কিছু কিছু সত্য ঘটনা আছে, যা আমাদের চোখের সামনেই ঘটে যায়। আমরা অনেকেই লজ্জা মনে করে সে ঘটনা এড়িয়ে যাই। যেমন আমাদের ছেলে-মেয়েরা প্রেম-ভালোবাসায় জড়িয়ে ভিনদেশি, অবাঙালি কমিউনিটির ছেলে-মেয়েদের সাথে বিয়েশাদি করছে। আমরা সচেতন প্রবাসীরা দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি ও এলাকাভিত্তিক সমাজসেবী সংগঠন বা ট্রাস্ট নিয়ে মাতামাতি করি, দিনভর নিজ দেশের মানুষের মঙ্গলের চিন্তা কাজ করে আমাদের মধ্যে। কিন্তু বিলেতে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করে বিলেতে বেড়ে ওঠা বাঙালির তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মের সন্তানাদির উন্নতির জন্য, শিক্ষাদীক্ষা, ব্যবসা বাণিজ্য, বিয়েশাদি কিংবা তাদের গেট টুগেদার বা মেলামেশার আয়োজন নিয়ে আমাদের কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ মোটেই মনোযোগী নন। তাই এ প্রজন্মের ব্রিটিশ বাঙালি তরুণ-তরুণেরা বেড়ে ওঠছেন অনেকটা বিচ্ছিন্নভাবে। বাংলাদেশি কমিউনিটির সাথে তাদের সম্পৃক্ততা কমে যাচ্ছে। ফলে তারা যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে মা-বাবা বা অভিভাবকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে তুচ্ছ মনে করেন।
গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে বিলেতের বাঙালি ঘরের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা বিয়ে করছেন ভারতীয়, পাকিস্তানি, আফগানি, ইরানি পাত্র-পাত্রীদের; অনেকেই আবার বিয়ে করছেন ইংরেজদেরকে। এক-দেড় যুগ আগে এরকম ঘটনা ঘটলে পরিবারের কর্তারা ছেলে-মেয়েদেরকে ত্যাজ্য করতেন বলে শুনেছি।
ব্রিটিশ বাঙালি ছেলে-মেয়েরা এখন অহরহ ভিনদেশিদের বিয়ে করছেন। সাধারণ পরিবারগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম। আমাদের চোখের সামনে কেউ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা জামায়াত নেতা; কেউ কেউ বড় সামাজিক সংগঠনের নেতা। কিন্তু খোঁজখবর নিলে দেখা যাবে, আমাদের পথ প্রদর্শক ওইসব নেতাদের পরিবারের বা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের ছেলে-মেয়েরা বিয়ে করেছে ভিনদেশি কাউকে। এ ব্যাপারে নেতারা কোথাও খোলাখুলি বক্তব্য বা আলাপ আলোচনা করতে অস্বস্তিবোধ করেন।
ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, ভিনদেশিদের সাথে বিবাহের বন্ধনের ফলে বাঙালি কমিউনিটি ক্রমেই সংকর (মিক্সড) কমিউনিটিতে পরিণত হবে। যে ঘরের ছেলে পাকিস্তানি বা ভারতীয় কন্যাকে বিয়ে করেছে, সে স্ত্রী নিয়ে পরিবারের সাথে বাংলাদেশে যেতে অনীহা প্রকাশ করে, করছে। বরং তারা ছুটি কাটাতে দুবাই, মালয়েশিয়া, তুরস্ক যেতে পছন্দ করে।
আঞ্চলিক ভাষায় একটি প্রবাদ আছে ‘দেখ দেখা শিখ শিখা’; অর্থাৎ দেখতে দেখতে শেখা। পরিবারের একজন বাইরের কমিউনিটিতে বিয়ে করছে দেখে বাকিদের অনেকেই তার অনুসরণ করছে। এ সংক্রমণ বাঙালি কমিউনিটিতে দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি, আমার এক আত্মীয়ের পারিবারিক অনুষ্ঠানে গেলে সেখানে একজন পাকিস্তানি ও একজন চাইনিজ বধু এবং একজন পাকিস্তানি জামাইয়ের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। ডাইনিং রুমে তাদের সঙ্গে বসে মনে হচ্ছিল, আমি যেন জাতিসংঘের সভায় বসে আছি!
