ইংরেজিতে থ্যাংকলেস জব বলে একটি কথা রয়েছে। অর্থাৎ এখানে যতই ভালো করেন না কেনো ধন্যবাদের চেয়ে তিরস্কারই বেশি পাবেন। আর সেরকমই একটি পেশা হচ্ছে ক্রিকেট আম্পায়ারিং। মফস্বলে এটাকে পেশা না বলে নেশা বলাই উত্তম। কারণ এখানে এটাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার তেমন কোন সুযোগ নেই।

যারা আম্পায়ারিংয়ের সাথে যুক্ত হন বা থাকেন সেটা নেশা বা ক্রিকেটর প্রতি ভালোবাসা থেকেই হয়। কিন্তু এরপরও যারা এটাকে নেশা এবং পেশার চেয়ে বেশি মূল্যায়ন করেছেন তিনি হলেন সিলেটের কিংবদন্তী আম্পায়ার আশরাফ হোসেন আরমান।


যিনি দীর্ঘদিন ধরে কঠিন এই পেশাটাকে তার সহজাত প্রতিভা দিয়ে খুব সাবলিল ভাবে আকড়ে ধরে রেখেছিলেন। অবশেষে সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন এই লিজেন্ডারি আম্পায়ার। চলতি সিলেট প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগের প্রথম ম্যাচ দিয়ে তিনি নিজের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টেনেছেন স্মরণীয় ভাবে। স্মরণীয় বলছি এই কারণে, বিদায় বিষাদের হলেও সহকর্মীরা সেটিয়ে রাঙিয়ে তুলেছিলেন নানাভাবে। মাঠ থেকে তাকে যেভাবে বিদায় জানানো হয়েছে সেটা অনেক জাতীয় আম্পায়ারের বেলায় ঘটেছে কি না আমার জানা নেই। সেক্ষেত্রে সৌভাগ্যবান বলতে হবে তাকে। যদিও সময়ের আগে অবসর গ্রহণটা অনেকে মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু বাস্তবতা মেনে সিনিয়র-জুনিয়র মিলে সকল আম্পায়ারদের অশ্রুসিক্ত নয়ন বলে দিয়েছে যে সকল আম্পায়ারদের কতটুকু প্রিয় ছিলেন তিনি। সেটা হয়তো আশরাফ আরমান নিজেও কোন দিন কল্পনা করেননি, যেটা বিদায় বেলায় উপলব্দি করেছেন।

সিলেটের আম্পায়ারিংরের ইতিহাস লিখতে গেলে সিনিয়র অনেকের নামই আলোচনায় আসবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যদি সেটা লেখা হয় সেক্ষেত্রে একটাই নাম আসতো আশরাফ আরমান। কারণ বিগ ম্যাচ মানেই বল ও বেলস হাতে অপরিহার্য ব্যক্তি আশরাফ আরমান। কোন টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ মানেও ছিল তার সরব উপস্থিতি। ক্রিকেটের কোন আইন কানুন কিংবা জটিল সমস্যার জন্য যাকে সমাধানের জন্য চিন্তা করা হত সেই নামটাও ছিল তার। ক্রিকেটের বাইবেল বললেও কোন অংশে ভুল বলা হবে না এই কারণে, অর্থাৎ স্থানীয়ভাবে যারা যুক্ত আছেন তাদের মধ্যে কেবল তিনিই ছিলেন জ্ঞানগরিমায় সমৃদ্ধ। প্রতিনিয়ত ক্রিকেট আইন নিয়ে ঘাটাঘাটির পাশাপাশি আপডেট থাকার চেষ্টা করতেন। ফলে নিমিষেই ক্রিকেটীয় সমস্যার সহজ সমাধানে সিদ্ধহস্ত ছিলেন একমাত্র আশরাফ আরমান। সিলেটে জন্ম না নিয়ে কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে আম্পায়ারিং না করে যদি জাতীয় পর্যায়ে করতেন তাহলে অনেক দূর যাওয়ার যোগ্যতা ছিলো এটা নির্দিদ্বায় বলতে পারি। কিন্তু সঙ্গত কারণে সেই সুযোগটি পাননি তিনি। যেহেতু আমাদের দেশে বরাবর মফস্বল অবহেলিত, তার যাতাকলে পিষ্ট হতে হয়েছে আশরাফ আরমানের মতো প্রতিভাকেও।

