প্রথমে জানতে চেষ্টা করি প্রকৃতপক্ষে ভাষা মানে কি? ভাষা হল; বাগযন্ত্রের দ্বারা উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। ভাষা মানে কোন সম্প্রদায়ের মানুষ যখন তাদেঁর নিজেদের মাঝে ভাব বিনিময়ের মাধ্যম বা নিজেদের মধ্যে বুঝাবুঝির মাধ্যম হিসেবে যে ধ্বনি বা সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে তাই হল ভাষা।যাইহোক, বুঝা গেল ভাষার অর্থ এবং এদিকে ইন্টারন্যাশনাল এথনোলগ গাইড অনুযায়ী এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ১৯৫টি দেশের বিভিন্ন জাতি গোষ্টীর মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে হিসেবে এখনো পর্যন্ত অফিসিয়ালি ৭১৩৯ টি ভাষা রয়েছে।
ভাষা নিয়ে এখন ছোট্ট একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি এই ঈদের দিন বাংলাদেশি এক সিনিয়রের সাথে কথা হচ্ছিল উনি ভাল আরবি ও বাংলা জানেন। উনার কথা হলো বাংলা ভাষায় অনেক আরবি শব্দ ঢুকেছে তবে বিকৃত ভাবে বা ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়।
যেমনঃ ‘জনাবা’ এর অর্থ হল অপবিত্র কিন্তু আমরা সম্মানার্থে ব্যবহার করি। তখন আমি বলেছিলাম তাতে তো কোন সমস্যা নেই। অনেক শব্দ ভাল অর্থেও ব্যবহার করা হয়। আর আমরা এটি বাংলা হিসেবে ব্যবহার করি এবং বাংলাতে পুরুষ বাচক ‘জনাব’ শব্দকে রুপান্তর করে স্ত্রী বাচক ‘জনাবা’ শব্দকে নারীদেরকে সম্মানার্থে ব্যবহার করি। তাতে তো কোন সমস্যা দেখছি না।এখন উনি বলেন ‘জনাবা’ শব্দ নাকি বাংলা অভিধানে নেই। বললাম দেখেন; যে দিন এই পৃথিবীতে বাংলা অভিধান তো দূরের কথা বাংলা ভাষার অক্ষরও আবিষ্কার হয়নি সেদিনও মানুষ বাংলায় কথা বলতো। বাংলা অভিধানে থাকা কোন আবশ্যক বিষয় নয়।অভিধানে থাকা না থাকা ভাষার কোন প্যারামিটার নয়। তখন আবার তিনি বলেন আরবি কোরআনের ভাষা।আবার একই বিষয় বললাম যে, আরবিও একটি ভাষা, যে দিন এই পৃথিবীতে কুরআন নাজিল হয়নি সেদিন থেকেও হাজার হাজার বছর পূর্বেও মধ্য প্রাচ্যের বেদুইনরা আরবি ভাষায় কথা বলতো। তাছাড়া এটি কুরআনের কোন বিষয়বস্তু নয় বা কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিকও নয়। আসলে ভাষাবিদের মতে ভাষা হল নদীর স্রোতের মত পরিবর্তনশীল এবং এক ভাষার শব্দ আরেক ভাষায় ভ্রমণ করে অনেক সময় একই অর্থ থাকে অথবা অর্থের ভিন্নতা আসে যাকে ’শব্দের ভ্রমণ’ বলে। যার কারণে অনেক সময় এক ভাষার বুলি আরেক ভাষায় গালিতে পরিনত হয়। আবার এর বিপরীতও আছে যেমন এক ভাষার গালি বা খারাপ অর্থের শব্দ আরেক ভাষায় অনেক ভাল অর্থে ব্যবহৃত হয়।
যেমন; টার্কিশ ভাষায় মধুকে বলে ‘বাল’ আবার হিন্দিতে দাড়ি বা চুলকে বলে ‘বাল’ আর আমরা বাল শব্দকে গালি হিসেবে ব্যবহার করি। আবার দেখেন ‘আম’ আমাদের কাছে কত সুস্বাদু একটি ফল কিন্তু টার্কিশ ভাষায় ‘আম’ শব্দটি খুবই লজ্জাস্কর একটি শব্দ। এছাড়া টার্কিশ ভাষায় ‘হালা’ মনে ফুফু আর আমরা ‘হালা’ কি হিসেবে ব্যবহার করি? একই ভাবে ফ্রেঞ্চ ভাষায় ‘কাকা’ মানে পায়খানা কিন্তু আমাদের ভাষায় ‘কাকা’ মানে চাচা।
অন্যদিকে ফ্রেঞ্চ ভাষায় ‘গু’ মানে স্বাদ বা taste আর আমরা তা কি হিসেবে ব্যবহার করি ? আবার ফ্রেঞ্চ,টার্কিশ, স্পেনিশ ও ইংলিশ ভাষার অনেক শব্দ এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় প্রবেশ করেছে এবং একই অর্থে বা ক্ষেত্র বেধে ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। টার্কিশ ভাষায় ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, ল্যাটিন, ফার্সি এবং আরাবি ভাষার অনেক শব্দ প্রবেশ করেছে। একই ভাবে ইংরেজি এবং ফ্রেঞ্চ ভাষা দুটিতে দুভাষারই ৫-৬ থেকে হাজার শব্দ প্রবেশ করেছে। তো কি দাঁড়াল আসলে ? তার মানে ভাষা নদীর স্রোতের পরিবর্তনশীল ও বহমান। তা যে কোন একাডেমিই বা অভিধান সবসময় নির্ধারণ করে বা ফরম্যাট করে চাপিয়ে দিলে ভাষা সেটি কোন ভাষার শুদ্ধ বা অশুদ্ধতা নির্ধারণ করবে তেমন মোটেও নয়। বরং তা একটি ভাষার সমৃদ্ধ হওয়ার অন্তরায়। যা আমরা স্পষ্টতই দেখতে পাই ইংরেজির ভাষার ক্ষেত্রে এবং ‘নিউ ইয়র্ক টাইমসের’ গবেষণায় বেরিয়ে আসছে প্রতি ৯৮ মিনিটে ইংরেজিতে একটি নতুন শব্দ প্রবেশ করে যা প্রতি দিনে প্রায় ১৪-১৫ টি শব্দ হয়। যার জন্য ইংরেজি ভাষা নিয়ন্ত্রণের জন্য আজ পর্যন্ত কোন ফরমাল বা অফিসিয়াল রেগুলেটরি বডি অথবা ইনস্টিটিউট নেই।
কারণ হিসেবে বৃটিশ নীতিনির্ধারকরা বলে থাকেন যে ভাষা নিয়ন্ত্রণ তা সমৃদ্ধির অন্তরায়।এখন বুঝা গেছে ? তারা যে আসলেই “বৃটিশ” এবং তাদেঁর ভাষা আজ দুনিয়ার ভাষা কেন হয়েছে?
লেখক: কাওসার আহমেদ, প্রবাসী সাংবাদিক