্ধ বাতাসে ভেসে আসে জগজ্জননী আনন্দময়ী মা দুর্গার আগমনী বার্তা। মা আনন্দময়ীর আগমন বার্তায় চারিদিক তখন আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। মা’র আগমন বার্তায় মধুর কলধ্বনিতে স্ফুরিত হয়ে ওঠে মহালয়ার পূণ্যতিথি।

মহালয়া তিথিতে সুদূর প্রান্ত থেকে ভোরের বাতাসে ভেসে আসে চণ্ডী পাঠের সুরেলা সুমধুর ধ্বনি। তাতে সকলেরই প্রাণ এক নবপ্রাণচাঞ্চল্যতায় ভরে ওঠে। তখন আকাশে বাতাসে যেন একটা সাজ সাজ রব বইতে থাকে। দেবী পূজার প্রারম্ভিক প্রস্তুতিই হলো এই মহালয়া।


সনাতন ধর্মের বহুবিদ তত্ত্বের মধ্যে মহালয়া একটি সুগভীর যোগতাত্ত্বিক দর্শন। দেবীশক্তিকে আপন সত্তায় সঞ্চার করার জন্য যোগসাধনার এক গুহ্যবার্তা এই মহালয়া তত্ত্বে রয়েছে। সনাতন ধর্মে যোগসাধনার দ্ইুটি দিক রয়েছে- একটি তার আনুষ্ঠানিক দিক এবং অপরটি তার তাত্ত্বিক দর্শন। তত্ত্বের প্রকাশ ঘটে অনুষ্ঠানে আর অনুষ্ঠানের পূর্ণতা পায়- যদি তত্ত্বটিকে উপলদ্ধি করে হৃদয়ে ধারণ করা যায়। প্রথমেই প্রশ্ন আসে মহালয়া কি? সাধারণত মহালয়া বলতে আমরা বুঝি- অমাবস্যা তিথিতে মহাদেবী মর্ত্যধামে অবতীর্ণ হওয়ার মহান বার্তা। শাস্ত্র অনুসারে কয়েকটি পূর্ণিমা স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে থাকে। যেমন- বৈশাখি পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমা, গুরু পূর্ণিমা, রাস পূর্ণিমা, লক্ষ্মী পূর্ণিমা, মধু পূর্ণিমা ইত্যাদি। সেইরূপভাবে সৌর বৎসরে দ্বাদশটি অমাবস্যাও রয়েছে। এই অমাবস্যাগুলির মধ্যে তিনটি অমাবস্যা স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে থাকে। (১) আলোক অমাবস্যা (২) মহালয়া অমাবস্যা (৩) দ্বীপান্বিতা অমাবস্যা। ভাদ্র মাসের অমাবস্যাকে বলা হয়- আলোক অমাবস্যা, আশ্বিন মাসের অমাবস্যাকে বলা হয়- মহালয়া অমাবস্যা আর কার্তিক মাসের অমাবস্যাকে বলা হয়- দ্বিপান্বিতা অমাবস্যা। অমাবস্যা কি? অমাবস্যা বলতে চন্দ্রের আলোকহীন তিথিই হলো অমাবস্যা। তিথি হলো চন্দ্রকলার হ্রাস-বৃদ্ধির দ্বারা সীমাবদ্ধ কাল।

আমরা সবাই জানি পনের দিনে এক পক্ষ হয়। প্রতি মাসেই দুইটি পক্ষ থাকে। একটি শুক্লপক্ষ অপরটি কৃষ্ণপক্ষ। চন্দ্র ষোল কলায় বিভক্ত থাকে। চন্দ্র এক এক কলায় হ্রাস পায় এবং এক এক কলায় বৃদ্ধি পায়। যে পক্ষে চন্দ্র হ্রাস পায় তাকে বলা হয় কৃষ্ণপক্ষ আর যে পক্ষে চন্দ্র বৃদ্ধি পায় তাকে বলা হয় শুক্লপক্ষ। শুক্লপক্ষের শেষ তিথি হলো- পূর্ণিমা আর কৃষ্ণপক্ষের শেষ তিথি হলো- অমাবস্যা। আশ্বিন মাসের অমাবস্যা হলো- মহালয়া অমাবস্যা। মহালয়া মানে কি? মহালয়া শব্দটিকে ভেঙ্গে বললে এই দাঁড়ায়- মহা+আলয়=মহালয়। আর তাতে আকার যোগ করে স্ত্রীলিঙ্গে করা হয়েছে। মহার আলয়ই হলো- মহালয়। মহা শব্দের অর্থ হলো- মহৎ বা মহান, আর আলয় শব্দের অর্থ হলো- গৃহ বা বাসস্থান। যেখানে মহতের আলয় বা বাসস্থান তাই মহালয়। মহৎ বলতে অপর পক্ষকে বলা হয়। যাঁরা অপর হয়ে গেছেন অর্থাৎ প্রয়াত হয়েছেন তাঁদেরকেই অপর পক্ষ বলা হয়। পিতৃপুরুষদেরকেই অপরপক্ষ বলা হয়। এইজন্যই মহালয়া তিথিতে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণাদিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠাদি করা হয়।

