আজ ৬ জুন জাতীয় সংসদে আসছে বাজেট ২০২৪-২৫। এই বাজেট নিয়ে নিজদলের পরিকল্পনা ও উচ্চ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন করছেন জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি সার্জেন্ট-অ্যাট-আর্মস ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য স্কোয়াড্রন লীডার (অব.) সাদরুল আহমেদ খান। তিনি ২০০৯ সাল থেকে দীর্ঘ একদশক জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের কাজে সরাসরি জড়িত ছিলেন।
১ সংসদে বাজেট উপস্থাপনের রীতি কেমন হবে?
জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশন শুরু হবে ৫ জুন ২০২৪ এবং বাজেট উপস্থাপন হবে পরদিন (আজ) ৬ জুন। ৬ জুনে মন্ত্রী পরিষদ বৈঠক সচিবালয়ের পরিবর্তে জাতীয় সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের খসড়া বাজেট অনুমোদন হবে। সভায় সভাপতিত্ব করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সময়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদে তাঁর কার্যালয়ে অবস্থান করবেন এবং খসড়া বাজেট সম্বলিত অর্থবিলে তিনি সম্মতি দেবেন। আজ বিকাল ৩টার দিকে সংসদ অধিবেশন শুরু হলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী বাজেট উপস্থাপন করবেন। এটি হবে আওয়ামী লীগ সরকারের চলতি মেয়াদে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের এবং মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়েশা খানের প্রথম বাজেট ।
২ কেমন হবে এবারের বাজেট?
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় পরিহার করে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার উপযোগী বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। ফলে স্বস্তি পাবেন ব্যবসায়ী ও সাধারণ আয়ের মানুষ। এ বাজেটে দ্বাদশ জাতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দেওয়া নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিফলন ঘটবে। এবারের বাজেটের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার।’
৩ কেমন হবে বাজেটের আকার?
এবারের বাজেটের আকার ৮ লক্ষ কোটি টাকা (৮০ বিলিয়ন ডলার) নির্ধারণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। মোট আয় ধরা হবে প্রায় ৫ লক্ষ ৫৫ হাজার কোটি টাকা, সে হিসেব ঘাটতি হবে ২ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকার মতো। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার হতে পারে ২ লক্ষ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। জিডিপি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ৬.৭৫ শতাংশ এবং মুদ্রাস্ফীতি ৬ শতাংশ ধরা হতে পারে। বড় ব্যয়ের এই বাজেটের অর্থ সংস্থান হচ্ছে রাজস্ব আহরণ, আভ্যন্তরীণ ঋণ, বিদেশি ঋণ ও অনুদানের থেকে।
৪ মানুষের দুর্ভোগ কমাতে ভর্তুকি রাখা হচ্ছে কোন কোন খাতে?
ইউরোপে যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন দ্রব্যের দাম বেড়েছে। ডলারের চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের বাজারেও অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। তাই, আসন্ন বাজেটে নিম্নআয়ের মানুষের দুর্ভোগ কমাতে রেকর্ড পরিমাণ ভর্তুকি রাখা হচ্ছে। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। তন্মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৫ হাজার কোটি টাকা, জ্বালানি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি মূল্য পরিশোধ ও প্রণোদনা প্যাকেজ ভর্তুকি বাবদ ৭ হাজার কোটি, খাদ্য ভর্তুকি ৭ হাজার কোটি, কৃষি প্রণোদনা বাবদ ২৫ হাজার কোটি টাকা, প্রবাসী আয় আনায় ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা ভর্তুকি রাখা হতে পারে।
৫ বাজেটে কৃষি খাতে কী কী সুবিধা থাকছে?
অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে প্রাধান্য দিয়ে বাজেট প্রস্তাবনা করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে কৃষি খাতে বরাদ্দ রাখা হতে পারে ৩৫ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের শতকরা ৪.৬৪ শতাংশ। বাজেটে কৃষি প্রণোদনা বাবদ ২৫ হাজার কোটি টাকা রাখা হতে পারে। কৃষকদের কম দামে সার সরবরাহ করতে গিয়েই মূলত এই খাতে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি ব্যয় হবে। এ ছাড়া কৃষি খাতে পল্লি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে যে সেচ দেওয়া হয়, সে বিলের ২০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হবে। কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা বাবদ ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এরমধ্যে ৫৩০ কোটি টাকা সার, বীজ ও চারা বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হবে। আর ৭০ কোটি টাকা দেওয়া হবে। অনুদানে, খরা, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এই অনুদান দেওয়া হবে। হাওর এলাকার কৃষকদের জন্য শতকরা ৭০ ভাগ এবং অন্য এলাকার কৃষকদের জন্য ৫০ ভাগ সহায়তা দিয়ে ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষিযন্ত্র সরবরাহ করার প্রস্তাব থাকবে। কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডের আওতায় ২ কোটি কৃষককে স্মার্ট কার্ড দেওয়ার উদ্যোগ থাকবে।
রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, সকল প্রকার স্পেয়ার মেশিন এবং পটেটো প্লান্টার আমদানির ক্ষেত্রে আগাম কর (এটি) অব্যাহতি প্রস্তাব করা হতে পারে। বীজ, কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণ আমদানিতে শুল্ক হার অপরিবর্তিত থাকতে পারে। কৃষি পণ্য উৎপাদন বাড়াতে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে ৪ শতাংশ সুদে কৃষি ঋণ বিতরণের আদেশ অব্যাহত থাকতে পারে।
৬ বাজেটে খাদ্য খাতে কী কী সুবিধা থাকছে?
বাজেটে খাদ্য খাতে ২২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হতে পারে। খাদ্য নিরাপত্তায় ওএমএস, ভিজিডি, ভিজিএফ, কাবিখা, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি রয়েছে এবং উপকারভোগীর সংখ্যাও বাড়ানো হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৬০ লক্ষ বয়স্ক উপকারভোগী মাসে ৬০০ টাকা হারে, ২৮ লাখ ৭৫ হাজার বিধবা উপকারভোগী ৫৫০ টাকা হারে ও ৩২ লাখ ৩৪ হাজার প্রতিবন্ধী উপকারভোগী ৮৫০ টাকা হারে, ১ লাখ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ৯০০-১৩৫০ টাকা উপবৃত্তি পেতে পারেন। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সব টাকা উপকারভোগীর জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে নিবন্ধিত মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে দেয়ার ব্যবস্থা করবে সরকার। এ ছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য চলমান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রির ব্যবস্থা।
৭ ভোজ্যতেল নিয়ে কোনো পদক্ষেপ থাকছে কী?
ভোজ্য তেল উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীল হবার লক্ষে কাজ করছে সরকার। এ উপলক্ষে তিন বছর মেয়াদি কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করা হবে। তেল জাতীয় শস্যের উৎপাদন বাড়াতে থাকছে বিশেষ উদ্যোগ। এ ছাড়া ভালো মানের বীজ সরবরাহ এবং জমিতে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ করে সরিষা, তিল, তিসি, চীনা বাদাম, সূর্যমূখী ও সোয়াবীন চাষে প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে। নিত্যপণ্যের দাম ভোক্তার নাগালে রাখতে বাজার মনিটরিং অব্যাহত থাকবে। ভোজ্য তেলের কাঁচামাল আমদানিতে ৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে।
৮ প্রবাসী রেমিট্যান্স দেশে আনার পরিকল্পনা কী?
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতির অন্যতম স্রোতধারা। প্রবাস থেকে রেমিট্যান্স পাঠানো সহজ করতে এবং রেমিট্যান্সের বিপরীতে প্রণোদনা ২.৫ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হতে পারে। এবারের বাজেটে প্রবাসী আয় দেশে আনা বাবদ ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা ভর্তুকি রাখা হতে পারে। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের প্রথম দশ (জুলাই-এপ্রিল) মাসে ১ হাজার ৯১১ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪০ কোটি ডলার বেশি। ডলারের দাম ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে সরকার ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ঘোষণা করেছেন, ফলে হুন্ডি ব্যবসায় ধস নেমেছে। ব্যাংক চ্যানেলে শুধুমাত্র ‘মে ২০২৪’ মাসেই দেশে এসেছে ২ বিলিয়ন ডলার। আসছে বাজেটেও প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সম্মানীত করতে এবং বিদেশে নতুন শ্রম বাজার খোজার ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর সরকার। একজন প্রবাসী যাত্রী ৪ হাজার টাকা শুল্ক পরিশোধ করে দেশে ১১৭ গ্রাম স্বর্ণ আনতে পারবেন।
৯ রফতানি আয় বৃদ্ধির পরিকল্পনা কী ?
চলতি অর্থবছরের রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সক্ষমতার নতুন মাইল ফলক অর্জন করেছে। ২০২৪-২৫ এর বাজেটে পণ্য ও সেবা দু’খাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৮০ বিলিয়ন ডলার। ২০২৬ সালে এলডিসি গ্রাজুয়েশন হতে পারে বাংলাদেশের, তখন থেকে রপ্তানিতে কোনো প্রণোদনা দিতে পারবে না সরকার। এই পরিবর্তন মোকাবিলায় রপ্তানিখাতকে প্রস্তুতি নিতে উদ্বুদ্ধ করতে সরকার চলতি অর্থবছরে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্নখাতে রপ্তানি প্রণোদনার হার কমাবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রপ্তানিতে প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ রাখা হতে পারে ৭ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা।
১০ কর ও ভ্যাট কী বাড়বে ?
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে এনবিআরকে আহরণ করতে হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। আসন্ন বাজেটে ব্যক্তি পর্যায়ে করমুক্ত আয়সীমা বাড়বে না, সাড়ে ৩ লাখ টাকা অপরিবতিত থাকতে পারে। ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের আয় বছরে সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি থাকলে ৩০ শতাংশ আয়কর দিতে হতে পারে।
শূন্য শুল্কহারবিশিষ্ট প্রায় তিন শতাধিক পণ্যের ওপর ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হতে পারে। এ তালিকায় রয়েছে চাল, গম, ভুট্টা, সরিষা বীজ, পরিশোধিত সয়াবিন, পাম অয়েল, সানফ্লাওয়ার বীজ, তুলাবীজ, বিভিন্ন শাক-সবজির বীজ, ক্রুড অয়েল, সার, প্রাকৃতিক গ্যাস, বিটুমিন, কয়লা, জিপসাম, ভিটামিন, ইনসুলিন, ওষুধ এবং ভ্যাকসিন ও ওষুধের কাঁচামাল, বিভিন্ন রাসায়নিক ইত্যাদি।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ৪০ লাখ টাকার বেশি মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স আরোপের সিদ্ধান্ত থাকতে পারে। সফট ড্রিংকস বা কার্বোনেটেড বেভারেজের ওপর ন্যূনতম কর ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে।
বর্তমানে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে প্রবেশে এবং রাইডে চড়তে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপিত আছে, এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এনার্জি ড্রিংকস, ফলের জুস, আমসত্ত্বের এসব পণ্যের ওপর বর্তমানে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে, এটি বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। নিরাপত্তাসেবার ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা ই-কমার্স মারকেটপ্লেস ভ্যাটের আওতায় আসতে পারে। ল্যাপটপ-কম্পিউটার আমদানিতে শুল্ককর কমিয়ে ২০ শতাংশে আনা হতে পারে।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরে করপোরেট সাড়ে ২৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হতে পারে। কর ও ভ্যাট প্রদান করতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা যেসব সমস্যায় পড়তেন, সেক্ষেত্রেও ব্যবসাবান্ধব কিছু পদক্ষেপ আসছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করতে কর ও ভ্যাট আদায়ে ডিজিট্যাল পদ্ধতির উপর জোর দেয়া হবে। অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কও মুসক হার কমলেও বাড়বে বিদেশ থেকে আনা গাড়ির , আসবাবপত্র, ফল, ফুল, পানীয় ইলেক্ট্রনিক্সের মতো বিলাসী পণ্যের। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সব ধরনের দ্রব্যের দাম কমবে। আর সিগারেট, বিড়ি ও জর্দার মতো পণ্যের দাম বাড়বে। দামি কসমেটিক্স পণ্য আমদানিতে শুল্কহার বাড়লেও কমবে সব ধরনের ভোগ্যপণ্য বিশেষ করে চাল, ডাল, পেঁয়াজ ইত্যাদি। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখতে পারলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর ও ভ্যাট ছাড় পাবেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের বার্ষিক লেনদেনেও কর ছাড় আসছে।
১১ আবগারি শুল্ক বাড়বে কী?
বাজেটে ব্যাংকে রাখা ১০ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত তিন হাজার টাকা আবগারি শুল্ক বসতে পারে। ৫০ লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত পাঁচ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক বসতে পারে। এক কোটি টাকা থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ১০ হাজার টাকা এবং দুই কোটি টাকা থেকে পাঁচ কোটি পর্যন্ত ২০ হাজার টাকা বসতে পারে। কারও ব্যাংক হিসাবে বছরে একবার যদি স্থিতি পাঁচ কোটি টাকা অতিক্রম করে, তাহলে আবগারি শুল্কের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা করা হতে পারে।
১২ বিদেশ ভ্রমণ শুল্ক বাড়বে কী?
আসছে বাজেটে বিদেশ ভ্রমণ শুল্ক অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আকাশ পথে বিদেশ ভ্রমণে কর সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ২ হাজার টাকা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৪ হাজার টাকা এবং অন্যান্য দেশে ৬ হাজার টাকা করা হতে পারে । স্থলপথ অথবা জলপথে কোনো দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ১ হাজার টাকা কর আরোপ থাকতে পারে।
১৩ সংযোজন শিল্প শুল্ক বাড়বে কী?
যেসব প্রতিষ্ঠান মুঠোফোন সংযোজন করে যেমন কমপক্ষে দুটি যন্ত্রাংশ নিজেরা বানিয়ে মুঠোফোন তৈরি করলে এখন ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হতে পারে। অন্যদিকে যারা সব যন্ত্রাংশ আমদানি করে শুধু দেশে সংযোজন করে সেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে।
১৪ গাড়ি আমদানি শুল্ক ও কার্বন টেক্স বাড়বে কী?
২০০১ থেকে ৩০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির সম্পূরক শুল্ক ২০০ থেকে বাড়িয়ে ২৫০ শতাংশ এবং ৩০০১ থেকে ৪০০০ সিসি পর্যন্ত ৩৫০ থেকে বাড়িয়ে ৫০০ শতাংশ করা হতে পারে। ২০০১ থেকে ৪০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির সম্পূরক শুল্ক বাড়তে পারে। একই মালিকের দ্বিতীয় গাড়ির অগ্রিম কর বাড়ানোর প্রস্তাব আসছে, বসবে কার্বন ট্যাক্স।
১৫ মোবাইল ফোনের কল খরচ বাড়বে কী?
মোবাইল ফোন কলের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়তে পারে যা বর্তমানের ২৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০.৬৫ শতাংশ হতে পারে। সহজ কথায় গ্রাহক ১০০ টাকা দিয়ে মোবাইল রিচার্জ করলে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ কেটে নেওয়ার পর ৬৯ টাকা ৩৫ পয়সার টক টাইম পেতে পারেন।
১৬ মেট্রোরেলে ভ্যাট আরোপ হবে কী?
ঢাকাবাসীর সবচেয়ে নিরাপদ ও জনপ্রিয় বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে মেট্রোরেল। শুধু নাগরিক প্রশান্তিই নয়, এখন দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবে ঢাকা মেট্রোরেল। এ সেবায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসাতে পারে এনবিআর।
১৭ করপোরেট ও ব্যক্তি পর্যায়ে কর কেমন হবে?
অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, সরবরাহ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে এবারও করপোরেট করের হার লিস্টেড এবং নন-লিস্টেড কোম্পানির জন্য অপরিবর্তিত রাখা হতে পারে। তালিকাভুক্ত কোম্পানির করমুক্ত লভ্যাংশের সীমা অপরিবর্তিত থাকতে পারে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার ভ্যাটমুক্ত সীমা অপরিবর্তিত থাকতে পারে। অন্যদিকে সারচার্জের হার ও সীমা পুনর্বিন্যাস করা হতে পারে।
ভ্যাট রিটার্ন অনলাইনে দাখিল করা বাধ্যতামূলক থাকবে। ই- পেমেন্ট ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হবে। তবে রিটার্ন দাখিল ই-টিআইএনের পাশাপাশি রিটার্ন প্রাপ্তি স্বীকার বা কর সনদ চালু থাকবে। ভ্যাটের আওতা বাড়াতে ইলেক্ট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইসের (ইএফডি) ব্যবহার বাড়ানো হবে। প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকিং লেনদেনের সঙ্গে আমদানি-রফতানি, ভ্যাট পরিশোধের তথ্য মিলিয়ে দেখতে বিজনেস ইন্টেলিজেন্স সফটওয়্যার ব্যবহারের বাড়ানো হবে। অডিটের তথ্য খতিয়ে দেখতেও এ প্রযুক্তি ব্যবহার হবে।
১৮ অপ্রদ্রশিত অর্থ মূলধারার অর্থনীতিতে আনার উদ্যোগ আছে কী?
এতোদিন নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ও জমি-ফ্ল্যাট ক্রয় করে অপ্রদরশিত আয় বিনিয়োগ করার সুযোগ ছিল। এ ছাড়া নগদ টাকা বা সঞ্চয়পত্র ও নানা ধরনের আমানতের ওপর ২৫ শতাংশ কর ও করের ওপর ৫ শতাংশ জরিমানা দিয়ে বিনিয়োগের সুযোগ ছিল। আগামী অর্থবছরে আসতে পারে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার করার সুযোগ। ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে যে কেউ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ পেতে পারে। অর্থনৈতিক অঞ্চল বা হাইটেক পার্কে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে।
১৯ বাজেট বাস্তবায়নে কতটুকু আশাবাদী?
গত পাঁচবছর ধরে করোনা, ইউরোপের যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও একের পর এক রেকর্ড তৈরির বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে বাংলাদেশ। মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ চলেছে পুরোদমে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো স্বপ্নের প্রকল্পের ইতিমধ্যে উদ্বোধনও হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বড় বড় প্রকল্পেগুলোর আশানুরূপ বাস্তবায়নের সক্ষমতায় সরকার এখন অন্য যেকোনো সময়ের চাইতে বেশি আত্মবিশাসী। আর এটা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পরিশ্রমী বীর বাঙালি জাতির অক্লান্ত ঘাম আর জননেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ হাতে দেশ পরিচালনায়।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ ৬ জুনের বাজেট দেশবাসীর জন্য নিয়ে আসছে একগুচ্ছ সুখবর। যতো চ্যালেঞ্জই হোক না কেনো সরকারের বাজেট হবে জনবান্ধব।
লেখক: সাদরুল আহমেদ খান, সদস্য, অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ-কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