শাবাব-মাহি হত্যা মামলার আসামীরা

মৌলভীবাজারের আলোচিত রাজনৈতিক হত্যার শিকার মোহাম্মদ আলী শাবাব ও নাহিদ আহমদ মাহি হত্যার সাথে জড়িত ১১জন আসামী। প্রত্যেক আসামী সরাসরি অস্ত্র হাতে নিয়ে ছাত্রলীগ নেতা শাবাব ও তার কর্মী মাহিকে হত্যা করেছে বলে তদন্তে প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন (পিবিআই)। এ বছরের গত ২৬ আগস্ট আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পিবিআই।

পিবিআই সূত্র জানা যায়, মামলার বাদির ছেলে মোহাম্মদ আলী শাবাব ছাত্রলীগের কর্মী ও নাহিদ আহমদ মাহি সমর্থক ছিল। অপরদিকে এজহার নামীয় আসামী আনিসুল ইসলাম চৌধুরী তুষার, আরাফাত রহমান, সৈয়দ সৌমিক, আশফাকুল ইসলাম মাহদি, আল জামিল, অলি হায়দার সনি ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলেন। সাত নাম্বার আসামী রুবেল মিয়া একজন চানাচুর বিক্রেতা ও আওয়ামীলীগের সমর্থক। আট নাম্বার আসামী কনক রঞ্চন দাস মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়েল ছাত্র এবং একই স্কুলের ছাত্রাবাসে থাকুতো। বাকি আসামী মৌলভীবাজারের সরকারি কলেজের ছাত্র সৈয়দ প্রতীক হাসান, সাব্বির হোসেন, তামিম হাসান ও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়েল ছাত্র ফাহিম মুনতাসির দিপু ছাত্রলীগের সমর্থক। পূর্বে আধিপত্য বিস্কারকে কেন্দ্র করে নিহত শাবাব ও প্রধান আসামী তুষার চৌধুরীর মধ্যে ভিতরের রাজনীতিতে একটি চাপা দ্বন্ধ চলছি। দিনে দিনে শাবাব রাজনীতিতে তুষার চৌধুরীকে পিছনে ফেলে গ্রুপের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করছিল। তুষার সেই কৌশল মানিয়ে নিতে পারছিল না। শাবাব কর্তৃক মৌলভীবাজার পৌর ছাত্রলীগের কমিটি দখলে নেয়ার চুড়ান্ত পর্যায় চলে আসে। মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ ও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এর ছাত্রলীগ শাবাবের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ফলে পরবর্তি সম্মেলনে ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রার্থী তুষার চৌধুরী নিহত শাবাবকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে এবং শাবাবকে ঘায়েল করার সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।


