‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবি নজরুলের প্রতিনিধিত্বকারী একটি শ্রেষ্ঠতর কবিতা। ১৩৩২ সালে এটি ‘বিজলী’ পত্রিকায় (আশ্বিন সংখ্যায়) প্রকাশিত হয়। পরে ৮২ পঙক্তির এই কবিতাটি ‘সর্বহারা’ (১৯২৬) কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করে প্রকাশ করা হয়। এই কবিতাটিকে নজরুলের আত্মোপলব্ধির জীবনদর্শন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। নজরুলের ভাবনা বা চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে এই কবিতায়। কী কী করবেন, কী কী করা উচিত তা তিনি কবিতায় তুলে ধরেছেন।

কবিতার শুরুতেই নজরুল বলেন, ‘‘বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই 'নবী'!/কবি ও অকবি যাহা বল মোরে মুখ বুঝে তাই সই সবি।'’ তিনি আসলে মানবতার পক্ষেই ছিলেন। মানুষই তার মূল লক্ষ্য। তিনি কোনো পক্ষে জড়িত হননি। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে মানবতাকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ফলে, বিভিন্ন দল, মত, ধর্মে বিভক্তরা তাকে প্রতিপক্ষের লোক বলে বিবেচনা করত। এ কথাও তুলে ধরেছেন আলোচিত কবিতায়:


'গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পতি-রাম ভাবে কনফুশি!

স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের অঙ্কুশি!'

নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী বিদ্বেষী'।
তৃতীয় স্তবকে কবি তার বিরুদ্ধবাদীদের স্বরূপ উদ্‌ঘাটন করতে চেয়েছেন, নিজের মত পরিষ্কার করেছেন।

‘‘গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!

প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’

আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’

অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।

সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’

যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!’’

চতুর্থ স্তবকে তিনি মৌলবাদীর চরিত্র তুলে ধরেছেন। কট্টরদের মনোভাব তাদের মতো হতে হবে। বিরুদ্ধমতের প্রতি সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করে থাকে। সব ধর্ম, দলের ক্ষেত্রেই এমন লোকের সংখ্যায় বেশি। তখন উদারনীতির লোক খুব কমই পাওয়া যেত। এখন তো আরও কমে গেছে সংখ্যাটা।

‘‘মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্লারা ক’ন হাত নেড়ে’,

‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!

ফতোয়া দিলাম—কাফের কাজী ও,

যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!

‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!

হিন্দুরা ভাবে, ‘পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’’

মানবতাবাদী কবির প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে সমাজের বিরাজমান নানান অসংগতি, অবিচার, অন্যায়, অনাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, মূলে আঘাত করা। কবি নজরুল এক্ষেত্রে শতভাগ সফল। সমাজে ঘাপটি-মেরে-থাকা অমানুষদের প্রতি ক্ষোভ ও বিদ্রোহ উগরে দিয়েছেন তিনি, ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় কাজ বা পদক্ষেপের প্রতি রুখে দাঁড়িয়েছেন। এজন্য একাধিকবার জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন তিনি। ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় আরও জ্বলে উঠলেন কবি নজরুল। ঝাঁঝালো উচ্চারণ—

‘পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,

মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।

প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,

যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!’

(আমার কৈফিয়ৎ)

যুগ যুগ থেকে পাতি নেতারাই ক্ষমতার বড়াই করে। সে ধারা এখনও বিদ্যমান। ব্রিটিশ শাসনের সময় বা নজরুলের সময়েও পাতিনেতা বা অনেতাদের দাপট বেশি ছিল। নজরুলে কবিতা থেকেও তা সহজেই বোঝা যায়-

‘আমি বলি, ওরে কথা শোন ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছি খোশ-হালে!

প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছি, এবার এ দাঁও ফস্কালে

‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়!

বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায়

গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে

নিস তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।’

ভালো কাজে এগিয়ে আসার লোক খুব কম। কোনোক্ষেত্রে একাই যেতে হয়। ধাক্কাটা নিজেই শুরু করতে হয়। অন্যের ভরসা করলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ভালোকাজের এরকম অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’র মতো নজরুলের উপলব্ধি বা দর্শনও প্রায় একই, তবে ভাষাটা ভিন্ন।

‘রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,

তাই লিখে যায় এ রক্তলেখা।’

‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় চিত্র, উপমা ও চিত্রকল্পের ব্যবহার একেবারেই কম। তৎসম, তদ্ভব, আরবি, ফারসি, ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অল্পসংখ্যক ছোট কিছু চিত্র/চিত্রকল্প রয়েছে এ কবিতায়। যেমন, 'ভায়োরেন্সের ভায়োলিন', মাথার উপরে জ্বলিছেন রবি, হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’, ‘যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল,/ মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল ‘, ‘হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নেশার আঁধারে বন চিরে’ অথবা 'স্বরাজ আসিছে চড়ে জুড়ি গাড়ি' চিত্র/উপমা বা সুন্দর চিত্রকল্প। যমকের ব্যবহার: ‘যাহা কিছু লিখি অমূল্য বলে অ-মূল্যে নেন'। ভাত, নুন আসলে প্রতীকী হিসাবেও ধরা যায়। এগুলো হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার খাদ্যের চাহিদার চরম নিম্নতম ধাপ বা পর্যায়। চরণান্তিক অন্ত্যমিল ও অনুপ্রাসের চমৎকার ব্যবহার করেছেন। নুন-এর সঙ্গে আগুন, কনফুশি-এর সঙ্গে অঙ্কুশি বা বুকের সঙ্গে মুখে, গ্রাস-এর সঙ্গে সর্বনাশ, কই কবি?-এর সঙ্গে ভৈরবী, দাড়ি চাঁছা-এর সঙ্গে হাঁড়িচাঁচা, ভাত মেরে-এর সঙ্গে পাত নেড়ে, হাত নেড়ে-এর সঙ্গে জাত মেরে, তাস খেলে-এর সঙ্গে যাস জেলে ইত্যাদির মতো চরণান্তিকের চরম প্রয়োগ দেখা যায় (অনেকক্ষেত্রে টানামিল লক্ষণীয়)। কবি নজরুলের এ চমৎকারিত্ব অবশ্য তাঁর বেশিরভাগ কবিতাতেই দেখা যায়। অন্ত্যমিলের চমৎকারিত্বের পাশাপাশি এ কবিতার 'রক্ত' হচ্ছে প্রতিবাদীর প্রতীক। সর্বোচ্চ ত্যাগ মৃত্যুর প্রতীক। বেশিরভাগ সময় প্রতিপক্ষের সঙ্গে বা অন্যায়-অবিচারের বিপক্ষে একা সম্মুখ লড়াই কর যায় না, কাউকে পাশে পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথের ‘একলা চলো রে'র মতো একাই লিখে যাচ্ছেন, প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন নজরুল। বিষ-জ্বালা বুক, কচি পেট, রক্ত লেখা, অকেজো পলিটিক্স, শনিবারী চিঠি, গোঁড়া রাম, পাতি রাম, মৌ-লোভী যত মৌলবী, বিলেত ফেরনী, হুজুগের কবি শব্দগুলি পাঠকের মন কাড়ে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কবিতাটির শেষ স্তবকবাদে সবই ছয়মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা। একটি উদাহরণ—

‘ক্ষুধাতুর শিশু/চায় না স্বরাজ,/ চায় দুটো ভাত/একটু নুন।

বেলা বয়ে যায়,/ খায়নি ক বাছা,/কচি পেটে তার/ জ্বলে আগুন।’

চার চরণের শেষ স্তবকে ৩টি পূর্ণ পর্ব আর একটি অপূর্ণ পর্ব। উদাহরণ—

‘প্রার্থনা করো/—যারা কেড়ে খায়/তেত্রিশ কোটি/মুখের গ্রাস,

যেন লেখা হয়/আমার রক্ত/লেখায় তাদের/সর্বনাশ।’

ইংরেজি শব্দের ব্যবহারে হৃদয়কাড়া করেছেন—‘আনকোরা যত নন-ভায়োলেন্ট নন-কো’র দলও নন খুশী।/‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি!’, হাফ-নেতা, ফুল নেতা ইত্যাদি ইংরেজি শব্দের ব্যবহার করেছেন। এসব শব্দ আমরা খুবই ব্যবহার করে থাকি। ফলে কবিতায় ব্যবহার পাঠকের কাছে অন্যরকম হৃদয়গ্রাহী করতে পেরেছে। ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় নজরুলের নিজের কিছু উপলব্ধির—যা বর্তমানেও প্রাসঙ্গিক—কিছু-পঙক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করছি:

(১) ‘কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’। আমরা নোংরা করে ফেলেছি রাজনীতিকে। তাই রাজনীতিতে বা আন্দোলনে গেলেই সে নষ্ট হয়ে গেছে বলে মনে করে এ সমাজ।

(২) 'আমপারা-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে'। অনেকের কাজ নেই। বিভিন্ন বেশ ধরে সুবিধা আদায় করার বা সময় অপচয় করে বেড়ানোর লোক কম নেই।

(৩) ‘কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা’। বাঙালির চিরন্তন চিন্তা, বিশেষ করে, ছেলের মায়েদের। ছেলের বউকে এরকম বদনাম দেওয়ার রীতি আজও আমাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

(৪) ‘কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু?/হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু!’। কবি-লেখকদেরকে মর্যাদা খুবই কম দেওয়া হয়। অথচ সমাজ-রাষ্ট্রে কবি-লেখকদেরকে সামনে রাখা হয়, ব্যবহার করা হয়। ‘কী ছাইপাঁশ লেখে’ বলার সংখ্যাটা কিন্তু অনেক বেশি; যুগ যুগ ধরে এখনও এ অবস্থা বিরাজ করছে।

(৬) ‘কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন/কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?’ শাসক ও প্রভাবশালীদের খুব কমই অন্যায়-করার শাস্তি পান। মৌলিক অধিকার খাদ্য নিশ্চিত করে না সমাজ। শিশুদের খাদ্যও কেড়ে খায় বা গ্রাস করে অনেকে।

(৭) ‘হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!’। অন্যায়ের প্রতিবাদে বা ভালো কাজে পরিবারসহ হেনস্তার শিকার হন অনেকে। ক্ষমতার কাছে হেরে যায় নীচুশ্রেণির ভিকটিমরা। ছেলের লাশ নিয়েও কথা বলা যায় না অনেকসময়। এখনও এ অবস্থা চলছে।

(৮) ‘বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে’। বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক ঘটনা বা প্রভাবে ইচ্ছের কথা বলা যায় না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায় না! কিন্তু বিবেক নাড়া দেয়। বলতে না-পারলে কষ্ট বাড়ে মনের, বিষ হয়ে যায় ব্যথাগুলি।

নানারকম অবিচার, অনাচার দেখে-শুনে বিবেক জাগ্রত হয় নজরুলের। রবিকে সামনে রেখেই বা অনুপ্রেরণা নিয়ে এগিয়ে চলতে চান। বলেন, ‘পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,/মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে’। শতবাধা আসুক তবুও এগিয়ে যেতে হবে, শৃঙ্খলের বাঁধা ছিঁড়ে ফেলার উপলব্ধিই একমাত্র পাথেয়। এ উপলব্ধি আসলে আমাদের মধ্যেও জারিত হওয়া প্রয়োজন। আমরা বলি যথা বাধা-বিপত্তিই আসুক ছুঁড়ে ফেলি তা, প্রতিরোধ গড়ি; নজরুলের মতো বলি, ‘যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল,/মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল’।  

সিলেটভিউ২৪ডটকম/ডেস্ক/ মাহি