মাত্র ২২ কিংবা ২৩ বছর বয়সে ১৯৯৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট লীগ দিয়ে আম্পায়ারিংয়ে অভিষেক হয় আশরাফ আরমানের। সিলেট পুলিশ লাইন মাঠে মুনলাইট স্পোটিং ক্লাব (বর্তমান ইয়ং প্যাগাসাস ক্লাব) বনাম ওয়ান্ডার্স ক্লাবের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে যাত্রা শুরু হয় এই পেশায়। সে ম্যাচে তার সহযোগি ছিলেন আরেক স্বনামধন্য আম্পায়ার গুলজার হোসেন খোকন। এরপর ১৯৯৬ সালে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে অভিষেক হয় ব্লু নবাগত বনাম ইয়ুথ সেন্টারের ম্যাচ দিয়ে। সে ম্যাচে সহযোগি ছিলেন প্রয়াত আম্পায়ার জালাল উদ্দিন। সেই যে যাত্রা শুরু এরপর দীর্ঘ ২৭ বছরের ক্যারিয়ারে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অসংখ্যা ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছেন।

১৯৯৮ সাল থেকে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে আম্পায়ারিং করেন তিনি। দায়িত্ব পালন করেছেন জাতীয় লীগের রিজার্ভ আম্পায়ার হিসেবে। পরিচালনা করেছেন বিদেশী দলের ম্যাচও। বাংলাদেশ সফররত শ্রীলন্কা, ইংল্যান্ড ও নেপাল অনুর্ধ্ব ১৯ দলের ম্যাচের পাশাপাশি কলকাতা দলের ম্যাচেও আম্পায়ারিং করেছেন আশরাফ আরমান।

পেশাদারি জীবনে এ গ্রেড প্রাপ্ত আম্পায়ার আশরাফ আরমান শুধু যে মাঠের ভেতরে খেলা পরিচালনায় দক্ষ ছিলেন তা কিন্তু নয়। মাঠের বাইরে সংগঠক হিসেবেও রয়েছে তার খ্যাতি। ২০০৪ সাল থেকে দীর্ঘদিন সিলেট আম্পায়ার এন্ড স্কোরার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এছাড়া ২০১৩ সাল থেকে দু’দফা প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সিলেট বিভাগীয় আম্পায়ার এন্ড স্কোরার এসোসিয়েশনের। সবমিলিয়ে বলা যায় সিলেটে আম্পায়ার ও স্কোরারদের যে সাংগঠনিক ভিত রচিত হয়েছে তার পেছনেও বড় অবদান আশরাফ আরমানের।

আম্পায়ারিংয়ের সাথে খুব কম বয়সে যুক্ত হওয়ার কারণে নিজের খেলোয়াড়ি জীবন দীর্ঘায়িত করতে পারেননি আশরাফ আরমান। ইলেভেন স্টার্স ও স্টার ইউনাইটেডের হয়ে খেলেছেন সিলেট প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট লীগে। কিন্তু খুব কম বয়সে আম্পায়ারিংয়ের সাথে যুক্ত হওয়ার কারণে খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানতে হয়েছে স্বল্প সময়ে।

আমাদের দেশে খেলা হিসেবে ক্রিকেট নিয়ে যতটা না মাতামাতি হয় এর সিকি ভাগও এর সাথে সংশ্রিষ্ট আম্পায়ারদের নিয়ে হয় না। যদি হতো তাহলে অবশ্যই পাদ প্রদীপের আলোয় আসতেন আশরাফ আরমানরা। কিন্তু সঙ্গত কারণে সেই সুযোগ পাননি। অন্তরালে থেকেই ক্যারিয়ার শেষ করতে হয়েছে তাকে। কিছু মানুষ পৃথিবীতে জন্মায় প্রতিভাবান হিসেবে। যে কারণে তারা অন্যদের চেয়ে আলাদা ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারে। যে পেশায় থাকে না কেনো সেখানে তার প্রতিভার কারণে আলাদা ভাবে মূল্যায়িত হয়। তার উজ্জল প্রমাণ আশরাফ আরমান। তাইতো বিদায় বেলায় সহকর্মীরা যেমন আবেগে আপ্লুত হয়েছেন, তেমনি ক্রিকেটার তথা খেলোয়াড় ও সংগঠকরা আবেগতাড়িত হয়েছেন তার এই সিদ্ধান্তে। যে কারণে সবার একটিই দাবি মাঠকে বিদায় জানালেও আম্পায়ারিং কে যেনো বিদায় না জানান তিনি। আর সেটা যে তার প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকে করেছেন সবাই সেটি হয়তো তিনিও বুঝতে পেরেছেন। ফলে মাঠের আম্পায়ারিংয়ে আড়ি জানালেও এর মান উন্নয়নে যুক্ত থাকবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।

তাই পরিশেষে বলবো একজন আশরাফ আরমান যুগে যুগে আসেন না মাঝে মধ্যে আসেন। সুতরাং সিলেটের তথা বাংলাদেশের আম্পায়ারিংয়ে এখনো দেওয়ার মত অনেক কিছু বাকি। প্রত্যাশা রইলো সকলের সেই আশা পুরণ করবেন তিনি।

 

লেখক: সাংবাদিক