একঝাঁক পাখি উড়ে গেল। পাখিগুলোর কী যে নাম—তা কে জানে? দু-একটা হাঁস হেলেদুলে পুকুরের সামনের কাদায় পা দিলো। পুকুরের পাশে বিশাল বটগাছ। বাতাসের খেলায় গাছের পাতাগুলো দুলছে। অধ্যাপক শাহেদ তার স্টুডেন্টদের নিয়ে গাছের নিচে এসে দাঁড়ালেন। হালকা ফুরফুরে বাতাস ছুঁয়ে গেল তাদের শরীরের ওপরে। অধ্যাপক শাহেদ, শরীরে জড়ানো চাদরটা খানিকটা ঠিক করে নিলেন। উস্কুখুস্কু চুলে হাত বুলিয়ে স্টুডেন্টদের বললেন—আজ আর আমরা ক্লাসে যাব না। বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে পড়াশোনা করব। কী বলো? স্টুডেন্টরা তো মহাখুশি। একজন বলল—স্যার, বেশ তো? আমার তো এতে শান্তিনিকেতনী একটা ফিলিংস আসছে। চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে এর মধ্যে ক্যাম্পাসের রমিজ চাওয়ালা এসে হাজির। অধ্যাপক শাহেদের দিকে তাকিয়ে রমিজ বলে ‘স্যার, গরম গরম আদা-চা না খাইয়া কি এইরকম একটা পরিবেশে পড়ানোর মুড আপনার আসব?’ অধ্যাপক শাহেদ রমিজের চালাকিটা বোঝে, মনে মনে হাসে। ভাবে এ যে নির্মল চালাকি। অধ্যাপক বলেন—দাও দাও, সবাইকে চা দাও। কেউ নেয় আদা-চা, কেউবা দুধ-চা। অধ্যাপক চায়ের কাপে একচুমুক দিয়েই আবৃত্তি করেন ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান।’ অধ্যাপকের ভরাট গলার আবৃত্তিতে স্টুডেন্টদের শরীরের কাঁপুনি ও মনের আনন্দ এক হয়ে যায়। ছাত্রী কেকা অধ্যাপকের সাথে কণ্ঠ মেলায় ‘ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি, এসেছে রবির কর।’ তাদের নতুন ধরনের ক্লাসে ক্যাম্পাসের মাঠে থাকা শিক্ষার্থীরাও যোগ দেয়। অবশ্য অধ্যাপক শাহেদের সব কাজেই তো নতুনের যোগ থাকে। তাই তো অন্য বিভাগের স্টুডেন্টরাও মাঝেমধ্যেই অধ্যাপকের ক্লাসে ঢু মারে। আর সে একবার ঢু মারাই অভ্যস্ততায় পরিণত হয়।

তাদের চারপাশে ভিড় জমে। গাছের পাতার ভেতরে রোদের ঝিলিমিলি খেলা করে। অধ্যাপক হাঁটতে শুরু করেন। পেছনে স্টুডেন্টরা তার সাথি। নরম পায়ে তারা হাঁটতে থাকে। ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতা নিয়ে তাদের টুকটাক কথা চলে। ছাত্রী কেকার অধ্যাপকের কাছে কত যে প্রশ্ন! অধ্যাপক শাহেদের ভালো লাগে কেকাসহ তার ক্লাসের আরো বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীকে। ভীষণ জানবার আগ্রহ তাদের। সাহিত্যের স্টুডেন্ট হলেও সাহিত্যেও পথ ধরে যদি অন্য কোনো বিষয়ের গলিঘুপচিতে ঢুকে যেতে হয়, তাতেও তাদের আপত্তি নেই। আজকালকার স্টুডেন্টদের তো পাঠ্যবইয়ের বাইরে নড়নচড়নে ব্যাপক অনাগ্রহ। যেন কোনো মতে চারটি বছর পার করে মাস শেষে ভালো মাইনের একটি চাকরি পেলেই তাদের নোবেল পাওয়া হলো। তাই গুটিকয়েক জানতে চাওয়া স্টুডেন্টরাই তো শাহেদের মতো অধ্যাপকদের ভরসা। তাদের ডিপার্টমেন্টের কাছে প্রায়-পৌঁছানোর পথে শাহেদ বলেন, ক্লাসে তোমাদের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘স্তন’ গল্পটি পড়াব। গল্পের নাম শুনে স্টুডেন্টদের চোখমুখে কৌতূহল খেলে যায়। কেকা বলে—স্যার, আাজ একটু ধারণা দিন না? মাথা নাড়িয়ে শাহেদ বলে—আজ নয় বিদূষী। একদিনে সব তোমাদের জানিয়ে দিলে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে তো! শাহেদের কথা শুনে স্টুডেন্টরা হেসে ওঠে। শাহেদের ডিপার্টমেন্টের বাইরের কিছু স্টুডেন্ট জানাল তারাও ‘স্তন’ গল্পের আলোচনার দিন থাকতে আগ্রহী। তাদের আগ্রহ দেখে চশমাটি নাকে টাইট করে বসাল অধ্যাপক শাহেদ। উফ! স্যারের প্রতিটি কথা-বডিল্যাংগুয়েজ স্টুডেন্টদের এত ভালো লাগে—যে তারা অধ্যাপক শাহেদের জায়গায় নিজেদের কল্পনা করে নেয়।


