সিলেটে রোববার কালবৈশাখী ঝড়ের সাথে যে আকারের শিলাবৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সিলেটের বাসিন্দাদের দাবি এতো বড় আকারের শিলাবৃষ্টি খুব কমই দেখেছেন তারা।
তবে, আবহাওয়াবিদরা বলছেন, মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত এই মৌসুমে এ ধরনের শিলাবৃষ্টি স্বাভাবিক। হাফ ইঞ্চি ডায়ামিটারের শিলার আকারও স্বাভাবিক বলে মনে করছেন তারা।
“ গত ১৫ বছরে সিলেটে এরকম শিলাবৃষ্টি দেখিনি, এতো বড় আকারের শিলা এখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা ও দেখেন নি” বলছিলেন সিলেট উপশহরের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম পলাশ।
রোববার রাত আনুমানিক দশটা পাঁচ মিনিট থেকে প্রায় আধা ঘন্টাব্যাপী হওয়া কালবৈশাখী ঝড়ের কথা এভাবেই বর্ণনা করেন মি. ইসলাম।
সিলেট বিমানবন্দরের কাছেই ‘এইট ইলেভেন ’ নামে একটি রোডসাইড ক্যাফের কর্ণধার তিনি।
নিজের প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতির কথা বলতে গিয়ে বিবিসি বাংলাকে মি. ইসলাম বলেন, “এই শিলাবৃষ্টিতে আমার রেস্টুরেন্ট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টিনের চাল ভেদ করে শিলা ভেতরে ঢুকে গেছে। চাল সবগুলো নষ্ট হয়েছে। রেস্টুরেন্টের বাইরে থাকা প্লাস্টিকের চেয়ার, টেবিল সব ফুটো হয়ে গেছে”
সিলেটে অনেক বাসাবাড়ির জানালার কাচ, গাড়ির কাচ ভেঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান সিলেটের বাসিন্দারা।
মি. ইসলাম জানান, “ রেস্টুরেন্টের সামনে আমার দুইটা গাড়ি পার্কিং করা ছিলো। একটার উইন্ডশিল্ড ভাঙছে এবং আরেকটার লুকিং গ্লাস ভেঙ্গে গেছে "।
এছাড়াও এয়ারপোর্টের সামনে অনেকগুলো পার্কিং করা গাড়ির কাচ ভেঙ্গে গেছে। কেউই হঠাৎ আসা কালবৈশাখী ঝড়ের সময় গাড়ি সরাতে সময় পায় নি”।
সিলেটের কোন কোন বাসিন্দা রোববারের এই শিলার ওজন ও পরিমাপ করেছেন।
মি. ইসলাম জানান, “ ওয়েট স্কেলে প্রায় ২০০ গ্রামের মতো সাইজ ছিলো এই শিলার। অনেক পাখিও মারা গেছে”।
সিলেটের কোন কোন এলাকায় এখনও বিদ্যুৎ ও নেই বলে জানান বাসিন্দারা।
“ কাল রাত থেকেই বিদ্যুৎ ছিলো না। সকালে বিদ্যুৎ আসলেও বারবারই চলে যাচ্ছে ” বলেন মি. ইসলাম।
সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল কাদির বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ সকাল থেকেই প্রায় ৯৮ শতাংশ গ্রাহক বিদ্যুৎ পাচ্ছে। এরই মধ্যে চালু হয়েছে। কিছু এলাকাতে লোডশেডিং চলছে আবার কিছু এলাকায় এখনো লাইন বন্ধ রয়েছে”
তবে, পুরোপুরি চালু করতে আরো কিছু সময় লাগবে বলে জানান মি. কাদির।
“ সুনামগঞ্জে একটা ট্রান্সফর্মারে সমস্যা হয়েছে, সেখানে বিকল্প ব্যবস্থায় চালু করে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে ” বলে জানান মি. কাদির।
সুনামগঞ্জের শান্তিনগর উপজেলাতেও কালবৈশাখী ঝড়ের সাথে শিলাবৃষ্টি হয়েছে বলে জানা যায়।
শিলা বৃষ্টি কি?
সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, আকাশে যখন মেঘের পরিমাণ অনেক বেশি হয় বা মেঘ অনেক বেশি ভারি হয়ে ওঠে, তখন বৃষ্টির সময় আকাশ থেকে বরফের টুকরা বা মেঘের কণা পড়ে থাকে একেই শিলাবৃষ্টি বলা হয়ে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিভিয়ার স্টর্মস ল্যাবরেটরির ওয়েবসাইটে শিলাবৃষ্টি সম্পর্কে বলা হয়েছে, শিলাবৃষ্টি হল কঠিন বরফের সমন্বয়ে এক প্রকার বৃষ্টিপাত। যা বজ্র-ঝড়ের উর্ধ্বমুখী স্রোতের ভেতরে তৈরি হয়।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, চৈত্রের শেষ ও বৈশাখের শুরুতে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা বায়ুর প্রভাবে কালবৈশাখী হয়। তখন বাতাসে এক ধরনের উর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি হয়।
সে কারণেই কালবৈশাখী ঝড় হয়। আর এর বৈশিষ্ট্যের মধ্যে দমকা হাওয়া, বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাত রয়েছে। এই কালবৈশাখী ঝড়ের বৈশিষ্ট্যের জন্যই শিলা বৃষ্টি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ওই ওয়েবসাইটে আরো বলা হয়েছে, বাড়িঘর, গাড়ি এমনকি মানুষের মৃত্যুর কারণ ও হতে পারে শিলাবৃষ্টি।
কিভাবে শিলা গঠিত হয়?