অন্যদিকে সংস্কৃতে বলা হয়- মহপূজায়াম মহ উৎসবে। মহ শব্দের একটি মানে হলো- পূজা, অন্যটি হলো- উৎসব। পূজা এবং উৎসব মিলেই মহালয়া। আবার বলা হয়-‘মহালয়ঃ মহতাং যোগিপ্রভৃতীনাম্ আলয়ঃ।’ মহাযোগীদের সাধনার যোগ্য সময় মহালয়া। মহান ব্যক্তিবর্গের পিতৃপূজা এবং শক্তিসাধনার প্রকৃষ্ট কাল এই মহালয়া তিথি। প্রকৃত অর্থে পিতৃপক্ষ এবং দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণই হলো মহালয়া। পিতৃপূজার দ্বারাই দেবীপূজার অধিকার অর্জন করতে হয়। মহালয়া ক্ষণই যোগসাধনার প্রকৃষ্ট সময়। চন্দ্র কলার ক্ষয় হতে হতে যেমন অমাবস্যা হয়, ঠিক তেমনিভাবে যোগসাধনার দ্বারা মনে চঞ্চলতাকে ক্ষয় করে যোগসাধনার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। চন্দ্রের যেমন হ্রাস-বৃদ্ধি হয় তেমনিভাবে মনের চঞ্চলতারও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। চঞ্চলতার ক্ষীণতা হতে হতে সর্বশেষে মনের ক্রিয়াহীনতাই যোগীর সাধনার জন্য সহায়ক হয়ে ওঠে। চন্দ্রের হ্রাস হতে হতে শেষে তার আর আলোক থাকে না। তখন তার আর পরিমাপ করা যায় না। ‘অমা’ শব্দের অর্থই হলো- যা আর পরিমাপ করা যায় না। চন্দ্রের ক্ষয় হতে হতে চন্দ্র কিরণ আর থাকে না। সেইরূপ সাধকের মনের চঞ্চলতা ক্ষয় হতে হতে সর্বশেষ স্তরে সাধকের মন আর মন থাকে না। সাধকদের সাধন অবস্থায় মন ক্ষয় হতে হতে ‘অমা’ অবস্থায় এসে যায়। এই অবস্থায় উপনীত হওয়াই পরিমাপ বিহীন অনন্ত অসীম এক অবস্থায় সাধকের অবস্থান। এই অবস্থায় উন্নীত হওয়াই অমাবস্যা অবস্থা। এই অবস্থায় সাধকের মন সর্বশেষ স্তরে এসে পৌঁছায়। এই অবস্থায় সাধকের সাধনপ্রক্রিয়া পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হয়। সাধনের পূর্ণতা লাভ হলে নিজের মধ্যে যে সুপ্ত শক্তি রয়েছে তা জাগ্রত করে সাধক নিজের আয়ত্বে আনতে পারেন। এই শক্তি অর্জন করে সাধক অধ্যাত্মজীবন লাভ করে থাকেন। তখন সাধক সাধন করতে করতে কুটস্থে ব্রহ্মজ্যোতি দর্শন করে থাকেন। যোগারূঢ় সাধকই কুটস্থে অবস্থান করে ব্রহ্মজ্যোতি দর্শন করে থাকেন।

কুটস্থে অবস্থান বলতে আমরা কি বুঝি? যোগারূঢ় সাধকের কথা জানাতে গিয়ে গীতায় ভগবান বলেছেন-
জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ।
যুক্ত ইত্যুচ্যতে যোগী সমলোষ্টাশ্মকাঞ্চনঃ ॥ গীতা ৬/৮
অর্থাৎ- যাঁর হৃদয় জ্ঞান এবং বিজ্ঞানলাভে পরিতৃপ্ত এবং অবিচলিত, যিনি জিতেন্দ্রিয় এবং যাঁর কাছে মাটি, পাথর এবং সোনার মূল্য সমান, সেই যোগীকেই যোগারূঢ় বলা হয়।

