এ অঞ্চলে ‘জননেতা’ বললে যে নামটি চোখের সামনে ভেসে উঠে তিনি আবদুস সামাদ আজাদ। ৬৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ৫১ বছরই তিনি ছিলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। সরকারে ছিলেন মাত্র আট বছর। মানুষের সুখ-দুঃখের সারথি ছিলেন। ত্রিকালদর্শী রাজনীতিবিদ তিনি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে পাঠ নেয়া আবদুস সামাদ আজাদ ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সকল আন্দোলনে অগ্রপথিক।

কলাবাগনের বাসভবনে গভীর রাত পর্যন্ত কর্মীদের নিয়ে রাজনৈতিক আড্ডায় মেতে ঊঠতেন তিনি। রাতজাগা রাজনীতি নিয়ে তোফায়েল আহমদ একবার বলেছিলেন- রাত যত বাড়ে সামাদ আজাদ তত জাগেন। ৯৬ সালে নির্বাচনের সময় এক রাতে লিডারের উপশহরের বাসায় নেতারা বসেছেন। রাত ১১ টায় তার অনুসারীরা বললেন, আমাদের লিডারেরতো রাত মাত্র শুরু। অন্যদের চোখে তখন রাজ্যের ঘুম। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বললেন, আমরা যারা নতুন তাদের জন্য কর্মশালার আয়োজন করুন। অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। দেওয়ান ফরিদ গাজী লিডারকে দেখিয়ে বললেন, স্কুলের হেডমাস্টার তো আছেনই। স্কুল শুরু করলেই হয়। লিডার দেওয়ান ফীরদ গাজীকেইঙ্গিত করে বললেন, উনি মাস্টার হিসেবে জয়েন করলে আমি হেড মাস্টারের দায়িত্ব নিতে রাজি।


১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা। বিভিন্ন দেশের পতাকা উড়ছে। ওই সময় সামাদ আজাদকে সুনামগঞ্জে কালো পতাকা দেখানো হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আগেই খবর পৌছে যায়। পরদিন মন্ত্রীসভার বৈঠকে শেখ হাসিনা পতাকার বিষয়টি তুলেন। সামাদ আজাদ আগ বাড়িয়েই বলেন- বিশ্বকাপ একটা শুরু হইছে। সবখানে ভিনদেশি পতাকা আর পতাকা।

৯৯ সালের শেষ দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বাইরে যাওয়ার আগে বিভিন্ন জেলার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়ে যান। তবে, সুনামগঞ্জের ব্যাপারে কিছু না বলায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহমদ নেত্রীকে সুনামগঞ্জের ব্যাপারে কিছু বলার অনুরোধ করেন। ওই সময় আবদুস সামাদ আজাদ কিছু না বললেও কিছুক্ষণ পরে তোফায়েল আহমদকে উদ্দেশ্য করে -ভোলার কিছু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর নাম ধরে বলেন, তারা বাসায় আসবে একটু বসতে হবে।

আবদুস সামাদ আজাদ যখন সুনামগঞ্জে রাজনীতি করতেন তখন তিনিই সিদ্ধান্ত নিতেন। কাকে দিয়ে রাজনীতি করাতে হবে তা ভাবতেন। বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আবদুস সামাদ আজাদকে নেতা মেনেই আওয়ামী লীগে এসেছিলেন।

আজীবন তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনো রাজপথ, কখনো জেল জীবন কখনো আন্ডারগ্রাউন্ড। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন মিছিলের অগ্রভাগে। তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক মান ছিল আকাশ ছোয়া।
সিলেট অঞ্চলের রাজনীতির রাজা সামাদ আজাদের জীবণে যে ভুল ছিল না- তা নয়। রাজনীতির জন্য যতবার সিলেট অঞ্চলে তাঁর অনুগত লোকদের জন্য বিতর্কের মুখে পড়েছেন, অন্য কোন কারণে নয় । লিডারের একটু আশীর্বাদ ও ছায়ার অভাবে যেমন অনেক ত্যাগী নেতাদের দল ছেড়ে ঘরে বসতে হয়েছে তেমনি সীমাহিন ভালোবাসায় যাদের উপরে উঠে আসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তাদের অনেকেই জনবিচ্ছিন্ন, সুবিধাবাদী, বেঈমান - মুনাফেক । সামাদ আজাদ অন্য কোন গ্রহের মানুষ ছিলেন না। তিনি প্রায়ই বলতেন, আমি গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষ। হাওর-বাওড় অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ থেকে এসেছি। গ্রামের মানুষের জীবন-প্রচলন আমার চাইতে কে ভালো বুঝবে।

তিনি বলতেন ‘আমি তো বর্ধিত জীবন নিয়েই বেঁচে আছি। আমার সহযোদ্ধা তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানের সহযাত্রী হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ৩ নভেম্বর ’৭৫ ছিল আমার মৃত্যুদিবস। কিন্তু মহান করুনাময় আমাকে জালেমদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের এক চরম ক্রান্তি লগ্নে হাল ধরেছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ। জাতির জনক হত্যাকান্ড, জেল হত্যাকান্ড, সামরিক শাসনের দাঁতাল পেশীশক্তি যখন আওয়ামী লীগকে ভীষণ দুর্বল করে তুলেছিল, তখন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই হয়ে পড়েছিলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সে সময়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন সামাদ আজাদ। তাঁর অসম ধৈর্য, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতার ফলেই ১৯৭৮-৭৯ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ প্রাণ পেতে শুরু করেছিল পুরোমাত্রায়। সে সময় গ্রামে গ্রামান্তরে তিনি আপামর জনসাধারণকে যে সাহসটি তার বক্তব্যে দিয়ে বেড়াতেন তা হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে কেউ ষড়যন্ত্র করে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। মুজিব হত্যার বিচার বাংলাদেশে হবেই। তাঁর সে স্বপ্ন যে বাস্তবতার পরশ পেয়েছে তা বাংলাদেশের জনগণ শ্রদ্ধার সাথেই স্মরণ করবেন।

আজীবন সংসদীয় গনতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গেছেন আব্দুস সামাদ আজাদ। তিনি খুব গর্ব করতেন যে তাঁর হাত দিয়েই ১৯৯৬ সালে সংসদীয় গনতন্ত্রে পুনঃ প্রত্যাবর্তনের বিলটি সংসদে উপস্থাপিত হয়।

আব্দুস সামাদ আজাদ ছিলেন হাওর পারের মানুষ। হাওর পারের মানুষদের তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তিনি বুঝেছিলেন তাদের অন্তরের কথা।

 

সিলেটভিউ২৪ডটকম/রেজা/এন.এইচএস/১৭