কেকা বাড়ি ফিরে ঘরে পায়চারি করে। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল ‘স্তন’ গল্পটি। বাড়িতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পের বই খুঁজে পায় না সে। গুগলে সার্চ করে দেখবে কী একবার—সে চিন্তা করে। পরক্ষণেই ভাবে—না থাক। অধ্যাপক শাহেদের কাছ থেকে প্রথমবার গল্প শোনা, গল্পের চরিত্রগুলো আবিষ্কার করার মজাটাই তো আলাদা। তাহলে তাহলে... কী করা যায় ভাবে—কেকা। মাথায় একটা প্ল্যান খেলা করে তার। প্রিয় সখী ‘গোলাপী’কে আগামীকাল অধ্যাপক শাহেদের ক্লাসে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে দুজনে মিলে গল্পের ভেতরে ঢুকে পড়া যাবে। মুঠোফোনে গোলাপীকে কল করে সে।

গোলাপী কেকার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে মাটিতে আছাড় খায়। গোলাপী বলে—আমি তোর ক্লাসে গিয়ে কী করব? আমি তো সাধারণ কলেজের অনার্সের ছাত্রী—বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকারই তো সাহস পাই না।

প্লিজ একবার অধ্যাপক শাহেদের ক্লাস কর। তুই অধ্যাপকের পড়ানোর স্টাইল, বাচনভঙ্গির প্রেমে পড়ে যাবি।

গোলাপী আমতা আমতা করে বলে, তুই তো জানিস আমি খুব বেশি পড়ুয়া না। জনপ্রিয় লেখকদের লেখাই তো তেমন পড়িনি আর তুই বলছিস সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লেখা গল্পের ক্লাস আমি উপভোগ করব?

করবি। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আগে সাহিত্যে মন ছিল না, ঠিক আছে। অধ্যাপক শাহেদের ক্লাস করার পর সাহিত্যে কফির মতো ডুবে থাকবি।

দুই বান্ধবী ফোনের দুইপ্রান্তে হেসে ওঠে। গোলাপী প্রিয় বান্ধবী কেকার কথায় রাজি না হয়ে পারে না।

গোলাপী কেকার কথায় রাজি হয় বটে কিন্তু একটু দ্বিধায় ভোগে। সে তো সাহিত্যের ‘স’ও জানে না। তাহলে ক্লাস করে কীভাবে মজা পাওয়া সম্ভব? তাছাড়া সে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীও না। ক্লাসে না আবার এত স্টুডেন্টদের ভেতরে অপমানিত না হতে হয়—এই ভেবেই তার শিঁরদাঁড়া ঘামতে শুরু করে। উফ্ কী একটা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হলো—ভাবে সে। তবে সম্মতি যখন দিয়েছে তখন কী আর করা! এই ভেবে আগামীকাল ক্লাসে পরার জন্য মিষ্টি গোলাপী রঙের একটা কামিজ সে বেছে নেয়। কামিজটি গায়ে জড়িয়ে আয়নায় এদিকওদিক ঘুরিয়েফিরিয়ে নিজেকে দেখে সে। কেকা যেন অধ্যাপকের নামটি কী বলছিল—সাবের না শাহেদ? আল্লায় জানে। কেকাকে ফোন করে একবার জিজ্ঞেস করবে কী? পাগল হলো নাকি সে? সাহিত্য সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, ওদিকে স্যারের নামের চিন্তা—এই ভেবে নিজের মাথায় নিজেই চাটি মারে।

