সমাজের যাঁরা বিশিষ্টজন বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ তাদের মতো করে আমি কোনো কিছু দেখতে না-পেলেও এবং তাদের মতো করে ব্যাখ্যা করতে না-পারলেও আমার আছে সাধারণের চোখ এবং আমিও কিছুটা উপলব্ধি করতে পারি। চলার পথে নিজের চোখে যা দেখি আর কানে যা শুনি তাতে যতোটা সংকট উপলব্ধি করি, তার চেয়েও বেশি সংকট দেখি একজন রিকশা চালক কিংবা একজন সবজি বিক্রেতার সাথে কথা বলে। প্রতিদিন সংবাদ পত্র, অনলাইন নিউজ পোর্টাল আর টেলিভিশনে যা দেখি শুনি তাতে সংকটের যে চিত্র ভেসে উঠে তাতে ভয় জাগে।
সবমিলিয়ে মনে হয় সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি আমরা সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশ। সংকট থেকে মুক্তির আশায় সময় পার অনেক হলো। কিন্তু সংকট থেকে মুক্তি মিলেনি। আমরা যেনো এক দীর্ঘ অন্ধকার আঁকাবাঁকা গা ছমছমে গুহায় আটকে এলোপাতাড়ি দৌড়াচ্ছি। আমরা যেনো অন্ধকার গুহার ওইপাড়ে এখনও কোনো আশার ছিদ্র দেখতে পাচ্ছি না, যেখানে আছে সংকট থেকে বের হওয়ার সম্ভাবনাময় আলোর নিশান। তবে কি এভাবেই চলবে! এখন আমরা যেভাবে এগুচ্ছি সেভাবে আর-ও কতোটা পথ পাড়ি দিয়ে সংকট থেকে মুক্তির আলোক চিহ্নটুকুর দেখা মিলবে?
সবখানেই সংকট। শিক্ষার্থীদের আছে লেখাপড়া শেষ করে কর্মের সংকট। বেকারত্ব সমস্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। তাইতো যে শিক্ষার্থীরা প্রাণ ভরে 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গেয়ে ছাত্র জীবন শুরু করে তাদের বড়ো একটা অংশ লেখাপড়ার পাঠ চুকানো শেষ হলে এই প্রিয় স্বদেশ ছেড়ে পাড়ি দেয় পরদেশে শুধুমাত্র নিজে ভালোভাবে বাঁচতে ও মা-বাবার দায়িত্ব পালন করতে। খুব কষ্ট করে বিদেশে পরে থাকে বছরের পর বছর। ওদের জীবন যদি এখানে সংকটাপন্ন না-হতো তাহলে ওরা বিদেশে মধ্যপ্রাচ্যে ভবন নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কিংবা মরুভূমিতে গাছে পানি দিতে যেতো না।
এদেশে হাজার রকম সংকট দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলমান। শেয়ার মার্কেটে লক্ষ লক্ষ বিনিয়োগকারী ২০১০ খ্রীষ্টিয় সালে সব হারিয়ে পথে বসে, অনেকে আত্মহত্যার পথ ধরে। সেই শেয়ার মার্কেট আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। কৃষকদের সংকট যেনো প্রতি বছরের নিত্য সঙ্গী। বাংলাদেশের বাজেটে প্রতি বছর হাওরের ফসল রক্ষার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে আসছে স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছর ধরে। এসব হাওর দেখভাল করার জন্যে যে প্রকৌশলী আছেন, অল্প কয়েক বছরে তাদের একেকজনের বড়ো বড়ো শহরে এক বা একাধিক বাড়ি গাড়ি হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের হাওরে ফসল ফলায় যে কৃষক তাদের ভাঙ্গা ঘরে বছরের তিনমাসের ধান জমা হয় না। কৃষকের কান্নার আওয়াজে বাতাস ভারী হয় প্রতি বছর। প্রকৌশলী কতো টাকা বেতন পান সারাজীবন সরকারি চাকরি করে যে তাদের এতো সম্পদ হয়ে যায়! প্রশ্ন জাগে সচেতন কৃষকের মনে। কার কথা বলি আর কার কথা বলি না, মনে থাকার কথা, অনেক বছর আগে এক পুলিশ কর্মকর্তার বেপরোয়া কন্যা ঐশী'র জীবন প্রবাহ।
এখন প্রতিদিন প্রায় সকল পত্রিকা ও টেলিভিশনে আলোচিত হচ্ছে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বেনজির আহমেদ নিয়ে। তদন্তে আছে দুদক। কিন্তু এসব কিছুই আমাদের সমাজের আমাদের দেশের সংকট। শুধু সরকারি চাকরিজীবী নয় দুর্নীতিতে জড়িয়ে আছেন নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকগণ। আমি নির্দিষ্ট কোনো ব্যবসায়ী কিংবা কোনো দলের কথা বলবো না। তবে দুর্নীতির কারণে অনেকে সাজা ভোগ করছেন আবার কেউ কেউ মামলা লড়ছেন। রাজনীতিকগণের দুর্নীতির কারণে দেশের উন্নয়ন মুখ থুবরে পড়ে এবং দেশে ও বিদেশে শ্রেষ্ঠ দুর্নীতির খেতাব বাংলাদেশের কপালে জুটেছে বহুবার। এমনি সংকটময় অবস্থায় আমি চিন্তা করে পাই না সংকট নাই কোথায়। ঠিকাদার ও প্রকৌশলী মিলে দুর্নীতি করলো। ব্যবসায়ীদের কথা না-বললে হয় না। দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক গতি আর খাদ্য মজুদের কারণে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে উঠলো দুর্বিষহ।
তবে যারা লুটেরা তাদের ঘরে যে ষোলআনা সুখ আসেনি সে খবরও আমরা পাই। এখানে দুর্নীতিবাজদের অনেকের স্ত্রী - সন্তান হলো বেপরোয়া। পিতামাতার অনৈতিক জীবনাচার আর অবৈধ টাকার জোরে শিকড় ছাড়া জীবনে চলতে চলতে একেক জনের পরিবার আর সুখময় রইলো না। রাজধানী ঢাকা সহ দেশের শহরাঞ্চলে লেখাপড়া করা ও অর্থের আধিক্যের মধ্যে থাকা স্ত্রী নিজে স্বপ্রণোদিত হয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে স্বামী বেচারার গায়ে শীল মেরে দিচ্ছেন স্ত্রী পরিত্যক্ত পুরুষ। পত্রিকায় এমন খবরও ছাপা হয়। সংকট আর সংকট।
আমি যতোটুকু দেখি তার চেয়ে বেশি পত্রিকায় লেখা ছাপা হয়। আমরা জানি, যা-ই ঘটুক নেতৃত্বকে দায় নিতে হয়। সাংবাদিক কামাল আহমেদ ৬ জুন ২০২৪ প্রথম আলো ৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, 'রাজনীতি ও দুর্নীতি দায় না নেওয়ার ঘোষণায় দায়মুক্তি হয় না।' হ্যাঁ, কাউকে নিশ্চয়ই দায় নিতে হবে। আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও সংকট। তাই দেশের সুনামধন্য নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, 'রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে...।'
আমাদের অর্থনৈতিক সংকট প্রকট। ড. মাহবুব উল্লাহ ১৩ জুন ২০২৪ যুগান্তর পত্রিকায় লিখেছেন, ' সংকট মোকাবিলায় বিচক্ষণতার অভাব দেখা যাচ্ছে'। বহু রকম সংকট নিয়ে লিখে চলেছেন দেশের জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিগণ। আমরা কি অস্বীকার করতে পারি যে, আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে সংকট চলছে। তা না-হলে প্রতি বছর পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে একেক রকম ঘোষণা কেন হবে! এসব সংকট দ্রুত কাটিয়ে উঠতে না-পারলে আরও অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছি। আমাদের অল্প আয়তনের বাংলাদেশের জন্য দেশের জনসংখ্যা হিসেবে এটি একটি জনবহুল দেশ। আমাদের সম্পদও কম। এর উপর মরার উপর খাঁড়ার ঘা মায়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বছরের পর বছর আমাদের সামাজিক ও পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গারা নানান সংকট সৃষ্টি করেছে। বিশিষ্ট পরিবেশ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আমাদের জন্য আগামীতে আরও ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে। এতোগুলো বছর পেরিয়ে গেছে এখনও কেন আমরা কূটনৈতিক সমাধানে পৌঁছাতে পারিনি!
সত্য কথা বলতে হয়, আমাদের দেশের সবচেয়ে বড়ো সংকট চলছে রাজনীতিতে। এ কথা স্বীকার করতে হবে, বর্তমান বিশ্বের সবকিছুই রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত। আর কোনো দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য নূন্যতম দুটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা না-হলে-তো বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। আশার কথা হলো, বাংলাদেশে অনেক ছোটো ছোটো রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি আছে এবং সবচেয়ে সম্ভাবনাময় যে দিকটা সেটা হলো, বাংলাদেশে আছে দুটি পরীক্ষিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যাদের পিছনে আছে দেশের কোটি কোটি মানুষের সমর্থন। একটি হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং অপরটি হচ্ছে বহুবার স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারে অধিষ্ঠিত থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বিগত বছরগুলোতে বিএনপি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। আমি মনে করি, দেশের দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের একটি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না-করা আমাদের জন্য একটা বড়ো সংকট। সাধারণ লোকে বলে রাজনীতির নাকি লক্ষ প্যাঁচ। তাই এ বিষয়ে বক্তাকে বলতে হয় সাবধানে এবং লেখককে লিখতে হয় সতর্কতার সাথে। আমি একজন সাধারণ মানুষ এতোসব বুঝি না। তবে এটুকু বলতে পারি, দেশের বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেশ চালালে, সকল সংকট একেবারে নির্মূল না-হলেও, সংকটের বেপরোয়া লাগাম টেনে ধরা যায় এবং তখনই সংকট আরও ঘনীভূত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে দেশ। আমাদের এখন সরকার আছেন আমাদের অভিভাবক। সকলে মিলে আগামী নির্বাচন করার দায়িত্ব-তো নিতে হবে। তবে তাই হোক, সংকট থেকে মুক্তির আলোর মশাল জ্বলুক।।
লেখক : মোহাম্মদ আব্দুল হক, কলামিস্ট ও কথা সাহিত্যিক