এখানে বলা হয়েছে যে, যোগারূঢ় সাধক কুটস্থে অবস্থান করেন। কুটস্থ শব্দটি খুবই ব্যঞ্জনাপূর্ণ। অধ্যাত্ম সাধকের পক্ষে এইটি একটি বীজ মন্ত্র স্বরূপ। গীতা অক্ষর পুরুষকেই কুটস্থ বলে অভিহিত করেছেন। ভগবান নিজেকে দুইটি নিগুঢ় ভাব ও তত্ত্বে জগতে অভিব্যক্ত করেছেন। একটি ভাব তিনি এই পরিবর্তনশীল জগতের সব কিছুই হয়েছেন, যা ক্ষর সর্বাণি ভূতানি, আর অপর ভাবে তিনি সবার উর্দ্ধে শাশ্বত ও অচলতায় অক্ষর হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন। ভগবানের এই ভাবটি বুঝাতেই গীতা কুটস্থ বিশেষণটি ব্যবহার করেছেন। গুণাতীতের অবস্থাই কুটস্থ অবস্থা। সাধকের গুণাতীতের অবস্থায় সাধক তিনি একটি উর্দ্ধতর চৈতেন্যের আলোকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে থাকেন। যিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানে তৃপ্ত থাকেন অর্থাৎ- যিনি সব কিছুতেই অবিচলতি থকেন তিনিই কুটস্থে অবস্থান করেন। সাধক যখন মূলাধার থেকে কুলকুণ্ডলিনীর শক্তিতে নিজেকে জাগ্রত করে ক্রমে ক্রমে মহাকুটস্থে প্রবেশ করেন তখন সেই কুলকুণ্ডলিনী শক্তি মহাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই মহাশক্তিই মা দুর্গার মহাশক্তি। এই শক্তি লাভ করেই সাধক মহিসাষুরকে বধ করার যোগ্যতা অর্জন করে থাকেন। অর্থাৎ সাধক তখন মহাদেবীর আশির্বাদ লাভ করে মহাদেবীর তেজরাশি লাভ করে মহিষাসুরকে বধ করার যোগ্যতা অর্জন করেন। মহালায়া একটি অতি পুণ্য তিথি। এই তিথিতেই সাধকেরা সাধনে প্রবৃত্ত হয়ে সিদ্ধি লাভ করে থাকেন। কেননা- এই তিথিতে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। এই তিথিতেই বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠান করে পূণ্যলাভের জন্য প্রকৃষ্ট সময়। এইসমস্ত ধর্মানুষ্ঠোনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে- সাধনপরায়ণ হয়ে মহতের আলয়ে প্রবেশ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। মহালয়ার পরের দিন থেকেই দেবী পক্ষ শুরু হয়। দুর্গাপূজা অসুর বধের পূজা। দেবীর কৃপায় যেন আমরা সবাই নিজেদের মধ্যে প্রাদুর্ভূত অসুরত্বকে বধ করতে পারি। আমাদের মধ্যে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ মাৎসর্য বিভিন্ন অসুর সব সময় বিরাজ করে। যিনি এই মহালয়াতে অর্থাৎ কুটস্থে প্রবেশ করতে পারেন তিনিই মহাদেবীর তেজরাশি লাভ করে এইসব অসুরদেরকে বধ করতে পারেন। দম্ভ, দর্প, অভিমান, ক্রোধ, পৌরুষ প্রভৃতি এইসব আমাদের আসুরী সম্পদ।

হৃদয়ের এইসব ভাব কাটিয়ে সত্য, অক্রোধ, ত্যাগ, শান্তি, দয়া, হ্রী প্রভৃতি সত্ত্বগুণান্বিত দৈবীসম্পদ অর্জন করতে হলে সঠিভাবে যোগসাধনা করেতে হয়। মহালয়া ও দুর্গাপূজার এই অধ্যাত্মিক তত্ত্বকে হৃদয়ে ধারণ করে অসুর শক্তির বিনাশের সাধন করাই হলো মহালয়া ও দুর্গাপূজার প্রকৃত সার্থকতা।

লেখক: কবি প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক।