ছবি: এএফপি

তুলনা যদি হয় উত্তেজনায়, চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে, তাহলে ৭ বছর আগের সেই ম্যাচের সঙ্গে আজকের ম্যাচের কোনো তুলনাই হয় না! বোলাররা বল করেছেন, ব্যাটসম্যান রান নিয়েছেন, উইকেট পড়েছে...এসবের বাইরে পুরো ম্যাচে বলার মতো ঘটনা একটিই—দশম ওভারে আয়ারল্যান্ডের অলরাউন্ডার কার্টিস ক্যাম্ফারের টানা চার বলে চার উইকেট তুলে নেওয়া।

সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ওই ম্যাচের পর দুই দল ২০ ওভারের ক্রিকেটে আরও ৯ বার একে অন্যের বিপক্ষে খেলেছে। তাতে দুবার জিতেছে আয়ারল্যান্ড, একটি ম্যাচ হয়েছে পরিত্যক্ত। বাকি ৬টিতেই জিতেছে নেদারল্যান্ডস। বিশ্বকাপেও মুখোমুখি হয়েছে একবার, ২০১৬ সালে ধর্মশালায় ৬ ওভারে নেমে আসা সেই ম্যাচেও নেদারল্যান্ডসই জিতেছে।


আবুধাবিতে কাল সোমবার তাই বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডের ম্যাচে যখন নেদারল্যান্ডসের মুখোমুখি হয়েছিল আয়ারল্যান্ড, একটা জবাব দেওয়ার বাড়তি তাড়না হয়তো ছিলই! ফল? নেদারল্যান্ডসকে মাত্র ১০৬ রানে গুটিয়ে দিয়ে ম্যাচটা ৭ উইকেটে জিতে বিশ্বকাপে দারুণ শুরু করেছে আইরিশরা। ২৯ বল হাতে রেখে জেতায় রানরেটের হিসাবেও বেশ এগিয়ে থাকল আয়ারল্যান্ড।

আগের দুই বিশ্বকাপের হারের বদলা নেওয়ার প্রেরণা তো ছিলই, এবারের বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের জয়ের তাড়না বাড়িয়ে দিয়েছে সম্ভবত আইসিসির তালিকায় তাদের অবস্থানের বদলও। আগের দুই বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের কাছে হারে আয়ারল্যান্ডের আঁতে ঘা লেগেছিল এ কারণে যে তাদের তখন সহযোগী দেশগুলোর মধ্যে সেরা মনে করা হতো, নেদারল্যান্ডসের কাছে জোড়া হার সেই ধারণায় ধাক্কা দিয়ে গিয়েছিল।

এর মধ্যে সিলেটে ২০১৪ সালের হারটা তো টি-টোয়েন্টি ইতিহাসেই অবিস্মরণীয়। আগে ব্যাটিং করে সেদিন আয়ারল্যান্ড ৪ উইকেটে ১৮৯ রান করেছিল, রানরেটের কঠিন হিসাব মিলিয়ে সুপার টেনে যেতে সেদিন বিশাল এই লক্ষ্য ১৪ ওভার ২ বলের মধ্যেই পেরোতে হতো নেদারল্যান্ডসকে। ডাচরা সে লক্ষ্য পেরিয়ে যায় ১৩.৫ ওভারে, ৬ উইকেট হাতে রেখে! সে সময়ে দলের অধিনায়ক পিটার বোরেনের ১৫ বলে ৩১, তিনে নামা ওয়েসলি বারেসির ২২ বলে অপরাজিত ৪০ রানের পাশাপাশি পাঁচে নামা টম কুপারের ১৫ বলে ৪৫ রানের বিধ্বংসী ইনিংস নেদারল্যান্ডসকে জিততে সাহায্য করেছিল। তবে ওপেনার স্টেফান মাইবার্গের ২৩ বলে ৪ চার আর ৭ ছক্কায় ৬৩ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস সেদিন লিখে দেয় নেদারল্যান্ডসের রূপকথা।

সেই তুলনায় কালকের ম্যাচে বলার মতো ঘটনা শুধু ক্যাম্ফারের ওই চার বলই! ইনিংসের তৃতীয় বলেই দলীয় ১ রানে ওপেনার বেন কুপারকে হারানো নেদারল্যান্ডস পঞ্চম ওভারে দলীয় ২২ রানে হারায় বাস ডি লিডকেও। এরপর ওপেনার ম্যাক্স ও’ডাউডের সঙ্গে মিলে চারে নামা কলিন অ্যাকারম্যান যখন ২৯ রানের ছোট্ট একটা জুটিতে ইনিংস গড়ার চেষ্টা করছিলেন, ধাক্কা দিলেন ক্যাম্ফার। ধাক্কা না বলে আসলে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতই বলা যায়। দশম ওভারের দ্বিতীয় বলে অ্যাকারম্যানকে (১১) উইকেটের পেছনে ক্যাচ বানান, পরের বলে এলবিডব্লু রায়ান টেন ডেসকাট। পরের বলে আবার এলবিডব্লু, এবার শিকার স্কট এডওয়ার্ডস! হ্যাটট্রিক! আয়ারল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে প্রথম হ্যাটট্রিক করা বোলার!

কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। পরের বলে রোয়েলফ ফন ডার মারউইকে বোল্ডই করে দিলেন ক্যাম্ফার। চার বলে চার উইকেট! ডাবল হ্যাটট্রিকের এমন কীর্তি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দেখল এই প্রথমবার। বিশ্বকাপের বাইরে? টি-টোয়েন্টি ইতিহাসেই এমন কীর্তি দেখা গেছে এ নিয়ে মাত্র তিনবার। এর আগের দুজন—রশিদ খান (আয়ারল্যান্ডেরই বিপক্ষে ২০১৯ সালে) ও লাসিথ মালিঙ্গা (২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে)। নেদারল্যান্ডস অধিনায়ক পিটার সিলার ম্যাচ শেষে বলছিলেন, ‘ভুতুড়ে ওই ওভারটাই পুরো ম্যাচ বদলে দিয়েছে।’

সিলার সেটা না বললেও চলত। ওই চার বলের প্রভাবে ২ উইকেটে ৫১ থেকে এক ধাক্কায় ৬ উইকেটে ৫১ হয়ে যায় নেদারল্যান্ডস। ওপেনার ও’ডাউড তখনো ক্রিজে ছিলেন, শেষ পর্যন্ত ৪৭ বলে ৫১ রান করে সপ্তম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়েছেন দলকে ৮৮ রানে রেখে। ও’ডাউডের সঙ্গে সপ্তম উইকেটে ২২ রানের জুটি গড়া অধিনায়ক সিলার করেছেন ২৯ বলে ২২ রান—আয়ারল্যান্ডের ইনিংসে ২০ পেরোনো ব্যাটসম্যান এই দুজনই। কিন্তু ইনিংসের শেষ ওভারে আবার ধাক্কা খায় আয়ারল্যান্ড। চতুর্থ বলে সিলার অষ্টম ব্যাটসম্যান হিসেবে ফেরেন দলকে ১০৫ রানে রেখে, পরের বলে দুই রান নিতে গিয়ে রানআউট লোগান ফন বিক, এর পরের বলে আবার উইকেট! পুরো ২০ ওভার খেলেই অলআউট নেদারল্যান্ডস।

উইকেট তেমন ভয়ংকর কিছু নয়, ১০৭ রানের লক্ষ্যে নেমে আয়ারল্যান্ডের তাই ঝুঁকি তেমন বেশি ছিল না। ওপেনার পল স্টার্লিং নিশ্চিত করলেন, ওয়ানডে গতির ইনিংস হলেও অপরাজিত থেকেই দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়বেন। চতুর্থ ওভারে দলীয় ২৭ রানে ফিরেছেন অন্য ওপেনার কেভিন ও’ব্রায়েন (৯), পরের ওভারে স্কোরবোর্ডে ৩৬ রানের সময় ফিরেছেন অধিনায়ক অ্যান্ডি বলবার্নিও। চারে নামা গ্যারেথ ডেলানির সঙ্গে এরপর জুটি বাঁধেন স্টার্লিং।

ডেলানিকে চার-ছক্কা মারার ছাড়পত্র দিয়ে স্টার্লিং অন্য প্রান্তে ইনিংস সঞ্চালকের ভূমিকা নিয়েছেন। ২৯ বলে ৪৪ রান করেছেন ডেলানি, চার ৫টি, ছক্কা ২টি। অন্যদিকে স্টার্লিং ৩০ রান করেছেন ৩৯ বলে, চার-ছক্কা ১টি করে। ১৩তম ওভারে ডেলানি ফিরলেও আয়ারল্যান্ডের চিন্তার কিছু ছিল না, ততক্ষণে যে ৯৫ রান হয়ে গিয়েছিল! বল হাতে নায়ক বনে যাওয়া ক্যাম্ফারকে (৭*) নিয়ে বাকি পথটুকু পাড়ি দিতে ঝামেলা হয়নি স্টার্লিংয়ের।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে