হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী বস্তু থেকে বেঁচে থাক। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! সেগুলো কি?

তিনি বললেন- আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা, জাদু করা, বিনা কারণে কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, ইয়াতিমের মাল খাওয়া, জেহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা, সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ দেয়া।' (বুখারি)


আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে এ সাতটি পাপের বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করেছেন। এ থেকে বিরত থাকতে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। এসব কাজের মারাত্মক ও ভয়াবহ শাস্তির কথাও ঘোষণা করেছেন। কুরআনের নির্দেশগুলো হলো-

> আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা

ইসলামের প্রথম নির্দেশ হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক না করা। আল্লাহ তাআলা বান্দার শিরকের গোনাহ ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন-

إِنَّ اللّهَ لاَ يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَن يَشَاء وَمَن يُشْرِكْ بِاللّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا

‘‌‌‌নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে লোক তাঁর সঙ্গে (কাউকে) শরিক করে। তিনি ক্ষমা করেন এর নিম্ন পর্যায়ের পাপ; যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন। আর যে লোক আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করল, সে যেন অপবাদ আরোপ করল।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৪৮)

> জাদু করা

জাদু মারাত্মক অপরাধ। জাদুকরদের জন্য পরকালে কল্যাণের কোনো অংশ নেই। আর তা কুফরি কাজের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণে জাদুকর এবং জাদু করা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে দীর্ঘ বক্তব্য তুলে ধরেছেন-

وَاتَّبَعُواْ مَا تَتْلُواْ الشَّيَاطِينُ عَلَى مُلْكِ سُلَيْمَانَ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَـكِنَّ الشَّيْاطِينَ كَفَرُواْ يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ وَمَا أُنزِلَ عَلَى الْمَلَكَيْنِ بِبَابِلَ هَارُوتَ وَمَارُوتَ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّى يَقُولاَ إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلاَ تَكْفُرْ فَيَتَعَلَّمُونَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهِ وَمَا هُم بِضَآرِّينَ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلاَّ بِإِذْنِ اللّهِ وَيَتَعَلَّمُونَ مَا يَضُرُّهُمْ وَلاَ يَنفَعُهُمْ وَلَقَدْ عَلِمُواْ لَمَنِ اشْتَرَاهُ مَا لَهُ فِي الآخِرَةِ مِنْ خَلاَقٍ وَلَبِئْسَ مَا شَرَوْاْ بِهِ أَنفُسَهُمْ لَوْ كَانُواْ يَعْلَمُونَ

‘তারা ওই শাস্ত্র বা বিদ্যার অনুসরণ করল, যা (হজরত) সুলাইমানের রাজত্বকালে শয়তানরা আবৃত্তি করত। সুলাইমান কুফর করেনি; শয়তানরাই কুফর করেছিল। তারা মানুষকে জাদুবিদ্যা এবং বাবেল শহরে হারুত ও মারুত দুই ফেরেশতার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছিল, তা শেখাত।

(তবে) তারা (হারুত-মারুত) উভয়ই একথা না বলে কাউকে (জাদু) শেখাত না যে, আমরা পরীক্ষার জন্য; কাজেই তুমি কাফের হইও না।

অতপর তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যা দ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। তারা আল্লাহর আদেশ ছাড়া তাদ্বারা কারও অনিষ্ট করতে পারত না, যা তাদের ক্ষতি করে এবং উপকার না করে, তারা তাই শিখে।

তারা ভালোরূপে জানে- যে কেউ জাদু অবলম্বন করে, তার জন্য পরকালে কোনো অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা আত্মবিক্রয় করেছে, তা খুবই মন্দ যদি তারা জানত।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১০২)

> বিনা বিচারে হত্যা

হত্যা ইসলামে জঘন্য অপরাধ। কেননা মানুষ হত্যা মানবতা হত্যার শামিল। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘একজন মুমিন ততক্ষণ পর্যন্ত দ্বীনের ব্যাপারে পূর্ণ প্রশান্ত থাকে যে পর্যন্ত না সে অবৈধ হত্যায় লিপ্ত না হয়। (বুখারি, মিশকাত)

আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডকে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অনর্থক মানুষ হত্যাকে পুরো মানবজাতিকে হত্যার সঙ্গে শামিল করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

مِنْ أَجْلِ ذَلِكَ كَتَبْنَا عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنَّهُ مَن قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا وَلَقَدْ جَاءتْهُمْ رُسُلُنَا بِالبَيِّنَاتِ ثُمَّ إِنَّ كَثِيراً مِّنْهُم بَعْدَ ذَلِكَ فِي الأَرْضِ لَمُسْرِفُونَ

‘এ কারণেই আমি বনি ইসরাঈলের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন (দুনিয়ার) সব মানুষকেই হত্যা করে। এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে। তাদের কাছে আমার পয়গম্বরগণ প্রকাশ্য নিদর্শনাবলি নিয়ে এসেছেন। বস্তুত এরপরও তাদের অনেক লোক পৃথিবীতে সীমাতিক্রম করে।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ৩২)

> সুদ খাওয়া

সুদ খাওয়া হারাম ও কবিরা গোনাহ। ইসলামে মারাত্মক অপরাধ এটি। সুদের কার্যক্রম পরিহার না করাই হলো ইসলামের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। আল্লাহ তাআলা বলেন-

الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لاَ يَقُومُونَ إِلاَّ كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُواْ إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا وَأَحَلَّ اللّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا فَمَن جَاءهُ مَوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّهِ فَانتَهَىَ فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللّهِ وَمَنْ عَادَ فَأُوْلَـئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

‘যারা সুদ খায়, তারা কেয়ামতে সেভাবে দণ্ডায়মান হবে, যেভাবে দণ্ডায়মান হয় ওই ব্যক্তি, যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছে, ক্রয়-বিক্রয় তো সুদ নেয়ারই মতো! অথচ আল্লাহ তাআলা ক্রয়-বিক্রয় (ব্যবসাকে) বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, (বিধান আসারে) আগে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। যারা পুনরায় সুদ নেয়, তারাই জাহান্নামে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৭৫)

> ইয়াতিমের সম্পদ খাওয়া

আল্লাহ তাআলা ইয়াতিম ছেলেমেয়েদের প্রতি সঠিক আচরণের কথা বলেছেন। অসহায় ইয়াতিমের সম্পদ খাওয়ার ব্যাপারে কঠিন পরিণতির কথা তুলে ধরেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيرًا

যারা ইয়াতিমদের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করেছে এবং সত্তরই তারা অগ্নিতে প্রবেশ করবে।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১০)

> যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন

ইসলামে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজ। ইসলামে বিশ্বাসঘাতকতা হারাম বা কবিরাহ গোনাহ। কুরআনুল কারিমে এ কাজের শাস্তি জাহান্নাম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُواْ زَحْفاً فَلاَ تُوَلُّوهُمُ الأَدْبَارَ - وَمَن يُوَلِّهِمْ يَوْمَئِذٍ دُبُرَهُ إِلاَّ مُتَحَرِّفاً لِّقِتَالٍ أَوْ مُتَحَيِّزاً إِلَى فِئَةٍ فَقَدْ بَاء بِغَضَبٍ مِّنَ اللّهِ وَمَأْوَاهُ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ

‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা যখন কাফেরদের সাথে মুখোমুখি হবে, তখন পশ্চাৎপসরণ (পলায়ন) করবে না। আর যে লোক সেদিন তাদের থেকে পশ্চাৎপসরণ করবে (পালিয় যাবে), অবশ্য যে লড়াইয়ের কৌশল পরিবর্তনকল্পে কিংবা যে নিজ সৈন্যদের কাছে আশ্রয় নিতে আসে, সে ব্যতীত অন্যরা আল্লাহর গজব সঙ্গে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে। আর তার ঠিকানা হলো জাহান্নাম। বস্তুত সেটা হলো নিকৃষ্ট অবস্থান। (সুরা আনফাল : আয়াত ১৫-১৬)

> নারীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ

সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া ইসলামে হারাম বা কবিরা গোনাহ। দুনিয়াতে অপবাদের অপরাধ প্রমাণিত হলে রয়েছে কঠিন শাস্তির ঘোষণা। আর পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَالَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاء فَاجْلِدُوهُمْ ثَمَانِينَ جَلْدَةً وَلَا تَقْبَلُوا لَهُمْ شَهَادَةً أَبَدًا وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ - إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِن بَعْدِ ذَلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

‘যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অতপর স্বপক্ষে চারজন পুরুষ সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদের আশিটি বেত্রাঘাত করবে এবং কখনও (কোনো বিষয়ে) তাদের সাক্ষ্য কবুল করবে না। এরাই নাফারমান। কিন্তু যারা এরপর তওবা করে এবং সংশোধিত হয়, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম মেহেরবান।’ (সুরা নুর : আয়াত ৪-৫)

কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা এ অপরাধের বিধান ও শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন। কুরআনের এসব বিধানই প্রমাণ করে যে, এ থেকে বিরত থাকা কতটা জরুরি।

মুমিন মুসলমানের উচিত, যারা এ অপরাধে অপরাধী। শিগগির আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। তাওবাহ করে এ কাজে পুনরায় নিজেদের না জড়ানোর প্রতিজ্ঞাই মানুষকে এ পাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআনে বর্ণিত জঘন্য সাত অপরাধ থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। কুরআনের নির্দেশনা মেনে জীবন পরিচালনার তাওফিক দান করুন। আমিন।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/জিএসি-১৯


সূত্র : জাগো নিউজ