দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২২২টি আসনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়ে এককভাবে সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করেছে টানা তিনবারের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংসদে সরকারি দল ইস্যুর সুরাহা হলেও বিতর্ক তৈরে হয়েছে বিরোধী দল নিয়ে। এবার সংসদে বিরোধী দল কারা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন ‍উঠছে।

 



গত দুটি সংসদ নির্বাচনে ২০টির বেশি করে আসনে জয়ী হয়ে জাতীয় পার্টি টানা দুইবার বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকলেও এবার দলটির আসন অর্ধেকে নেমে এসেছে। জাতীয় পার্টি একাদশে আসন পেয়েছিল ২৩টি। কিন্তু এবার পেয়েছে ১১টি। অপরদিকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে এবার ৬২ জন জয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিজয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবার রেকর্ড হয়েছে। এর আগে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছিল।

 


এবার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সংখ্যার দিক সংসদে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসনপ্রাপ্ত দলের চেয়ে বেশি হওয়ায় তারা সমষ্টিগতভাবে বিরোধী দল হিসেবে সংসদে ভূমিকা পালন হতে পারবে কী না সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। অবশ্য বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা পরস্পর বিরোধী মত দিয়েছেন। তারা কেউ কেউ বলেছেন, বিরোধী দল হতে হলে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। আবার কেউ কেউ সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির বিধানের উদ্ধৃতি দিয়েছে বলেছেন, বিরোধী দলের জন্য দলের সদস্য হওয়া আবশ্যক নয়। বিরোধিতাকারীদের সংখ্যা গরিষ্ঠগ্রুপ হলেই বিরোধী দল হতে পারবে।

 


দেশের সংবিধান বা কোন আইন-বিধিতে বিরোধী দল ইস্যুতে কোন নির্দেশনা নেই, কেবল সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে ‘বিরোধী দলীয় নেতা’ কথাটি উল্লেখ রয়েছে। কার্যপ্রণালি বিধির ২(১)(ট) ধারা অনুযায়ী, ‘বিরোধী দলের নেতা অর্থ স্পিকারের বিবেচনা মতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চসংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমত দল বা অধিসংঘের নেতা।’

 


অপরদিকে সংবিধানের ১৫২ নম্বর ধারায় রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় বলে দেওয়া হয়েছে। এতে "রাজনৈতিক দল" বলিতে এমন একটি অধিসংঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি অন্তর্ভুক্ত, যে অধিসংঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি সংসদের অভ্যন্তরে বা বাহিরে স্বাতন্ত্র্যসূচক কোনও নামে কার্য করেন এবং কোনও রাজনৈতিক মত প্রচারের বা কোনও রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্যান্য অধিসংঘ হইতে পৃথক কোনও অধিসংঘ হিসাবে নিজদিগকে প্রকাশ করে’।

 


অধিসংঘের ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলা বিষয়ের অধ্যাপক কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, অধিসংঘ বলতে আমরা গোষ্ঠী বা দলকেই বুঝি। এক্ষেত্রে এটা রাজনৈতিক দলই হবে। সংসদের বিরোধী দল প্রশ্নে স্বতন্ত্রভাবে জয়ীদের কথা যেটা বলছেন তারা কোনও দল বা গোষ্ঠীর নয়। তারা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে জয়ী হয়ে এসেছেন। কাজেই এবারের সংসদে বিরোধী দল কারা হবে এ প্রশ্ন করলে আমার মত হচ্ছে জাতীয় পার্টি হবে। সংখ্যার দিক থেকে যেটাই হোক দলগতভাবে তারা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে।

 


অবশ্য আরও কম সংখ্যক কোনও দলের প্রতিনিধির (সেটা একজনও হতে পারে) সাথে স্বতন্ত্র এমপিরা যুক্ত হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যায় পরিণত ওই দলকেও বিরোধী দলের মর্যাদায় নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলেও জানান তিনি।

 


তার মন্তব্যের ব্যাখ্যা হচ্ছে- একটি করে আসন পাওয়া তিনটি দলের কোনও একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যোগ দিলে তারা বিরোধী দল হতে পারে।

 


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদারও একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেন। অবশ্য তিনি বিষয়টি সম্পর্কে আরও স্পষ্ট না হয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, মোটাদাগে আমি মনে করি বিরোধী দল হতে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিই হওয়া উচিত। কারণ দলগুলো একটি নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মধ্যে এসেছে। তাদের একটা দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি রয়েছে।

 


এদিকে আইন বিশেষজ্ঞ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ হোসেন বলেন,  সংসদে বিরোধী দল বলে কোনও কথা নেই। এ ধরনের কোনও টার্মও নেই। বলা আছে বিরোধীদলের নেতার কথা।  এই বিরোধী দলের নেতা হওয়ার জন্য দলের কোনও প্রয়োজন নেই। সংসদে যারা বিরোধীপক্ষ থাকবে তারা যাকে নির্বাচন করবে তিনি বিরোধী দলের নেতা হতে পারবেন।

 


কার্যপ্রণালি বিধিতে বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে হলে এককভাবে কয়টি আসন পেতে হবে, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। বিরোধী দলের স্বীকৃতির বিষয়টি স্পিকারের একক এখতিয়ারের বিষয়। তবে প্রথা বা রেওয়াজ অনুযায়ী, সরকারি দলের পর যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই দলই প্রধান বিরোধী দল এবং সেই দলের নেতা বিরোধী দলীয় নেতার মর্যাদা লাভ করেন।

 


বাংলাদেশের বিগত ১১টি সংসদের মধ্যে প্রথম ও ষষ্ঠ সংসদে কোনও বিরোধী দল ছিল না। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসন পেয়েছিল। সংসদীয় দল ও গ্রুপ সম্পর্কে প্রথম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনকালেই বিতর্ক ওঠে। সরকার দলীয় একজন সদস্য সংসদে সরকারের বিরোধিতাকারী সদস্যদের ‘তথাকথিত বিরোধী দল’ হিসেবে আখ্যা দিলে সরকারের বিরোধিতাকারী গ্রুপের এক সদস্য আপত্তি তুলে বলেছিলেন, ‘আমরা সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বিরোধী দল। তিনি যুক্তি হিসেবে তাদের নেতার অনুকূলে সংসদে একটি কক্ষ বরাদ্দ হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। ওই যুক্তিতে জাতীয় লীগের এমপি আতাউর রহমান খানকে তাদের নেতা উল্লেখ করে বিরোধী দলীয় নেতার স্বীকৃতি দাবি করেন। বিষয়টি নিয়ে সংসদে ২০ মিনিটের বিতর্কও হয়। বিতর্কের সমাপনী বক্তৃতায় সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আতাউর রহমান খান একা এক দলের একজন, আরেকদলের একজন, আর কয়েকজন নির্দলীয় সদস্য মোট পাঁচ-সাতজন সদস্য সংসদ ভবনে একটি কক্ষে একটি জায়গায় বসতে চেয়েছেন এবং এ ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। সংসদ নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু যুক্তি ছিল, ২৫ জনের কম সদস্য নিয়ে গঠিত কোনও দলকে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। তবে ২৫ জনের কম সদস্য নিয়ে কোনও দল গঠিত হলে এবং ওই দলে কমপক্ষে ১০ জন সদস্য থাকলে ওই দলকে পার্লামেন্টারি গ্রুপ বলা যেতে পারে। কিন্তু সংসদীয় দল বলা যাবে না। যার প্রেক্ষাপটে প্রথম সংসদে কোনও বিরোধী দল ছিল না। অপরদিকে ৬ষ্ঠ সংসদে বিএনপির বাইরে একটি রাজনৈতিক দলের একজন মাত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। ওই ১১ দিনের ওই সংসদেও কোনও বিরোধী দল ছিল না।

 


বিরোধী দল প্রশ্নে জানতে চাইলে সোমবার সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচনের রেজাল্ট অফিশিয়ালি ঘোষণা হওয়ার পর বিরোধী দল কারা, অলরেডি বিরোধী দল জাতীয় পার্টির তো অনেকেই জিতেছেন, চৌদ্দ দলেরও দুজনের মতো জিতেছেন। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তো দূরে নয়। যিনি লিডার অব দ্যা হাউজ হবেন, তিনি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী, নতুন লিডার অব দ্যা হাউজ পরিস্থিতি, বাস্তবতা অনুযায়ী অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিবেন।

 


এ দিকে নির্বাচনের পর সোমবার গণভবনে ভারতের টেলিগ্রাফের সাংবাদিক দেভাদ্বীপ পুরোহিতের প্রশ্ন ছিল, ‘নির্বাচন শেষ হয়েছে। আপনি যখন গণতন্ত্রের কথা বলছেন, তখন আপনার বিরোধী দলের প্রয়োজন হবে। এ ব্যাপারে আপনি কী ভাবছেন?’ জবাবে শেখ হাসিনা বলেন,  ‘আপনি কি চান আমি একটি বিরোধী দল গঠন করি? আমি তা করতে পারি? আমি নিজেও বিরোধী দলে ছিলাম দীর্ঘ সময়। আমরা আমাদের দল গঠন করেছি। বিরোধীদেরও তা করতে হবে। আপনি যদি তা করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তার জন্য কে দায়ী?’

 


স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী পংকজ নাথ বলেন, আমরা স্বতন্ত্র হয়ে জয়ী হলেও আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বতন্ত্র। আমাদের অভিভাবক হচ্ছে আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশ, দল ও সরকারের স্বার্থে সংসদে তিনি আমাদের যে নির্দেশনা দেবেন, তিনি যেভাবে চাইবেন আমরা সেভাবেই থাকবো। আমাদের জন্য তার সিদ্ধান্ত শিরোধার্য।

 


প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে স্বতন্ত্রভাবে জয়ী প্রার্থিতা যুক্তভাবে সংরক্ষিত আসনের একজন মহিলা সদস্য পেয়েছিলেন। তাদের অংশ হিসাবে পাওয়া মহিলা এমপি সংসদে সংরক্ষিত স্বতন্ত্র এমপি হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছেন। এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর স্বতন্ত্র এমপিরাও তাদের অংশে একজন করে মহিলা এমপি পেয়েছিলেন। তারা তাদের অংশের মহিলা প্রার্থী মনোনয়নের দায়িত্ব সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন।
এবারও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হলে ১০ জন মহিলা সংসদ সদস্য পাবেন।


সিলেটভিউ২৪ডটকম /ডেস্ক/মিআচৌ