দেশে ভূমিকম্পের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল সিলেট। একাধিক চ্যুতি সক্রিয় থাকায় সিলেটকে ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ বলে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোন বলা হয় সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকার ডাউকি ফল্টকে। ২০২১ সালের মে মাসে ১০ দিনের ব্যবধানে সিলেটে ১০ দফা ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল এ ফল্ট। গত দুই বছরে অন্তত ২৫ দফা ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে এ জনপদ। আর গত এক মাসের মধ্যে তিনবার কেঁপেছে সিলেট। দফায় দফায় ছোট ছোট এসব কম্পনকে বড় ভূমিকম্পের আভাস হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। অথচ এ ঝুঁকি মোকাবেলায় নেই কার্যকর উদ্যোগ।
সিলেটের প্রায় ৪২ হাজার ভবনের ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশই ভূমিকম্পের কথা চিন্তা না করে তৈরি করা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে নগরীর ৮০ ভাগ বহুতল ভবন ভেঙে পড়তে পারে। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন কেবল তর্জনগর্জনেই সীমাবদ্ধ রেখেছে ঝুঁকি মোকাবেলার বিষয়টি। সিসিক বলছে, অর্থসংকটে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন জরিপ বা পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। ভূমিকম্প অনুভূত হলেই এ নিয়ে কিছুদিন কথা হয়। এরপর আবার সব থেমে যায়।
সর্বশেষ গত ৯ সেপ্টেম্বর নতুন করে ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে সিলেট। ৪ দশমিক ৪ মাত্রার কম্পনটির স্থায়িত্ব ছিল কয়েক সেকেন্ড। তবে এতে উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। এর আগে গত ২৯ আগস্ট ৩ দশমিক ৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। তার আগে গত ১৪ আগস্ট রাতের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫। দফায় দফায় ভূমিকম্পে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে সংগঠিত ভূমিকম্পের অন্তত ২০টির উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের ভেতরে। যার মধ্যে অধিকাংশ হচ্ছে সিলেট অঞ্চলে। বিশেষজ্ঞরা জানান, বারবার ভূমিকম্প হওয়ার অর্থ এখানকার চ্যুতির লাইনগুলো সক্রিয় আছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, নগরীতে প্রায় ৪২ হাজার ভবন রয়েছে। ২০২১ ও ২২ সালে কয়েক দফা ভূমিকম্পের পর ঝুঁকি মোকাবেলায় কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। এর মধ্যে কিছু ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিতও করা হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সেগুলো ভাঙতে পারেনি সিটি করপোরেশন। ২০২১ সালের মে মাসে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়া সিলেটের বেশ কয়েকটি ভবন ও বিপণিবিতান বন্ধ করে দেয় সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। তবে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর ফের সেগুলো খুলে দেয়া হয়।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম জানান, নগরীর ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পের কথা চিন্তা না করে তৈরি করা হয়েছে। সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ভেঙে পড়তে পারে।
তিনি বলেন, ‘সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন যে ভেঙে ফেলতে হবে তা নয়, রেক্টোফিটিংও করা যেতে পারে। সাপোর্টিং পাওয়ার দিয়ে ভূমিকম্প প্রতিরোধক হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।’
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, বিভিন্ন সময় অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন বন্ধ করার নির্দেশনা আমরা দিয়েছিলাম। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে এগুলো সংস্কার করার জন্যও আমরা মালিকপক্ষকে বলেছিলাম। কিন্তু তারা তা শোনেননি। আবার ভবনগুলো ভাঙতে গেলে তারা আদালতে মামলা করে বসেন।
তিনি বলেন, আমরা নগরের ৪২ হাজার ভবনে ভূমিকম্পের সহনীয়তা নিয়ে প্রকৌশলগত বিস্তারিত মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এ জন্য ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপও করি। ওই প্রতিষ্ঠানটি চারতলা একটি ভবন মূল্যায়নের জন্য ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ফি চায়। সেই হিসেবে সব মিলিয়ে নগরীর ৪০ থেকে ৪২ হাজার ভবন পরীক্ষা করাতে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার প্রয়োজন। কিন্তু সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এই খাতে এত বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করার মতো তহবিল নেই। তাই এখনও আমরা এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি করতে পারিনি।
নূর আজিজ আরোও বলেন, নিয়ম অনুযায়ী ভবন পরীক্ষার টাকা সংশ্লিষ্ট ভবন মালিকদেরই দেয়ার কথা। কিন্তু কেউই টাকা দিতে রাজি হচ্ছে না। এখন সিটি করপোরেশনের পক্ষে এই খাতে এত টাকা ব্যয় অসম্ভব।
সিলেটে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম ভূঞা বলেন, সিলেটের বেশির ভাগ ভবন অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে। সিলেটের অলিগলিও সরু। পাড়ার ভেতরে অগ্নিকাণ্ড হলেই ঢোকা যায় না। আর ভূমিকম্প হলে কী পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে সেটি অকল্পনীয়। আমাদেরই এখনই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সিটি করপোরেশনের আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় একদিন আমাদের পস্তাতে হবে।
সিলেটভিউ২৪ডটকম / নাজাত /এসডি-৪০৪