ক্লাস চলছে। একজন সদ্যমৃত সন্তান জন্মদানকারী মায়ের স্তনে দুধ জমে ফুলেফেঁপে উঠেছে, কিন্তু কোনোভাবেই স্তনের বোঁটা ঠেলে দুধ বেয়ে পড়ছে না। মায়ের একান্ত ইচ্ছে যেকোনো শিশুর মুখে তার স্তনের একফোঁটা দুধ দেবার। গল্পের ক্লাইমেক্স মুহূর্তে সারা ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। সবাই অধ্যাপক শাহেদের মুখের দিকে তাকিয়ে। কী হতে চলেছে গল্পে? অসহায়, ক্লান্ত এই মা কী পারবে যেকোনো শিশুকে তার স্তন পান করাতে? ক্লাসের তরুণ চোখগুলোর জিজ্ঞাসু চাহনি শাহেদের মনে সফল শিক্ষকের তকমা লাগায়। ‘কুচাগ্রে কী যেন আটকে আছে বলে দুধটা সরছে না’—এটা বোঝার পরই সেই মা তার চুলের কাটা কুচাগ্রের মুখে জোরসে বসিয়ে দেয়।

আহ্ শব্দ করে ওঠে গোলাপী। এই সামান্য শব্দেই ক্লাসের নীরবতা ভেঙে গল্প থেকে বেরিয়ে আসে সবাই যেন। অধ্যাপক শাহেদ মেয়েটিকে দেখে অবাকই হয়। মেয়েটিকে তো ক্লাসে আগে দেখেনি সে।

অধ্যাপক শাহেদ কড়া চোখে গোলাপীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে—নাম কী?

গোলাপীর ভয়ে নিজের নাম ভোলার উপক্রম। একবার অধ্যাপকের দিকে তাকায় আরেকবার চারপাশ। মাথা নিচু করে খোলা সিল্কি চুলগুলো কানের পাশে গোজার চেষ্টা করে। গোলাপীর বান্ধবী কেকাই অধ্যাপক শাহেদের কাছে গোলাপীর এ ক্লাস করার বিষয়টি তুলে ধরে। বেশ কয়েক সেকেন্ড গোলাপীর দিকে তাকিয়ে শাহেদ জিজ্ঞেস করে তোমার নামটা বল তো?

গোলাপী ভয়ে শাহেদের দিকে তাকায়। তার দুই ঠোঁটেই কিছুক্ষণ চেপে ধরে বলে—গোলাপী।

বাহ—খুব সুন্দর নাম তো! আজকাল তো এধরনের নাম শোনাই যায় না।

অধ্যাপক শাহেদের কথা গোলাপীর কানে যায় তো যায় না। গোলাপী মেঝের ডিজাইনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভয় আর লজ্জা দুটোই তাকে জাপটে ধরে।

গোলাপী সুন্দরী—গল্পের বইটি পড়েছ কী?

গোলাপী সুন্দরী—এ নামে কোনো গল্পের বইও আছে নাকি? আজই প্রথম এ বইয়ের নাম শুনল গোলাপী। কার লেখা, কী কাহিনী, কিচ্ছু জানে না সে। উফ্ কেন যে আজ এ ক্লাসে সে আসলো—এ ভেবেই নিজের চুল ছিঁড়তে তার ইচ্ছে করছে।

ওপাশ থেকে প্রশ্ন—কি পড়া হয়নি বইটি?

গোলাপী কেবল অধ্যাপকের দিকে তাকিয়ে রইল। তার গাল আর ঠোঁট দুটো তে ছড়িয়ে পড়ল আগুনরং।

অধ্যাপক শাহেদের চেহারায় ফুটে ওঠে বিরক্তি। চোখের চশমা ঠিক করতে করতে অস্ফুট কণ্ঠে বললেন—‘মূর্খ বালিকা’।

কেউ কি শুনল অধ্যাপক শাহেদের কথাটা? কি জানি? তবে গোলাপীর কানে ঠিকই পৌঁছাল। কী করবে কী বলবে—গোলাপী জানে না। শুধু অধ্যাপক শাহেদের দিকে ভয়ে তাকিয়ে রইল। ক্লাস থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে গোলাপীর চোখে শাহেদের চোখ পড়ল। চারটি চোখের ভাষা যেন অদ্ভুত। চোখের এ ভাষা দুজনেরই কাছেই অদ্ভুত ঠেকে...।

বাসায় এসে সারাটি বিকেল গোলাপীর কাটে অস্থিরতায়। সে জানে না এ ধরনের অস্থিরতায় কি করে স্থির হতে হয়? কখনো সে পায়চারি করে, কখনো বিছানায় বসছে আবার কখনো-বা জানালা দিয়ে যতদূর চোখ যায় ততদূরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাথরুমে ঢুকে মুখে জলের ঝাপটা দেয়। সাবান দিয়ে ঘষে নরম গালকে লাল করে—এরকমভাবে আগে তো সে অপমানিত হয়নি। অধ্যাপক শাহেদের বিরক্তির সাথে তার দিকে ভ্রু কুঁচকানোর ছবিটি চোখের সামনে ভাসে। মূর্খ বালিকা শব্দটি যেন সারা ঘরে ইকো হয়। অধ্যাপক শাহেদ যেন বইটির কী নাম বলেছিল? মনে করতে পারে না গোলাপী। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে সে। ঝিমুতে ঝিমুতে বইয়ের নামটি মাথায় আসে তার। হ্যাঁ... ‘গোলাপী সুন্দরী।’

কার লেখা এটি? উফ্ কিচ্ছু জানে না সে। অধ্যাপক কি তবে তাকে ঠিকই বলেছে—মূর্খ? কী জানি। তাই বলে সবার সামনে এমনভাবে অপমান করবে? না। না। গোলাপী কোনোভাবেই তা মানতে পারে না। গোলাপী তার মুঠোফোনে গুগল সার্চ করে বের করে ফেলে গোলাপ সুন্দরী বইয়ের লেখকের নাম। ও মা! এ নামে যে লেখক আছে সে তো আজই জানল। এক পর্যায়ে ইন্টারনেটে বইটি পেয়েও যায় সে।

গোলাপী বইয়ের নাম শুনে যতটা সহজ ভেবেছিল বইটি কিন্তু ততটা সহজ নয় বইটি। বইয়ের দু-একটা পাতার বেশি সে এগুতে পারে না। আজ থেকে তবে কী সে সাহিত্যের বিভিন্ন বই পড়তে শুরু করবে? অধ্যাপক তাকে মূর্খ বলল আর তাতেই তার সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক চলে এল। সে তো সাহিত্যের ছাত্রী না। তবে তার সাহিত্যেও খোঁজ রাখার দায়ই-বা কী? এ কি তবে অধ্যাপকের শ্লেষের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ? ওমা! ক্লাস রুম থেকে বেরোবার পথে অধ্যাপকের সেই চোখের চাহনি মনে করে বুকের বাম পাশটা ছিঁড়ে পড়তে চায় গোলাপীর।

হঠাৎ অস্থির হল কি সে! এসব ভাবতে না ভাবতেই বান্ধবী কেকার ফোন। স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে গোলাপী। কেকাই বরং বিব্রতবোধ করে। কেকা জানায়, অধ্যাপকের পরবর্তী ক্লাসটি হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের বসবার জন্য নির্ধারিত কক্ষে। কোনো কিছু না ভেবেই পরবর্তী ক্লাসেও অংশ নেবার আগ্রহ প্রকাশ করে গোলাপী। তার নিজের আগ্রহ প্রকাশের পর নিজেকে শুধায়—অধ্যাপকের ক্লাসের সেই অপমান—ভয় আর লজ্জা কোথায় মিলিয়ে গেল গো!

আজকের ক্লাস অধ্যাপকের বসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত কক্ষে। একপাশের বুক সেলফে বাংলা সাহিত্য তো অপরপাশের সেলফে বিশ্বসাহিত্যের বই সাজানো। গোলাপীর কাছে এ যেন একটা লাইব্রেরি ঠেকে। অধ্যাপক শাহেদ চেয়ারে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছেন। হয়তো সেই পাতা থেকে আজ স্টুডেন্টদের নিয়ে যাবেন চিন্তার কোনো রাজ্যে। আজ গোলাপী, গোলাপী রঙের সুতির শাড়ি পরে এসেছে। গোলাপী রঙের মধ্যে নীল ছাপার ফুল। কড়া নীল রঙের ব্লাউজ। চুলে হালকা বেণি। সব সময়ের মতোই সে সিম্পল। শুধু শাড়ি পরেছে এই যা! লিপস্টিক, টিপ, কাজল এসবের ব্যবহার তার খুব একটা প্রয়োজন হয় না। শেষ দিকের একটা সিটেই সে বসে। আজ অধ্যাপক কী পড়াবে—সে বিষয়েই তার যেন যত আগ্রহ। ভয় লাগছে না ভেবেই শরীরে—মনে একধরনের আনন্দ খেলা করে।

নিজের অনুভূতি চিন্তা করার আগেই কানে ভেসে আসে অধ্যাপকের ভরাট গলা:

আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি,

সে আমাদের একটিমাত্র সুখ।

তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি

তাহার গানে আমার নাচে বুক।

তাহার দুটি পালন করা ভেড়া

চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে,

যদি ভাঙ্গে আমার ক্ষেতের বেড়া

কোলের ’পরে নেই তাহারে তুলে।

আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা

আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা,

আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে,

আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।

অনেক বড় কবিতা আবৃত্তি করল অধ্যাপক। গলাটা খুসখুস করছে। এখন একটু আদা-চা খেতে পারি কি—অধ্যাপকের গলায় অনুনয়। স্টুডেন্টরা অধ্যাপককে অনুমতি দিতে কী আর দেরি করে? অধ্যাপকের কক্ষেই চা বানাবার সরঞ্জাম আছে। রসিকতা করে অধ্যাপক বলে—সবসময় তো নিজেই চা বানিয়ে খাই, আজ কী স্টুডেন্টদের মধ্যে থেকে কেউ...? স্যারের ইচ্ছে পূরণ করতে সবাই চায়, কিন্তু খারাপ চা বানিয়ে দোষের ভাগীদার আবার কেউ হতে চায় না। অধ্যাপকের প্রিয় ছাত্রী কেকা। কেকা অধ্যাপকের অনুমতি নিয়ে বলে—গোলাপীর ভালো চা বানানোতে সুনাম রয়েছে।

এই মেয়েটি আজও ক্লাসে এসেছে? এতক্ষণ খেয়াল করেনি অধ্যাপক। সাহস আছে বটে মেয়েটির।

চা বানাতে অধ্যাপক মেয়েটিকে সম্মতি দেয়। গোলাপী বাধ্য মেয়ের মত চা বানায়। গোলাপী জানে না, অধ্যাপক চায়ে চিনি খায় কিনা? আড়চোখে অধ্যাপককে দেখে গোলাপী। কতই-বা বয়স হবে অধ্যাপকের। ৫০ হয়েছে কি? কে জানে। চা বানানোর জায়গায় ডায়বেটিস চিনি নেই, তাই নিসংকোচে চায়ে আধা চামচ চিনি ঢেলে দেয়। সাথে আদা কুচি। বেশ মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আসে। চা প্রস্তুত। কিন্তু অধ্যাপকের সামনে চায়ের কাপটা দেবার সময় ভয় নয় কেমন যেন লজ্জা তাড়া করে তার। গোলাপী যেন তখন লজ্জায় নুয়ে পড়া ফুল।