ঘটনার তিনদিন আগের শাবাব ও মাহির পক্ষের ফাহিম হোসেন জাওয়াদ ওরফে ছোট ফাহিম এর সাথে প্রধান আসামী তুষার গ্রুপের সতীর্থ এর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় বেখেয়ালে ধাক্কা লাগে। এই ধাক্কার কারণে বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছোট ফাহিম জুনিয়র হয়েও রাগ করায় নবম শ্রেণীর ছাত্র সর্তীর্থের ক্লাসমেট সাকিব ছোট ফাহিমকে কোমরের বেল্ট দিয়ে মারপিট করে। তখন সাকিবের সাথে তার বন্ধু মামলার ১২ নাম্বার আসামী ফাহিম মুনতাসিরও ছিল। মার খেয়ে ছোট ফাহিম বিধ্বস্থ অবস্থায় মাঠের গেইট দিয়ে বাহিরে হইতে গেলে তাকে কে মেরেছে, তা নাহিদ আহমদ মাহি জানতে চাইলে ছোট ফাহিম তা বিস্তারিত বলে এবং রক্তাক্ত আঘাতগুলো তাকে দেখায়। নাহিদ আহমদ মাহি তার সাথে অজ্ঞাত কিছু বন্ধুদের নিয়ে বিদ্যালয়ের মাঠে যায়। তার একজন বন্ধুর ক্রিকেট স্ট্যাম্প নিয়ে আসে। ছোট ফাহিমের হাতে একটি স্ট্যাম্প ধরিয়ে দেয়। স্ট্যাম্পসহ মাহি মাঠে প্রবেশ করতে দেখে তুষার গ্রুপের সাকিব, সর্তীর্থ, ফাহিম মুনতাসির দিপুসহ সকলে দৌড়ে দেয়। মাহির সাথীরা ফাহিম মুনতাসির দিপুকে পেয়ে কোমরের বেল্ট দিয়ে আঘাত করে প্রতিশোধ নেয়। এতে ফাহিম মুনতাসির দিপুর মাথা ফেটে রক্ত বের হয়। ফাহিম মুনতাসিরের এই ঘটনা নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির সুযোগ নিয়ে ঘটনার আগের দিন ২০১৭ সাথের ৬ ডিসেম্বর বিকালে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের শহীদ মিনারে বসে আসামী আনিসুল ইসলাম চৌধুরী তুষার শাবাব ও মাহিকে হত্যার পরিকল্পনা করে। আসামীরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে মোহাম্মদ আলী শাবাব এর সাথে আপোষ মিমাংসার কথা বলে নাহিদ আহমদ মাহিকে ঘটনার দিন ২০১৭ সালের ০৭ ডিসেম্বর বিকেলে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে থাকার জন্য বলে। বিকাল আনুমানিক ৪টা থেকে প্রধান আসামী আনিসুল ইসলাম চৌধুরী তুষার এর পরিকল্পনা মোতাবেকে আসামী আরাফাত, সৈয়দ সৌমিক, অলি হায়দার সনি, সাব্বির হোসেন হৃদয়, তামিম হাসান, ফাহিম মুনতাসির, আশফাকুল ইসলাম মাহদী, আল জামিল, কনক রঞ্জন দাস, সৈয়দ প্রতিক হাসান ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প, পাইপ, কাঠের রোল ও ধারালো ছুরি নিয়ে ঘটনাস্থল মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের চারপাশে শহীদ মিনার ও ছাত্রাবাসের ভিতরে কৌশলে অবস্থান করে। নাহিদ আহমদ মাহি ও তার কোচিংমেট ঘটনার দিন বিকাল সাড়ে ৫টায় স্কুলের মাঠে ঢুকে শহীদ মিনারের দিকে আসতে থাকলে তুষার গ্রæপের ফাহিম মুনতাসির দিপু, আরাফাত রহমান, সৈয়দ সৌমিক, আশফাকুল ইসলাম মাহদী, প্রতীক হাসান স্কুলের ছাত্রাবাসের সামন থেকে শহীদ মিনারের দিকে যায়। তারা মাহি ও তার সাথে থাকা সোহানকে ধাওয়া করে। ধাওয়া খেফে মাহি তার রাজনৈতিক গুরু শাবাবকে ফোন করে এবং মধ্যপাড়া এলাকায় তাদের বন্ধুদের খবর পাঠায়। সংবাদ পেয়ে সন্ধ্যা ৬টায় শাবাব গ্রুপের জুনিয়র সদস্য ও মামলার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী অর্ক, বিপ্লব, পল্লব, সোহান, ফাহিম হোসেন জাওয়াদ, মাহি হোসেনদের নিয়ে ফাহিম সরোয়ার চৌধুরী মধ্যপাড়া থেকে পায়ে হেটে এবং শাবাব ও কৌশিক মোটরসাইকেলসহ মাঠের গেইট ও বিদ্যালয়ের মাঠের গেইটের মাঝখানে রাস্তায় উপস্থিত হয়ে প্রতিপক্ষের ধাওয়া খাওয়া মাহি ও সোহানের সাথে মিলিত হয়।

