“আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল ধ্বনিতোল
জননী এসেছে দুয়ারে।”

শরৎ ঋতু মাতৃ আরাধনার ঋতু। বছর ঘুরে আবারও শারদ প্রাতে মা আসেন। মা আসেন ধনী-নির্ধন সবার মাঝে। সবাই চায় ষষ্ঠী হতে দশমী পর্যন্ত এই দিনগুলো আনন্দে কাটাতে। আনন্দময়ী মা এসেছেন সবার মানে আনন্দের বন্যা বয়িয়ে দিতে। সব জায়গায় ঢাকের তালে শাঁখের তালে ভক্তহৃদয়কুল আনন্দে নেচে উঠে। মা যে সবার, বিশ্বজুড়ে। সবার হৃদয়ের মণিকোঠায়। হৃদয়ের সকল ভালবাসা ঢেলে দেয়া হয় মায়ের শ্রীচরণে। যে মায়ের নামে এত মায়া মমতা যাঁর কারণে আমরা এই সংসার জীবনে আবদ্ধ তিনি হলেন আর কেউ নন আমাদের সবার পরমার্ধ্য মহাশক্তির অন্যতম শক্তি শ্রীশ্রীদুর্গাদেবী।


সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে দেবীদুর্গার আরাধনা চলছে যুগ হতে যুগান্তরে। সর্বত্রই ভিন্ন ভিন্ন নামে মা আমার পূজিতা। কাশ্মীর ও দক্ষিণাত্যে অম্বা ও আম্বিক্য নামে, গুজরাটে হিঙ্গুলা ও রুদ্রানী নামে, কুমারিকা প্রদেশে কন্যাকুমারী নামে পূঁজিতা। মায়ের আমরা বিভিন্ন রূপ দেখতে পাই। দেবীভাগবত, শ্রীশ্রী চণ্ডী দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে। কোথাও শাকম্ভরী। কোথাও কৃতান্তদালিনী, উগ্রচণ্ডা, উমা, অপরিজিতা আরো কত শত নামে। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে পাতঞ্জলি তাঁর রচিত মহাভাষ্যে দুর্গার নামের উল্লেখ আছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে রচিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে দুর্গার জয় ধারণা পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে রচিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে দুর্গাপূজার ধারণা পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ হতে ৩য় শতকের পূর্বে দুর্গাপূজা হয় এ কথা বলা যায় মহাভারতের সূত্র ধরে। সঠিকভাবে সাধারণ মূর্তিপূজার প্রচলন হয় পৌরাণিক যুগের কিছু পরে। দশভূজা দেবী দুর্গার কাঠামোতে দেখা যায় একই সাথে দেবীর ডান ধনদাত্রী ও এখনো বলা যায় না যে কবে হতে দুর্গাপূজার প্রচলন হয়। তবে এ বলা যায় যে, দুর্গাপ্রতিমা পূজার প্রচলন হয় খ্রিঃ পূর্ব যুগেই। এছাড়া প্রাচীন গ্রন্থ, পুরাণ, মহাকাব্যে রচয়িতারা দুর্গা আরাধনার কথা উল্লেখ করেছেন।

কাঠামো বা মূর্তি হিন্দুধর্মের একটি বিশেষভাবে স্থান করে নিয়েছেন। মূর্তি শব্দের আক্ষরিকভাবে অর্থ যা জানা যায় তা হলো বিকশিত, মূর্তমান, প্রস্ফুটিত। যাঁর ভেতর সারগর্ভ স্বরূপ জ্ঞান প্রস্ফুটিত হয়েছে তাই মূর্তি। যাঁর ভেতর সত্য, জ্ঞান, বিশ্বাস, নিহিত আছে, মূর্তি হচ্ছে ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তির প্রতীক। মূর্তির মাধ্যমে যে আচারানুষ্ঠান আছে তা ব্রহ্মজ্ঞান স্বরূপ, মূতল আধ্যাত্মিক সাধনার শীর্ষে পৌঁছাবার একমাত্র পথ হিসেবে মূর্তিকে ধরা হয়।

সর্বডানে অন্নদায়িনী মাতা লক্ষ্মীদেবী ও সর্বসিদ্ধিদাতা গণেশ, সর্ববায়ে বিদ্যাদায়িনী মাতা শ্বেতশুভ্র সরস্বতী ও দেবসেনাপতি কার্তিক। মঙ্গলের বাহক দেবাদিবের দেব বাবা ভোলানাথ (শিব) সর্বোপরি অধিষ্ঠিত। আর মহিষাসুর ষড় রিপুর প্রতীক। কৃষি ও শিল্পের প্রতীক নবপত্রিকা (কলাবৌ) নবপত্রিকা নয়টি গাছের চারা যা একসাথে সাদা অপরাজিতার লতা দিয়ে বাঁধতে হয়, প্রতিটি চারা গাছে এক একজন দেবদেবী বিরাজিত, কদলীতে (কলাগাছ) ব্রহ্মানী, কচুতে; কালিকা, হরিদ্রাতে দুর্গা, জয়ন্তীতে কার্তিকী, বেলে শিবা, দাড়িম্বে রক্তদন্তিকা, আশোকে শোকরহিতা, মানে চামুন্ডা, ধানে লক্ষ্মী।

আমরা জানি যে দেবী দুর্গা ত্রিগুণাত্মিকা। এগুলো হলো সত্ত্বঃ রজঃ তমঃ। দেবী দুর্গার এই প্রতিটি গুণ এসেছে বিষ্ণু, ব্রহ্মা ও শিবের তেজ হতে। দেবীর এসব গুণশক্তির উর্দ্ধে শক্তির প্রতীক। জীবকূলের বেশির ভাগই সব ঐ ত্রিগুণ শক্তিতে আক্রান্ত যা প্রকাশিত। সত্ত্বগুণের লোক সাত্ত্বিক পরম শান্তি ও সদা কল্যাণময় তবে এই গুণের লোকের বড়ই অভাব। রজঃগুণের প্রাণীকূল রাজসীক। সর্বাবস্থায় অহং শক্তির প্রকাশ করে থাকে। তমঃ গুণের জীবকূল নাচ, গুণ সম্বলিত। যে যে গুণের অধিকারী সে তাঁর গুণের শক্তির আরাধনা করে থাকেন। ত্রিগুণের উর্দ্ধে মায়ের কাছে কিছু চাওয়া আমাদের প্রধান সাধনা।

তেজঃপুঞ্জকে দিগস্তব্যাপী জ্বলন্ত পর্বতের মত অবস্থিত দেখলেন। কঠোর তপস্যায় রত মহর্ষি কাত্যায়নের আশ্রম ছিল সুউচ্চ হিমালয়ে যেখানে দুর্গাদেবী আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুদ্দশী তিথিতে আবির্ভূত হন। শুক্লা সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে মহর্ষি কাত্যায়ন দেবীকে পূজা করেন। দশমীতে দবী মহিষাসুরকে বধ করেন। সেই জন্য দেবীর অপর নাম কাত্যায়নী। পৌরাণিক ধারণা মতে দেবতাদের সৃষ্টি সূর্য হতে আর এজন্য দেবতাদের আমরা সৌর দেবতা বলে থাকি। শুধু দেবতা কেন সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের সকল পদার্থের জন্ম রহস্য সূর্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আবার চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা প্রভৃতি সৃষ্টির ইতিহাস নিহিত মহাশক্তিময়ী মহাপ্রকৃতিতে। আমরা সপ্তশতী শ্রীশ্রী চণ্ডিকা আমরা পাই মহাদার্শনিক প্রবর মহামুনি কপিলের সাংখ্যদর্শনে। দেবী দুর্গার সৃষ্টি ও দেবী সত্ত্বাও পরিচয় আমরা শ্রীশ্রী চণ্ডীতে পাই। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে শ্রীশ্রী চণ্ডিকা প্রকৃতপক্ষে মহাকালী, মহাসরস্বতী ও মহালক্ষ্মীর অভিন্ন মূর্তি। যাঁদের মহিমাই শ্রীশ্রী দুর্গা। সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডই মহাশক্তির প্রতীক এবং মহাশক্তিরূপিনী, সৃষ্টি পালন ও সংহারকারিণী।

