সবধরনের ভেদাবেদ ও ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে পলিটিক্যাল নেতাদের সমন্বয়ে দ্বিধাবিভক্ত সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করে এককাতারে নিয়ে আসতে চান জেলা সভাপতি মতিউর রহমান।

তৃণমূল থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত সংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রচেষ্টা শুরু করেছেন তিনি। তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের কারণে জেলার সুষম উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ পিছিয়ে পড়ছে বলে মনে করেন তিনি।


সুনামগঞ্জ সদর ও শান্তিগঞ্জ উপজেলায় তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবির প্রেক্ষিতে এই প্রতিবেদকের সাথে এক একান্ত আলাপচারিতায় সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলার বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ মতিউর রহমান বলেন, ‘এক জীবনে আমি অনেক কিছু পেয়েছি। সংসদ সদস্য হয়েছি। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা জেলা আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পদে আমাকে বসিয়েছেন। আমার দলের নেতাকর্মীরাও আমাকে বার বার অভূতপূর্ব সম্মান দেখিয়েছেন। কিছুদিন আগে চিকিৎসার জন্য আমি যখন যুক্তরাষ্টে ছিলাম, তখন দলের প্রতিটি পর্যায়ের নেতাকর্মী আমার অনুপস্থিতির শূন্যতা অনুভব করেছেন। আমার যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসার খবর শোনে হাজারেরও উপরে নেতাকর্মী ঢাকায় এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করেন। এই দৃশ্য দেশে আশপাশের মানুষ অবাক হয়ে যান। পরে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ আসার পথে মুহিবুর রহমান মানিক আমার সম্মানে ১৭টি তোরণ নির্মাণ করেন। প্রতিটি গেটে অপেক্ষমান নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেই। জাউয়াবাজারে স্টেজ করে মিটিং শেষে আমাকে তাঁর নির্বাচনী এলাকা থেকে বিদায় দেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি দেশে ফেরার পর সুনামগঞ্জে আসলে স্মরণকালে বৃহৎ মোটর শোভাযাত্রার মাধ্যমে আমাকে বরণ করেছেন। একজন মানুষের জীবনে এর চাইতে আর কি-ই বা চাওয়ার থাকে। এই ভালবাসার প্রতিদান দেওয়ার মতো শক্তি-সামর্থ আমার নেই। তাদেরকে কোনো কিছু দিয়ে খুশি করার সামর্থ আমার নেই। তবে আমি চিন্তা করে দেখেছি, তাদেরকে আমার কিছু দিতে হলে প্রয়োজন সরকারের সহযোগিতা। আমি যেহেতু জনপ্রতিনিধি নই, তাই প্রতিনিধি সভায় তাদের পক্ষে কোনও কথা বলতে পারছি না। আমাদের যারা প্রতিনিধি রয়েছেন, তাদের মাধ্যমে আমাকে জনগণের কথা বলতে হয়। কিন্তু অনেক বিষয়ে বলার পরও কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্ধারণের আন্দোলনের সময় আমাদের সংসদ সদস্যগণের সহযোগিতা নিয়ে নেত্রীর সম্মতিতে সুনামগঞ্জ সদরে স্থান নির্বাচন করেছি। কিন্তু এখন পর্যান্ত ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে আমি খুব হতাশার মধ্যে আছি। এখন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’

মতিউর রহমান বলেন, ‘আমি আজ দলের যে পরিস্থিতি দেখছি, দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ সুনামগঞ্জ সদর আসন আওয়ামী লীগের হাতছাড়া। এখানে যারা আওয়ামী লীগ করে, তারা নিরুপায়। তারা অসহায়ত্বের মধ্যে আছে। একইভাবে জগন্নাথপুরের মানুষ আমাকে বরণ করতে এসে জানিয়েছেন, তাদের ওখানে কিছুই হয়নি। কারো কাছে কথা বলার, সুখ-দুঃখের কথা জানানোর সুযোগ নেই তাদের। আমাদের মন্ত্রী সাহেব আছেন, কিন্তু তাঁর কাছে তারা কথা বলতে পারে না। আমরাও জানি না, তিনি কখন কোন তালে থাকেন। নেতাদের কাছে বললেও তারা অপারগতা প্রকাশ করেন। মানুষের অসহায় অবস্থা দেখে আমি আজ মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছি। উনি দল না করেও রাজনীতি করছেন। উনি ভিন্ন জায়গায় গিয়েও দলের বিরুদ্ধে কথা বলেন। এমনিক আমার বাড়ি দিরাইয়ে গিয়েও বিএনপির একজনকে ক্যান্ডিডেট বানিয়ে আমার প্রতিদ্বন্দ্বি, প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন। উনার এই অপচেষ্টাতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উনাকে প্রতিহত করার জন্য আমার হাতে আর কিছুই নাই। কারণ সংসদে গিয়ে বলার ক্ষমতা আমার নাই। তাই এই অবস্থাতে আমি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সার্বিক সহযোগিতা চাই, যার প্রচেষ্টায় আমরা মধ্য আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশে পরিণত হতে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের উন্নয়নটা কোথায় যেন বাধগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ- অন্য সবখানে চালু হয়ে গেলেও আমাদের এখানে হয় নাই। সদরের ২৫০ শয্যার হাসপাতাল বাদ দিয়ে উনার গ্রামের বাড়ির ৫০ শয্যার হাসপাতালে মেডিকেল ছাত্রদের ভর্তি করা হচ্ছে। কেউ উনি ওখানে নিলেন, মতলবটা বুঝতে পারছি না। তবে উনি কি চান সেটি সেখেনেই নিয়ে যেতে? একারণে আমি খুবই হতাশাগ্রস্ত।’

মতিউর রহমান আরো বলেন, ‘সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদরে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। আমরা হিসাব করে দেখেছি, আওয়ামী লীগের ভোট গতবার থেকে এবার বেড়েছে। কিন্তু প্রার্থী পাস করতে পারে নাই বিচ্ছিন্ন অবস্থা থাকায়। আমরা একত্র করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু মানুষ হতাশ। সদরে আমাদের এমপি না থাকায় আমাদের নেতাকর্মীরা কিছুই পায় না। টিআর কাবিখা পর্যন্ত পায় না। এখানে সংখ্যাগুরু মানুষ আওয়ামী লীগ। আমি সংসদ সদস্য থাকাকালে অনেক উন্নয়ন করেছিলাম। মানুষ আমাকে বলে, আপনি এখানে আসেন, আমরা সমবণ্টন চাই। কিন্তু আঞ্চলিক উন্নয়নের কারণে মন্ত্রী সাহেবের নিজস্ব এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও কোনও উন্নয়ন হয়নি।’

তিনি বলেন, একাত্তরের পরাজিত শত্রুপক্ষ সুবিধা আদায়ের জন্য এককালে আমাদের দলে এসেছে। আমাদের সাথে ভিড়েছে। আমরাও বিএনপিকে ঠেকাতে গিয়ে তাদের সহযোগিতা নিয়েছি। এখন দেখছি, ওরা এসে আমাদেরকে কন্ট্রোল করা শুরু করে দিয়েছে। এখন আমরা অসহায়। এমন পরিস্থিতিতে আমি নেত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

মতিউর রহমান আরো বলেন, জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমার একটাই লক্ষ্য, জেলা আওয়ামী লীগকে এক করা। সাবাইকে এককাতারে নিয়ে এসে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দলকে শক্তিশালী করা। অতীতেও আমি দলকে ঐক্যবদ্ধ করেছি। এবারো করতে পারব। এক্ষেত্রে আমার কেবল সকলের সহযোগিতা দরকার। আমার নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করে আমাকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি তাঁর আশা ও প্রত্যাশা রাখতে সবসময় সচেষ্ট ছিলাম। এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকব।’

তিনি বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগে প্রয়োজন রাজনৈতিক মানুষ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এখানে কিছু অরাজনৈতিক মানুষ এসে ঢুকে গেছে। তাঁদের সরকারের স্বার্থে আনা হয়েছে হয়তো, কিন্তু দলের স্বার্থে না। তাঁদের কাছে আমাদের প্রত্যাশ এটাই থাকবে, তারা যেন দলকে ডিস্টার্ব না করেন। দলের বিপরীতে অবস্থান না নেন।’

সবশেষে মতিউর রহমান বলেন, ‘সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগ খুবই শক্তিশালী। অতীতে যেমন ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও যেন থাকে এই চেষ্টা আমি করে যাব। আমি চাই নেত্রীর সহযোগিতা। আমি চাই সুনামগঞ্জে নেত্রীর উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকুক। কিন্তু সুনামগঞ্জে সার্বিক উন্নয়ন হচ্ছে না। জেলা ভিত্তিক সুষম উন্নয়ন হচ্ছে না, হচ্ছে অঞ্চলভিত্তিক। এটা বন্ধ করতে হবে। তা নাহলে আমাদের ঐক্য টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। ঐক্যের ফল আমরা পাবো না। সুষম উন্নয়ন ঐক্যকে মজবুত করে। কিন্তু এর ব্যাত্যয় ঘটলে ঐক্যে ফাঁটল দেখা দেয়।’


সিলেটভিউ২৪ডটকম / শহীদনূর / ডি.আর