জানা যায়, শাবাব তার সহযোগীদের নিয়ে সাইফুর রহমান অডিটোরিয়ামের পাশের গেইট দিয়ে ছাত্রাবাস পর্যন্ত যায়। তাদেরকে দেখে প্রতিপক্ষ তুষার গ্রুপের আসামীরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ছাত্রাবাসের আশপাশে তিন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে উৎ পেতে ছিল। যার কারণে শাবাব ও মাহি প্রতিপক্ষদের দেখতে পায়নি। শাবাব ও তার সহযোগীরা উল্টাদিকে ঘুরিয়া ফেরৎ অসার জন্য অগ্রসর হলে অনুমান ১০গজ অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটে আসামী আনিসুল ইসলাম চৌধুরী তুষারের নেতৃত্বে আরাফাত রহমান, সৈয়দ সৌমিক, আশফাকুল ইসলাম মাহদী, আল জামিল, অলি হায়দার সনি, কনক রঞ্জন দাস, সৈয়দ আহমেদ প্রতীক, সাব্বির হোসেন হৃদয়, ফাহিম মুনতাসির দিপু ও তামিম হাসান ধারালো দা, ছুরি, পেপার নাইফ (এন্টি কাটার), ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প, পাইপ, কাটের রোল ইত্যাদি নিয়ে অতর্কিতভাবে শাবাব, মাহিসহ তাদের উপর হামলা চালায়।

অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, তুষারের হাতের ছুরি, মাহদির হাতে দা, আরাফাতের হাতে স্ট্যাম্প, ফাহিম, সাব্বির, ও তামিমের হাতে এন্টি কাটার, সৌমিক, আল জামিল, প্রতিক, সনিদের হাতে স্ট্যাম্প ও কাঠের রোল, কনক রঞ্জনের হাতে পাইপ ও দা ছিল। প্রথমে আসমী আরাফাত চিৎকার করে স্ট্যাম্প দিয়ে শাবাবের হাটুর উপরে বাড়ি দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। মাহদি দা দিয়ে মাহির ডান পায়ে কোপ দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। আরাফাত কনকের হাত থেকে দা নিয়ে শাবাবের ডান উরুতে কোপ দেয় এবং এলোপাতারি কোপাতে থাকে। মাহদী দা দিয়ে মাহিকে কোপাতে থাকে। এরপর আসামী তুষার, সৈয়দ সৌমিক, সনি, সাব্বির, তামিম, ফাহিম, আল জামিল, কনক, প্রতিকরা তাদের হাতের ধারালো অস্ত্র দিয়ে শাবাব ও মাহিকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই ভয়ানক দৃশ্য দেখে শাবাব ও মাহীর সাথে থাকা নিরস্ত্র সঙ্গী সাক্ষীরা নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য যে যার দিকে পালিয়ে যায়। তারা সেন্ট্রাল রোডের অবস্থান করা শাবাবের অন্যান্য সঙ্গী ও প্রতিবেশী জুনেদকে খবর দিলে তারা ঘটনাস্থলে এসে নাহিদ আহমদ মাহি ও মোহাম্মদ আলী শাবাবের রক্তাক্ত নিথর দেহ মাঠে পরে থাকতে দেখেন। আসামীদের সেখানে তারা পায়নি। তখন তারা একটি টমটমে করে শাবাব ও মাহিকে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা বিশিস্ট হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।

মামলার বাদি শাবাবের মা সেলিনা রহমান চৌধুরী বলেন, পিবিআই’র অভিযোগপত্রে আমরা সন্তুষ্ট। এখন দ্রুত মামলাটির কার্যক্রম চললে আমরা বিচার পেতাম। কিন্তু যে ভাবে মামলা চলছে আমরা কবে বিচার পাবো এর কোন নিশ্চয়তা নেই।

পিবিআই মৌলভীবাজারের এসপি মো. আবু ইউসুফ বলেন, মামলাটির তদন্তকালে সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ ও আসামীদের জবানবন্দির ভিত্তিতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পিবিআই। এজহারভূক্ত এক আসামী ছাড়া বাকীদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। আমরা আশাকরি বিজ্ঞ আদালত অভিযোগপত্রের আলোকে একটি দৃষ্টান্তমূলক রায় প্রদান করবেন।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/পিটি-১২