ব্রিটিশ বাঙালি ছেলে-মেয়েরা এখন বাংলাদেশে যেতে আগ্রহী নয় বিধায় অনেক পরিবারের বয়োবৃদ্ধ পিতা-মাতা দেশে থাকা কোটি কোটি টাকার সম্পদ ব্যবস্থাপনা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। বাঙালি ও অবাঙালি কমিউনিটির মধ্যে বিবাহ বন্ধনে নিরুৎসাহ দিলে এবং সমালোচনা করলে আমার ১৩ বছরের একমাত্র মেয়েই আমাকে রেসিস্ট বা বর্ণবাদী বলে আখ্যা দেয়। সে স্কুল থেকে জেনেছে, এটি মন্দ কিছু নয়।
এখানে স্পষ্ট করা প্রয়োজন, এক দেশের ছেলে-মেয়ের সাথে অন্য দেশের ছেলে-মেয়ের বিয়ে প্রয়োজনে হতে পারে, এর বিরুদ্ধে নয় আমি। কিন্তু বাঙালির সাথে আরেক বাঙালির বিয়ে তো ঐতিহ্য আর আবেগের বিষয়। বাঙালির সাথে অবাঙালির বিয়ে শুনতেই কেমন লাগে না? খানিকটা ‘পর’ মনে হয় না? আবার দেখুন, আমাদের ছেলে-মেয়েরা ভিনদেশিদের বিয়ে করছে, তারা দেশবিমুখ হচ্ছে। এতে ক্ষতিটা তো দেশেরই হচ্ছে; তাই না? আমরা যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম যুক্তরাজ্যে বসবাস করছি, তাদের পরের প্রজন্ম ধীরে ধীরে দেশবিমুখ হচ্ছে। এর পরের প্রজন্ম যে পুরোপুরিই বিমুখ হয়ে যাবে না, সে নিশ্চয়তা কিন্তু নেই। প্রসঙ্গক্রমে রেমিটেন্সের কথাও চলে আসে এখানে। যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণের রেমিটেন্স লাভ করে, যা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সহায়তা করে। আমাদের পরের প্রজন্ম ভিনদেশিদের বিয়ে করে যদি দেশবিমুখ হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু তারা দেশে টাকাপয়সা পাঠাতে আর আগ্রহ পাবে না। ফলে যুক্তরাজ্য থেকে ধীরে ধীরে রেমিটেন্সের প্রবাহ কমে আসে কিনা, সেটাও চিন্তার বিষয়।
সিলেট অঞ্চলের বাঙালি পরিবারগুলো গত এক দশকে হাজারো অবাঙালি পরিবারের সাথে বিয়েশাদির সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ওইসব পরিবারের কর্তা বা মুরব্বিরা এখন ভাবতে শুরু করেছেন, কি করে বাংলাদেশে থাকা সম্পদ দ্রুত বিক্রি করে টাকাপয়সা বিলেতে নিয়ে আসা যায়। প্রকৃতপক্ষে, ‘ক্রস কানেকশন’ যতোই বাড়বে বাংলাদেশের সাথে পরিবারগুলোর সম্পর্ক ততো বেশি বিচ্ছিন্ন হবে।
মুদ্রার আরেকটা পিঠ হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে আসা শিক্ষিত ও শিক্ষার্থী হিসেবে যারা আসছেন, তাদেরকে বিলেতের যুবক-যুবতীরা বিয়ে করতে রাজি নয়। কারণ, তারা মনে করে ওরা টিপিক্যাল বাঙালি, ইংরেজিতে অপারদর্শী। আবার অনেক ছেলে-মেয়েও কম বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় বসবাস করায় তাদের জন্য উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তারা ভিনদেশিদের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
আমরা প্রবাসীদের অনেকেই দেশের রাজনীতি কিংবা নিজ এলাকার ভিলেজ পলিটিক্সে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আমাদের কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের পরিবার ও কমিউনিটির কল্যাণে সমভাবে কাজ করা দরকার। প্রবাসী সংঘ ও ট্রাস্টগুলো কমিউনিটিতে ফ্যামিলি গেট টুগেদার আয়োজন করতে পারে। এর মাধ্যমে এক পরিবারের ছেলে-মেয়েরা অন্য পরিবারগুলোর সঙ্গে পরিচিতি লাভ করার সুযোগ পাবে। গ্রেটার সিলেট ডেভেলপমেন্ট সংগঠনটি দলাদলি বা কোন্দল না করে সিলেটি ইয়াংস্টার ও প্রফেশনালদের সমাবেশ করতে পারে। তাদের মহিলা ইউনিট যুবক-যুবতীদের প্রোফাইল সংগ্রহ করে নিজ কমিউনিটিতে ছেলে-মেয়েদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার বিষয়ে সহায়তা করতে পারেন। নিজ কমিউনিটিতে বিবাহ বন্ধন সম্প্রসারণ কাজে বাঙালি মসজিদগুলোর সম্মানিত ইমামরাও ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন। ইমামরা হলেন সম্মানিত ও বিশ্বস্ত। তাদের কাছে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-ময়েদের ছবি ও তথ্য প্রদান করলে তা এভিউজ বা অপব্যবহারের সম্ভাবনা কম হবে । এ ছাড়া সভা সেমিনারের মাধ্যমে বিলেতের ইয়াংস্টারদের বাংলাদেশের শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের সম্পর্কে পজিটিভ ধারণা দিতে হবে। এর ফলে বিলেতের যুবক-যুবতীরা বাংলাদেশে গিয়ে বিয়ে করতে আগ্রহী হবেন এবং তাদের পূর্ববর্তী বংশধরদের স্মৃতিভূমি বাংলাদেশের সাথে বর্তমান জেনারেশনের সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে, দৃঢ় হবে। যা শুধু বাঙালির আবেগের জন্যই নয়, দেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
*লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী
সাবেক প্রভাষক, বিশ্বনাথ সরকারি কলেজ।