যখন বৃষ্টির ফোঁটা বজ্রঝড়ের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলের অত্যন্ত ঠাণ্ডা জায়গায় ঊর্ধ্বমুখী হয় এবং জমাট বাঁধে তখন শিলাবৃষ্টি তৈরি হয়।
শিলা কিভাবে তৈরি হয় এ সম্পর্কে এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্টর্মস ল্যাবরেটরির ওয়েবসাইটে বর্ণনা করা হয়েছে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিলাবৃষ্টির প্রধান শর্ত প্রচণ্ড গরম। বাংলাদেশে চৈত্র-বৈশাখ মাসে এ রকম গরম পড়ে। ফলে মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে যে কালবৈশাখী ঝড় হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই শিলাবৃষ্টি হয়।
এ সময় ভূ-পৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলের কোথাও কোথাও ৩৪ থেকে ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে। ওই সময় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দখিনা বাতাস আসতে পারে।
তার সঙ্গে যোগ হয় বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের তাপীয় লঘুচাপ। একইসাথে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্পে পূর্ণ আর্দ্র বাতাস যুক্ত হয়।
এই দুটির সাথে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা অপেক্ষাকৃত শীতল বাতাসের সংমিশ্রণে মেঘমালা তৈরি হয়।
এগুলো ভূ-পৃষ্ঠের তিন কিলোমিটার উপর থেকে আরো ১৮ থেকে ২২ কিলোমিটার পর্যন্ত উপরে উঠে যায়।
জলীয় বাষ্প উপরে উঠে আরো ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং ছোট ছোট বরফ কণায় পরিণত হয়।
এই ছোট ছোট বরফ কণা আশে পাশের আরও বরফ খণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং শিলা খণ্ডে পরিণত হয়।
শিলা খণ্ড যখন বেশি ভারি হয়ে যায় তখন এর ওজনকে আর বায়ুমণ্ডল ধরে রাখতে পারে না। তখন এগুলো শিলাবৃষ্টি আকারে ভূ - পৃষ্ঠে নেমে আসে।
সিলেটের শিলাবৃষ্টি কি স্বাভাবিক আকারের?
রোববার সিলেট ও সুনামগঞ্জে যে শিলাবৃষ্টি হয়েছে তা খুব বেশি বড় নয় বলে জানান আবহাওয়াবিদরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক সিলেটে যে আকারের শিলাবৃষ্টি হয়েছে তা স্বাভাবিক বলে মনে করছেন।
তিনি বলেন, “ এর আগে ২০১৫ সালে সাতক্ষীরায় শিলাবৃষ্টিতে পাঁচ হাজার পাখি মারা গেছে। আমাদের আরো অনেক রেকর্ড আছে ”।
“সাধারণত হাফ ইঞ্চি পর্যন্ত হয় শিলাবৃষ্টির সাইজ। সাধারণত এক থেকে একশ গ্রাম পর্যন্ত হয় এর আকার” জানিয়ে সিলেটের শিলাবৃষ্টি স্বাভাবিক আকারের বলে মনে করছেন মি. মল্লিক।
বাংলাদেশে বিশেষ করে নওগাঁ, সাতক্ষীরা, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট,মাদারীপুর, ফরিদপুর, ঢাকা এসব এলাকায় মার্চ, এপ্রিল, মে মাসে এমনকি জুন – জুলাই মাসেও বজ্রমেঘ তৈরি হয়ে শিলাবৃষ্টি হয় বলে জানান মি. মল্লিক।
সিলেট বিভাগের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসাইন বলেন, “ শিলা বৃষ্টির সাইজ যে কোন আকারের হতে পারে। এর চেয়ে বড় শিলাবৃষ্টিও হয়। রোববার হাফ ইঞ্চি ব্যাসার্ধে এক ইঞ্চি বৃত্ত আকারের শিলা রেকর্ড করা হয়েছে ”
তিনি বলেন, “মার্চ, এপ্রিল, মে এই সিজনে এ রকম হয়”।
“সিলেট অঞ্চলে বেশি হয় কারণ পাহাড় অধ্যুষিত এলাকা। এ ধরণের এলাকায় উত্তর পশ্চিম থেকে যখন মেঘগুলো আসে তখন পাহাড়ি বাতাস ও অঞ্চলের সাথে সমন্বয় ঘটে শিলাবৃষ্টি বা বজ্রপাতের প্রবণতা এ অঞ্চলে বেড়ে যায়” বলেন মি. হোসাইন।
এই আবহাওয়াবিদ জানান, মার্চ মাস থেকে মে এই তিন মাসকে প্রাক-মৌসুম বলা হয়। এই তিন মাস একই রকমের আবহাওয়ার পূর্বাভাস করা হয়।
“ আবহাওয়ার পূর্বাভাস এই তিন মাস এই রকমই থাকতে পারে। সেটা বিক্ষিপ্তভাবে, অনবরত না। বিক্ষিপ্তভাবে দুই একদিন পর পর থেমে থেমে এই রকমই হতে পারে” বলেন মি. সজিব হোসাইন।
“ যখন হবে কাছাকাছি, হয়তোবা শিলা হতেও পারে নাও হতে পারে। এই প্যাটার্নই মে মাস পর্যন্ত আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ফিক্সড করা প্যাটার্ন” জানান মি. হোসাইন।
সিলটেভিউ২৪ডটকম/ নোমান