মহামায়া শ্রীশ্রী দুর্গার সৃষ্টির রহস্যের পূর্বে “দুর্গা” শব্দটি একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। “দ” শব্দটি দৈত্যনাশক, “উ” কার বিঘ্ননাশক “রেফ” রোগঘ্ন “গ” কার পাপঘ্ন এবং “আ” কার ভয়শত্রুঘ্ন অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ভয় ও শত্রু হতে যিনি আমাদের রক্ষা করে তিনি দুর্গা। অথবা দুর্গ শব্দটি বিপত্তি বাচক “আ” নাশবাচক, যিনি বিপত্তারিণী তিনিই দুর্গা। স্কন্দপুরাণের মত জানা যায় যে শরণাগতদের পুত্র দুর্গাসুরকে বধ করে বিশ্বলোকে তিনি দুর্গা নামে পরিচিত হন।

সুদর্শন চক্র হতে অন্য চক্র তৈরী করে দেবীকে দিলেন। এইভাবে বরুণদের শঙ্খ, অগ্নিদেব শক্তি, পবনদেব বজ্র ও ঐরাবত নামের স্বর্গগজের ঘন্টা, যমদেব কালদন্ড, বরুণ একটি পাশ, ব্রহ্মা রুদ্রাক্ষমালা কমন্ডলু, কালাভিমানী দেবতা একটি খগড় ও একটি উজ্জ্বল ঢাল, ক্ষীর সমুদ্র একটি উৎজ্জল মুক্তাহার, চিরনূতন বস্ত্রযুগল, দিব্য চূড়ামণি, দুটি কুণ্ডল সহ অন্যান্য জিনিস দান করলেন। গিরিরাজ হিমালয় বাহনস্বরূপ একটি সিংহ ও বিবিধ রত্ন এবং কুবের সতত সুরাপূর্ণ একটি পাত্র দান করলেন তাঁকে। নাগরাজ বাসুকী দেবী কে মহামণি শোভিত একটি নাগহার প্রদান করলেন। এভাবে সকল দেবতাদের দ্বারা সজ্জিত দেবী দুর্গা প্রকাশিতা হলেন। মায়ের বাহন হলো সিংহ। এ সিংহ শব্দটি হিংস ধাতু হতে উৎপন্ন। রজোগুণের প্রতীক দুর্দমনীয় পশুশক্তি। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই এ পশুশক্তি বিরাজমান তেমনি সত্ত্ব ও তমোগুণও বিরাজমান। দেবীর এই সিংহ সম্পর্কে দেবীপুরাণে বলা হয়েছে যে, সিংহের গ্রীবাতে বিষ্ণু শিরে মহাদেব, ললাটে পার্বতী, বক্ষস্থলে দুর্গা, করগ্রন্থিতে কার্তিকেয়, পার্শ্বে নাগগণ, কর্ণদ্বয়ে আশ্বিনী কুমারদ্বয়, নয়নে যম ও যক্ষ। নিত্যশরণাগত পশুরাজ সিংহ দেবীর পদতলে। জীবনমাত্রেই রয়েছে পশুত্ব, তাই জীবন চায় পশুত্ব থেকে দেবত্বে উজ্জীবিত হতে আর এ জন্যই মাতৃচরণে ঐকান্তিক শরণাগতি। সর্বসত্ত্বময়ী দেবী মহামায়া অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তমোগুণের প্রতীক সিংহকে রেখেছেন স্বীয় নিয়ন্ত্রণে। জাতির রক্ষা ও কল্যাণে রজোগুণাত্বিকা শক্তির সাধনার প্রয়োজন কিন্তু সে শক্তিকে নীতি ও ধর্মের নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার।

আমাদের একেক জনের প্রতি একেক জনের মায়া আছে বলেই এতো প্রেম, এতো ভালবাসা। সর্বশেষে আসুন আমরা সকলে মিলে দেবীর কাছে প্রার্থনা করি যেমন সবাইকে নিয়ে আমরা যেন সুখে শান্তিতে বাস করতে পারি। যত শোক, দুঃখ আছে তা ভুলে আনন্দময়ীর আগমনে নতুনভাবে জীবনকে গড়ে তুলতে পারি। এই হিংস্রময় পৃথিবীতে এত হানাহানি ভুলে মায়ের কৃপায় জীবনকে গড়ে তুলতে পারি।

*লেখক: সুকান্ত গুপ্ত, সদস্য সচিব- শ্রুতি- সিলেট
যুগ্ম সদস্যসচিব, বাংলাদেশ আবৃত্তিশিল্পী সংসদ।