অধ্যাপক চায়ে চুমুক দেয়। ধোঁয়া ওঠা গরম চা। সময় নিয়ে চা পান করে। বইয়ের দু-একটা পাতা উল্টাতে উল্টাতে চায়ে চুমুক দেয় অধ্যাপক শাহেদ। অনেকক্ষণ কবিতা আবৃত্তি করায় মাথাটা একটু ধরেছিল কী! তাই কি চায়ের স্বাদটা আজ একটু বেশি ভালো লাগছে, নাকি সবসময় নিজের বানানো চা থেকে একটু ডিফারেন্ট টেস্ট। চিনির পরিমাণটা একদম পারফেক্ট। কিভাবে সম্ভব হলো? সাধারণত চায়ে চিনির পরিমাণ আগে না বললে কেউই পরিমাণটা ঠিক দিতে পারে না। হয় কম নয় বেশি। মেয়েটার কমন সেন্স তাহলে খুব একটা মন্দ নয়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সামনে তাকাতেই গোলাপীর চোখে সেদিনের মতো চোখ পড়ে। বেশ তো মেয়েটার চোখ দুটো—ভাবে অধ্যাপক। সাহসীও নাকি? চোখে চোখ পড়লে মেয়েরা তো চোখ অন্যদিকে নিয়ে যায় কিন্তু মেয়েটা চোখ ফেরাচ্ছে না। অবাকই হয় অধ্যাপক। নিজে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে চা পান করে। চায়ে ভাসতে থাকা আদাগুলো গলার খুশখুশানিতে তে ভালোই আরাম দিচ্ছে। এরকম বানানো চায়ের আগে একবার কোথায় যেন খেয়েছিল—অধ্যাপক মনে করতে চেষ্টা করে। না না, চা নয়। আজ ক্লাসের গন্ধটা কেমন যেন পাহাড়ি ফুলের মতোন। চোখ বন্ধ করে পেছনে ফিরতে চায় সে। হু, মনে পড়ে। দার্জিলিংয়ে একবার ভেজা রাস্তায় ঠান্ডায় জুবুথুবু হয়ে হাঁটতে হাঁটতে এককাপ চা খেয়েছিল। সে সময়ে যেন এরকম অচেনা পাহাড়ি ফুলের গন্ধ নাকে এসেছিল।

না, আজ সত্যিই মাথাটা ঝিম মেরে গেছে। আজ আর পড়া বেশিদূর এগোবে না। স্টুডেন্টদের বলে দেওয়ায় ভালো—আজ আর নয়। অধ্যাপকের স্টুডেন্টদের এ কথাটি বলতে গিয়েই আবারো সে মেয়েটির চোখের ওপর চোখ পড়ল। মেয়েটি চোখ তো সরাচ্ছেই না। বরং চোখের চাহনি এমন যে, চা কেমন হলো তা সে জানতে চাচ্ছে। অধ্যাপকের বহুদিন বাদ হঠাৎ করে কেমন যেন ভয় লাগতে থাকে। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিয়েই আজকের মতো ক্লাসের সমাপ্তি ঘোষণা করে দ্রত পায়ে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যায়।

ক্লাস শেষ। কেকার সাথে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে আসে গোলাপী। এদিক ওদিক তাকিয়ে গোলাপী অধ্যাপক শাহেদকে খুঁজে। না—চারপাশে কোথায়ও সে নেই। একদম উধাও। মনে মনে হাসে গোলাপী। অধ্যাপককে তার একটা ভীতুর ডিম মনে হয়। কেকা গোলাপীকে খোঁচা মেরে বলে—কিরে স্যারকে ফোন করে জিজ্ঞেস করব—চা কেমন বানানো হয়েছিল? নাকি চা বানানোতেও তুই একটা মূর্খ। দুই বান্ধবী হাসতে হাসতে বলে ভালো একটা ওয়ার্ড শিখলাম রে—‘মূর্খ বালিকা’। গোলাপী কেকার কাছ থেকে অধ্যাপকের মুঠোফোন নম্বরটি নিতে ভুল করে না।

গোলাপীর আজ পুরো ক্যাম্পাসটা নেচে নেচে বেড়াতে ইচ্ছে করে। গতদিনের বুকে চেপে বসা যন্ত্রণাটায় আজ যেন মলম দেয়া হয়েছে। দিনটা ভালো গেল গোলাপীর। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলে—কী অধ্যাপক সাহেব, মূর্খ বালিকা আজ কেমন চা বানাল? মুখে বলতে পারলেন না। চোখ দিয়েও বোঝাতে পারলেন না? হা হা করে হাসে গোলাপী। ড্র্রেসিং টেবিলে রাখা নানান রঙের নখপালিশ। তা থেকে টিয়া রঙের নখপালিশটি বেছে নেয় গোলাপী। খাটে বসে পায়ের আঙুলে নখপালিশ লাগায় সে। মনে মনে বলে—আহা! অধ্যাপক যদি তার নখে নখপালিশ লাগিয়ে দিত? তার পায়ে অধ্যাপকের স্পর্শ হতো! উফ! গোলাপীর মনে হলো—তার নখে যেন কারো হাত পড়েছে। সুড়সুড়ি লাগছে। হেসে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে গোলাপী। বিছানায় শুয়ে গোলাপী নিজে নিজে আওড়ায়—আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি, সে আমাদের একটিমাত্র সুখ। আরামে চোখ বুজে আসে তার। বুকের বামপাশটা আনন্দে ছটফট করে। বিছানায় পড়ে থাকা মুঠোফোনটা হাতে নেয় সে।

প্রিয় অধ্যাপক,

চা ভালো লেগেছিল কী? বোধ হয়—খুব একটা খারাপ লাগেনি। এত রাগী কেন আপনি? সবাইকে স্টুডেন্ট ভাবেন? কিছু ভালো বইয়ের নাম দেবেন কি, যা পড়ে মূর্খ বালিকার তকমাটা মুছে ফেলতে পারি। আজ ক্লাসে আপনার চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছিল গত রাতে ঘুমাননি? কী নিয়ে এত চিন্তিত যা আপনার চোখের দুপাতা বন্ধ করতে দেয় না। মূর্খ বালিকা কি কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারে? মাত্র দুদিন আপনাকে দেখেছি। ভালো লেগেছে ভীষণ। আপনার বাম পাশের চোখে একটা তিল আছে। তিলের দিকে তাকাতে গিয়েই আজ চোখ সরাতে পারিনি। ক্লাসে পড়ানোর সময় মাঝেমধ্যে হাসবেন। এতে আপনার গালের টোলটা বেশ ভালো দেখা যায়। আবারো জানালাম—আপনাকে ভালো লেগেছে ভীষণ। বারবার দেখতে ইচ্ছে হয় আপনাকে। এজন্যই তো আপনার বকা খেয়েও ক্লাস করতে ছুটে গিয়েছি।

মূর্খ বালিকা অধ্যাপককে কী ভালোবাসতে পারবে না?

দীর্ঘ এসএমএসটি অধ্যাপকের নম্বরে গোলাপী এক আঙুলের ছোঁয়ায় পাঠিয়ে দেয়। গোলাপীর মনে হয় এ কথাগুলো অধ্যাপককে না জানাতে পারলে তার নিজের ধুকপুক করে চলতে থাকা হৎপিণ্ডের ওপর একটা বিশাল চাপই ফেলে দিত সে নিজে। এখন বুকভরে নিশ্বাস নেয় সে। এসএমএসটা পাঠিয়ে গোলাপী ভারমুক্ত হয় যেন।

দুপুরে বিছানায় অধ্যাপক শাহেদ কিছুক্ষণ গড়ায়। দু-একটা নোট তৈরি করা দরকার তার। কিন্তু শরীরটা আজ কেন যেন তা করতে সায় দিচ্ছে না। তার বিছানায় সবসময় বই ছড়ানো ছিটানো থাকে। কিন্তু আজ তার কোনো বইকে টেনে নিতে ইচ্ছে করছে না। চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবতে চায় সে। কী নিয়ে ভাববে সে আজ? কাফকা নাকি কাহলিল জিবরান? না, কেউই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে না। সব ছাপিয়ে ভেসে আসছে আজকের সেই চা বানানো মেয়েটি। নিজেকে ধমকে অধ্যাপক শাহেদ বলেন ‘হোয়াট’? মিষ্টি-সিম্পল তরুণী সেই মেয়েটি তার চোখের সামনে আসছে? কিভাবে সম্ভব? গত ক্লাসে যার নাম সে দিয়েছে মূর্খ বালিকা? দ্বিতীয় বর্ষের কেকার বান্ধবী সে। বাচ্চা মেয়ে। দেখেছেই মাত্র দুইদিন তাকে। তার সম্পর্কে অধ্যাপক শাহেদের কিছুই জানা নেই। তাহলে কেন এ মেয়েটি তার চোখের সামনে ঘুরবে? চোখ বন্ধ করে সে। অতিরিক্ত কাজের প্রেশারেই এমনটা হচ্ছে বোধ হয়। না একটু ঘুমানো দরকার। পাশে থাকা বালিশটাকে জড়িয়ে সব ভাবনা দূর ঠেলেই চোখ বোজে সে। ঘুম ঘুম। না—ঘুমদেবীর পাত্তা নেই চোখের সামনে ভেসে আসে সকালের ক্লাসের সে আদাচায়ের কাপ। লাস্ট ব্যাঞ্চের সে চোখ দুটো—অধ্যাপকের চোখের ভেতরে তারার মতো জ্বলতে চায় যেন। না, আজ আর ঘুম হবে না—বোঝে শাহেদ। বিছানা থেকে নামে। চোখ দুটো কচলে চুলায় পানি বসায়। পানি ফুটতে শুরু করে, আদাকুচি দেবার পরই ঘরে পাহাড়ি সেই মিষ্টি ফুলের ঘ্রাণ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কিন্তু করে অধ্যাপক শাহেদ। কী হলো তার। ঘুমুতেও দেবে না আবার চা বানানোর সময়েও সে এসে হাজির হবে। নিজেকে কন্ট্রোল করতে হবে নতুবা চলবে না—তা জানে অধ্যাপক শাহেদ। অতীতে বহুবারই তো এ ধরনের মায়ায় জড়িয়ে কেবল নিজের যন্ত্রণা বাড়িয়েছে সে। তবে আর কেন? কাপে চা ঢালতে গিয়ে অধ্যাপক শাহেদের মনে হয়—ভালোবাসা বোধ হয় এক অফুরন্ত রহস্য। কয় চামচ চিনি যে কাপে ঢালা হলো আজ তা খেয়াল করা হলো না অধ্যাপকের। অতীতের মতোই তবে কী আবার সে ঢুবে যাচ্ছে নতুন কোন ভুলে?

গরম ধূমায়িত চায়ে চুমুক দেয় অধ্যাপক শাহেদ। বইয়ের পাতার কবিতায় নিজেকে খুঁজে পায় কী অধ্যাপক? রবিবাবু লিখেছেন—

পাছে আমার একলা প্রাণের ক্ষুব্ধ ডাকে

রাত্রে তোমায় জাগিয়ে রাখে

সেই ভয়েতে মনের কথা কইনে খুলে

ভুলতে যদি পারো তবে

সেই ভালো গো, যেয়ো ভুলে।

বিজন পথে চলেছিলেম, তুমি এলে

মুখে আমার নয়ন মেলে।

ভেবেছিলাম বলি তোমায়, ‘সঙ্গে চলো

আমায় কিছু কথা বলো’। হঠাৎ

তোমার মুখ চেয়ে কী কারণে

ভয় হলো যে আমার মনে।

কবিতা পড়তে পড়তে অধ্যাপক অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে বৈকি। ফস করে একটা সিগারেট ধরায়। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বাইরের জানালা দিয়ে তাকায়। চারপাশ চুপচাপ, শান্ত, ঝিমানো। হঠাৎই মোবাইলের বিপবিপ শব্দে জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে মোবাইলটি হাতে নেয়। অপরিচিত নম্বর থেকে এসএমএস। দীর্ঘ এসএমএসটি পড়ে অধ্যাপক শাহেদ। এসএমএসটি পড়ে ভালোই লাগে অধ্যাপক শাহেদের। তাই সময় নিয়ে বেশ কয়েকবার পড়ে এসএমএসটি। হাসিও পায়। উত্তর দেবে কী মেয়েটির এসএমএসের? অধ্যাপক শাহেদ গোলাপী নামের মেয়েটির অবয়বটি আবারো চিন্তা করে। একটি শিশিরে ভেজা তাজা গোলাপী গোলাপ চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু কিন্তু...।

গোলাপের কাঁটাকে বড্ড ভয় যে অধ্যাপকের!


সিলেটভিউ২৪ডটকম/বাংলাট্রিবিউনের সৌজন্যে/আরআই-কে