বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির নেতৃত্বাধীন ‘২০ দলীয় জোট’ কেবল নামেই একটি রাজনৈতিক মোর্চা হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে সেখানে দল রয়েছে ১৪টি। এর মধ্যে এমন তিনটি দল রয়েছে যা এক ব্যক্তিনির্ভর। এছাড়া একটি দলের চেয়ারম্যান দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে অবস্থান করছেন।

জোটে প্রধান শরিক বিএনপিসহ দু-তিনটি দল ছাড়া বাকিদের কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই। শুধু তা-ই নয়, জোটের অনেক দলের রাজনৈতিক কার্যালয়ও নেই।


১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম ও ইসলামী ঐক্যজোটের তখনকার চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ঘোষণার ১২ বছর পর ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরবর্তীতে জোটে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও সাম্যবাদী দল যোগ দিলে তা ২০ দলীয় জোটে পরিণত হয়।

২০ দলীয় জোটের ছায়াতলে আসা দলগুলো হলো- বিএনপি, জামায়াত, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), কল্যাণ পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), লেবার পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ন্যাপ-ভাসানী, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, ডেমোক্রেটিক লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পিপলস লীগ, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ ও খেলাফত মজলিস।

২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। ওই বছরেই প্রথম ভাঙন ধরে জোটে। সেপ্টেম্বর মাসে প্রধান শরিক বিএনপির প্রতি ‘সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ’ এনে জোট ত্যাগ করে শেখ শওকত হোসেন নীলুর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)। যদিও ওই সময় দলটির মহাসচিব ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে একটি অংশ জোটে থেকে যায়।

২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি একই অভিযোগ তুলে বিএনপির সঙ্গে প্রায় দুই যুগের সম্পর্ক ছিন্ন করে জোট ত্যাগ করে ইসলামী ঐক্যজোট। এবারও দলটির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুর রকিবের নেতৃত্বে ছোট একটি অংশ জোটে থেকে যায়।

২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন নিয়ে ওই বছরের ১৬ অক্টোবর জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ) ও খন্দকার গোলাম মর্তুজার নেতৃত্বাধীন এনডিপি জোট থেকে বেরিয়ে যায়। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে (২০১৮ সাল) জোট ছাড়ে লেবার পার্টির মহাসচিব হামদুল্লাহ আল মেহেদীর নেতৃত্বে দলটির ছোট একটি অংশ।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়াকে কেন্দ্র করে ২০১৯ সালের ৬ মে জোট ত্যাগ করেন বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ। চলতি বছরের ১৪ জুলাই ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। সর্বশেষ ১ অক্টোবর জোট ত্যাগ করে খেলাফত মজলিস।

দল দুটি ‘নিষ্ক্রিয়তার’ অভিযোগ তুলে জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয়। সবমিলিয়ে ২০ দলীয় জোট গঠনের পর ছয়টি দল ও একটি দলের ছোট একটি অংশ জোট ছাড়ে। তারপরও জোটের নাম ‘২০ দলীয় জোট’ থেকে যায়।

এক ব্যক্তিনির্ভর তিন দল>>

২০ দলীয় জোটের মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোট, এনপিপি ও বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি মূলত এক ব্যক্তিনির্ভর দল। তাদের কার্যক্রম মূলত ২০ দলীয় জোটের কোনো বৈঠকে চেয়ারম্যানদের অংশ নেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর বাইরে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

ইসলামী ঐক্যজোটের রাজনৈতিক কোনো কার্যালয় নেই। দলের চেয়ারম্যান আব্দুর রকিব রাজনীতির চাইতে আইন পেশায় ব্যস্ত থাকেন বেশি। রাজনৈতিক কার্যালয় না থাকার বিষয়ে  আব্দুর রকিব বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব যে রাজনৈতিক কার্যালয় ছিল সেটি দখল হয়ে গেছে। এখন আমাদের কোনো কার্যালয় নেই। তবে, দলের ভাইস চেয়ারম্যানের বাসায় আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলে।’

নিজের অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে ইসলামিক পার্টির চেয়ারম্যান আবু তাহের চৌধুরী বলেন, ‘আমি নিজেও অসুস্থ। আর বর্তমান পরিস্থিতিসহ সবকিছু মিলিয়ে আমাদের দলের তেমন কার্যক্রম নেই, এটা অস্বীকার করারও কিছু নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন ২০ দলীয় জোটের কোনো কার্যক্রম নেই। অনেক দল জোট ছেড়ে চলে গেছে। জোট নিয়ে আমাদেরও কোনো ভাবনা নেই। আগামী কিছুদিনের মধ্যে আমরা নিজেরা বৈঠক করে ২০ দলীয় জোট নিয়ে কী করার, সেটি ঠিক করব।’

এক ব্যক্তিনির্ভর ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)। দলটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘করোনার কারণে আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এরপরও আমরা বিভিন্ন সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করেছি। এখন যেহেতু করোনার সংক্রমণ কমে এসেছে আমরা আবার সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করব।’

প্রবাসে দলের চেয়ারম্যান>>

২০ দলীয় জোটের শরিক সাম্যবাদী দল। দলটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাঈদ আহমেদ দীর্ঘদিন প্রবাসে আছেন। জানা গেছে, সাঈদ আহম্মদের নামে বেশকিছু মামলা রয়েছে। চার বছর আগে তাকে একবার গ্রেফতারও করে পুলিশ। পরে জামিনে বেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। আর দেশে ফেরেননি। ফলে দীর্ঘদিন দলটির সাংগঠনিক কোনো কার্যক্রম নেই। শুধু তা-ই নয়, এ দলের রাজনৈতিক কোনো কার্যালয়ও নেই।

সাঈদ আহম্মেদ যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার পর দলটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন আরিফুল ইসলাম সুমন। তিনি জানান, তিন বছরের বেশি সময় ধরে সাঈদ আহম্মেদ যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। এ কারণে তিনি ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

দলের কার্যালয় না থাকার বিষয়টি স্বীকার করে আরিফুল ইসলাম বলেন, সাম্যবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহার বাসাই এখন আমাদের কার্যালয়।

সভাপতি ছাড়াই চলছে মুসলিম লীগ>>

২০ দলীয় জোটের মধ্যে বিএনপিসহ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল আছে চারটি। এর মধ্যে একটি বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল)। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে সভাপতি ছাড়া চলছে দলটি। দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম। তাদের নিজস্ব কোনো কার্যালয়ও নেই। সদ্য প্রয়াত সভাপতির বাসার ঠিকানা ব্যবহার করে চলছে দলীয় কার্যক্রম।

দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব অ্যাডভোকেট শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী বলেন, গত বছরের ডিসেম্বরে দলের সভাপতি এ এইচ এম কামরুজ্জামান খান মারা যান। এরপর থেকে সভাপতি পদটি খালি আছে। কাউকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতিও করা হয়নি।

আগামী বছর (২০২২ সাল) দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরুর আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি আরও বলেন, এ বছর তো আর সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। আগামী বছর শুরু হবে। তখন সম্মেলন করে দলের সভাপতি নির্বাচিত করব।

প্রয়াত সভাপতি কামরুজ্জামান খানের বনানীর বাড়িতে মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন জুলফিকার চৌধুরী।

চলছে জামায়াত-বিএনপির টানাপোড়েন>>

বিএনপির সবচেয়ে পুরনো সঙ্গী স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী। তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। বিএনপির পক্ষ থেকে গত কয়েক বছর জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত সফলতা আসেনি। এ প্রসঙ্গে বিএনপির নেতারা বলেছেন, দলের স্থায়ী কমিটির তিন সদস্য, লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ এক নেতা এবং বিএনপিপন্থী সুশীল সমাজের একটি অংশের কারণে বারবার উদ্যোগ নিয়েও বিএনপি জামায়াতকে ছাড়তে পারছে না। যখনই জামায়াত ছাড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় তখনই তিন পক্ষ সক্রিয় হয়ে ওঠে। জামায়াতকে জোটে রাখার পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে তারা। যদিও গত মাসে দলের নির্বাহী কমিটির নেতাদের সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ধারাবাহিক বৈঠকেও জামায়াতকে ছেড়ে দিতে দলের নেতারা মতামত দিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, আমরা বারবার উদ্যোগ নিয়েছি। আগে জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে প্রধান বাধা ছিলেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কারণ, তার একক সিদ্ধান্তে জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধে বিএনপি। তিনি কারাগারে থাকাকালীন এ বিষয়ে তার মতামত নেওয়া সম্ভব ছিল না। গত বছর শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পাওয়ার পর জামায়াত ছাড়া নিয়ে তার বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তখন তিনি জানিয়ে দেন, জামায়াত নিয়ে তার কোনো অবস্থান নেই। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অন্যরা (দলের স্থায়ী কমিটির নেতারা) চাইলে জামায়াতকে ছেড়ে দিতে পারে। এরপর লন্ডনে অবস্থান করা তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ এক নেতা এবং দলের স্থায়ী কমিটির তিন নেতা ২০ দলীয় জোটে জামায়াতকে রাখতে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

তিনি আরও বলেন, জামায়াত ২০ দলীয় জোটের শরিক। বর্তমানে এ জোট নিষ্ক্রিয়। আগামী নির্বাচনের আগে এ জোট আর সক্রিয় হবে না। ফলে বিএনপি-জামায়াতের টানাপোড়েনের সম্পর্ক চলতেই থাকবে। আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা জামায়াতকে ছেড়ে না দিলেও এখন তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে


সূত্র : ঢাকাপোস্ট