১৯৭১ সালের ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। একাত্তরের মার্চ মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা ছিল এই অধ্যায়ের অনিশ্চিত সূচনাপর্ব। পাকিস্তানের আক্রমণের মুখে বঙ্গবন্ধু, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নিরস্ত্র নিরীহ জনসাধারণের স্বাধীনতার জন্য প্রাণপণ লড়াই করা ছাড়া আর কোনো দ্বিতীয় পথ ছিল না। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান উত্তাল মার্চ মাসের সেই দিনগুলোতে অপারেশন সার্চলাইটকে বাঙালি নিধনে ভেতরে-ভেতরে প্রস্তুত করার জন্য সময় নিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন, সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক গতিপথকে অনিবার্যভাবে পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভাঙার পথেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এই অসহযোগ আন্দোলন ছিল অহিংস। এর বিরুদ্ধে শুরুতে পাকিস্তানিদের নেওয়ার মতো কোনো সশস্ত্র কিংবা পুলিশি ব্যবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধু সে কারণেই সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...’। তিনি স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলন যে গতিময়তা নিয়ে অগ্রসর হবে, তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় পাকিস্তানের থাকবে না। ফলে এই সংগ্রামের অভিযাত্রার চূড়ান্ত লক্ষ্য স্বাধীনতা অর্জনেই ধাবিত হবে।


একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, মার্চ মাসের সেই অসহযোগ আন্দোলনের ফলে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের প্রশাসন, আদেশ-নির্দেশ, রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্রিয়া ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে, সেই জায়গায় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদেশ-নির্দেশ প্রশাসনের ওপর আপনাআপনি কার্যকর করার গ্রহণযোগ্যতা পেতে থাকে। ফলে কার্যত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পূর্ব বাংলায় অচল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধারণা প্রশাসনসহ সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এই অবস্থা যত চলতে থাকে, তত অসহযোগ আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তোলে।

পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান তাঁর পরামর্শক ভুট্টো, সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় শক্তি পরিস্থিতি আগে থেকেই বুঝতে পেরে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে অপারেশন সার্চলাইটের মূল পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি লে জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এস এম আহসানকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই দুই পদের দায়িত্ব দেওয়া হয় লে জেনারেল টিক্কা খানকে।

১৬ মার্চ তারিখে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে লোকদেখানো নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। ১৮ তারিখ গোপনে খাদেম হুসাইন রাজা এবং রাও ফরমান আলী অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা তৈরি সম্পন্ন করেন। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল অসহযোগ আন্দোলনের গতিপথ রুদ্ধ করে দেওয়া, পোড়ামাটি নীতি অনুসরণের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা চিরকালের জন্য ধূলিসাৎ করে দেওয়া। ইয়াহিয়া খান সেই প্রস্তুতির সবকিছু চূড়ান্ত করেই ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ছাড়েন এবং অপারেশন সার্চলাইটের আক্রমণ শুরুর নির্দেশনা দিয়ে যান। রাতে সেই আক্রমণই ট্যাংক, কামান, গোলাবারুদ ও সশস্ত্র বাহিনীর পরিকল্পনা মোতাবেক ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর এবং সিলেটে একসঙ্গে শুরু হয়। বাঙালিনিধন ও গণহত্যার এক বর্বরোচিত শক্তি প্রয়োগের অধ্যায় পাকিস্তান রাষ্ট্র, শাসকশ্রেণি ও সেনাবাহিনী যুক্তভাবে পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ২৫ মার্চ রাতে শুরু করলে বঙ্গবন্ধু সূচিত অসহযোগ আন্দোলনের পর্ব রুদ্ধ হয়ে পড়ে, সেই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র পন্থায় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর হামলাকে প্রতিহত করার ডাক দেন। শুরু হয় স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধের অধ্যায়। ২৬ মার্চ থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং ১০ এপ্রিল থেকে সরকার গঠনের মাধ্যমে বৈধ সরকারের নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করার সব প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে শুরু হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে স্বাধীনতাকামী সব শ্রেণি-পেশার নিরস্ত্র মানুষ। এরা সশস্ত্র হওয়ার সব উপায় উদ্ভাবন করে। পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে একসময়ের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে হামলা প্রতিহত, আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ ঘটাতে থাকে। স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত পথে তাঁর দল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। জনগণকে এর সঙ্গে একাত্ম হওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়।

বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা গ্রেপ্তার করে কারাগারে বন্দী করে রাখলেও তাঁকে রাষ্ট্রপতি করেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত করার সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারই তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতিতেই মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা তৎপরতা, কূটনীতি, আন্তর্জাতিকভাবে জনসমর্থন সৃষ্টি, দেশের অভ্যন্তরে জনগণকে সুসংগঠিত করা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ব্যর্থ করে দেওয়ার এক নিরন্তর সশস্ত্র যুদ্ধে সুসজ্জিত করতে থাকে। ২৬ মার্চ শুরু হওয়া সশস্ত্র স্বাধীনতালাভের যুদ্ধ ক্রমেই বেগবান হয়ে ওঠে। স্বাধীনতাকামী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া পূর্ব বাংলার জনগণ ১৯৭১ সালের বিশ্ব রাজনীতিকে গভীরভাবে নাড়া দিতে সক্ষম হয়। গোটা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তখন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের লড়াইরত বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের লক্ষ্য অর্জনের কণ্টকাকীর্ণ পথ। বিশ্বের শক্তিধররা তখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক ভাগে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধরত মানুষের স্বাধীন রাষ্ট্রলাভের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থন দান, অন্য ভাগে কয়েকটি সরকার পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন করে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তখন আর কেবল বাংলাদেশের একার হয়ে থাকেনি। এর পক্ষে-বিপক্ষে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তি ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির অবস্থান সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। বিষয়টি আন্তর্জাতিক কূটনীতিরও বিষয়ে পরিণত হয়ে যায়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মার্কিন, চীন এবং আরও কিছু সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনে পূর্ব বাংলার মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্তভাবে প্রতিহত করার জন্য ৩ ডিসেম্বর ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরুর মাধ্যমে একটি বড় ধরনের বহুপক্ষীয় যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সপ্তম নৌবহর ভারত মহাসাগরে প্রেরণ করলে সোভিয়েতরা ২০তম নৌবহর নিয়ে এগোতে থাকে। এরই মধ্যে ৬ ডিসেম্বর ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার আগেই ভারতের সঙ্গে যৌথ বাহিনী গঠনের চুক্তি করে রাখে। ফলে পাকিস্তানের আক্রমণ ভারতের পশ্চিম সীমান্তে সীমিত হয়ে যায়। বাংলাদেশে তখন মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে পাকিস্তানিদের সব আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। পাকিস্তানিদের সব বাংকার তাসের ঘরের মতো ভেঙে যেতে থাকে। সামরিক পরিকল্পনাতেই শুধু নয়, কূটনীতিতেও পাকিস্তানি শাসকেরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিযুদ্ধের সরকারের রণনীতি এবং রণকৌশলের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেননি। দ্রুতই এই সরকারের সবকিছু ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ তখন এতটাই দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিকভাবে শক্তি ও সমর্থন নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে যে, অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই পাকিস্তানিরা সব সেনানিবাস ত্যাগ করে ঢাকায় আত্মসমর্পণের জন্য জড়ো হতে বাধ্য হয়। চারদিক থেকে যৌথ বাহিনী এবং স্বাধীনতাকামী মানুষ ঢাকা সেনানিবাসকে অবরুদ্ধ করে ফেলে।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডার জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী ৯৩ হাজার স্বদেশীয় সেনাসদস্য নিয়ে বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে রমনার রেসকোর্স ময়দানে যৌথ বাহিনীর কাছে মাথা নত করে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে প্রতিষ্ঠিত হয়। সারা পৃথিবীতে একটি খবরই তখন প্রচারিত হয়, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিজয় লাভ করেছে।’ বাংলাদেশের নাম পৃথিবীর নতুন রাষ্ট্রের তালিকায় যুক্ত হয়ে যায়। এ হচ্ছে ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের রাষ্ট্র অর্জনের বিজয়। এর পেছনে ছিল সুদীর্ঘ ইতিহাস এবং ৯ মাসের আত্মোৎসর্গকৃত জাতির অনন্য শৌর্য-বীর্যের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ইতিহাস।

ডিসেম্বর মাসে সেই ইতিহাস সারা পৃথিবীকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম করে ফেলেছিল। আমাদের শক্তির কাছে পাকিস্তান তখন ধূলিসাৎ হয়ে যায়, সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো মহাপরাক্রমশালীর রাষ্ট্রের সমর্থনও। একাত্তরের ডিসেম্বরের গৌরব-সৌরভ, আত্মমর্যাদা, ত্যাগ, স্বীকৃতি এবং স্বাধীন রাষ্ট্রলাভের বিজয় আনন্দের দৃশ্য অতুলনীয়। গোটা জাতি তখন জয় বাংলা স্লোগানে শুধু বাংলাদেশের আকাশ-বাতাসই নয়, সারা পৃথিবীকেও মুখরিত করে তুলেছিল।

একাত্তরের ডিসেম্বর ছিল আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শৌর্য-বীর্য ও বিজয়ের অনন্য উচ্চতায় আরোহণের কাল। এবার ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আমরা বিজয়ের ৫০ বছর পূরণ করেছি। ৫০ বছরে সাফল্য ও ব্যর্থতা আমাদের দুই-ই ছিল। তবে পাকিস্তানকে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন সূচকে আমরা অনেক আগেই অতিক্রম করেছি। একাত্তরে দেশটিকে পরাজিত করেছি। এখন যেসব সূচকে অতিক্রম করেছি তাকে আরও বেগবান করতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি, গণতন্ত্রের শত্রুসহ সব অপশক্তিকে পরাজিত করেই আমাদের সম্মুখে অগ্রসর হতে হবে। ২০২১-এর ডিসেম্বরে আমাদের সেই শপথে বলীয়ান হতেই হবে।

*লেখক: মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট।


(আজকের পত্রিকার সৌজন্যে)
সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে