সিলেটে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুন মহানগরের বন্দরবাজারে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় গুলিতে নিহত হন দৈনিক নয়া দিগন্তের প্রতিনিধি ও জালালাবাদের স্টাফ রিপোর্টার এটিএম তুরাব। নিহত হওয়ার ১০ দিনের মাথায় প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে তাঁর পরিবারকে দেওয়া হয়েছেন আর্থিক অনুদান। 

 



রবিবার (২৮ জুলাই) দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আর্থিক অনুদান গ্রহণ করেন তুরাবের বড় ভাই আবুল আহসান জাবুর। বিষয়টি তিনি নিজে সিলেটভিউ-কে নিশ্চিত করেছেন।

 

জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সারা দেশে (সরকারি হিসেবে) নিহত ৩৪ জনের পরিবারের সদস্যের হাতে রবিবার দুপুরে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুদান তুলে দেন। অনুদানের মধ্যে ছিলো পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের ১০ লাখ টাকার চেক ও নগদ ৫০ হাজার টাকা।
 

 

এ সময় প্রধানমন্ত্রী নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের খোঁজ-খবর নেন। অনেকে এসময় প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আবেগাপ্লুত প্রধানমন্ত্রীর চোখেও তখন অশ্রু দেখা যায়।


আবুল আহসান সিলেটভিউ-কে জানান, শনিবার সিলেটের জেলা প্রশাসক আমাদের খবর দেন এবং সরকারি খরচে উড়োজাহাজে আমরা ঢাকায় পৌছাই। আজ দুপুরে গণভবনে আমার হাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নগদ ৫০ হাজার টাকা ও সঞ্চয়পত্রের ১০ লাখ টাকার চেক তুলে দেন।

 

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে সৃষ্ট আন্দোলনে ১৭ জুলাই থেকে সিলেট পরিণত হয়েছিল রণক্ষেত্রে। ১৯ জুলাই (শুক্রবার) সিলেটে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ওইদিন জুমার নামাজের পর কোটা আন্দোলন ইস্যুতে মহানগরের কোর্ট পয়েন্ট থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠন এবং খেলাফত মজলিস। মিছিলটি জিন্দাবাজার অভিমুখে রওয়ানা হয়। মিছিলকারীরা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ভুয়া ভুয়া বলে স্লোগান দেয় এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ওই সময় কোর্ট পয়েন্টে অবস্থান করছিল পুলিশ। তখন এসএমপির সহকারী কমিশনার গোলাম মোহাম্মদ দস্তগীরের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরা পেছন থেকে মিছিলে টিয়ারশেল ও গুলি ছুঁড়েন। এসময় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের ছররা গুলিতে গুরুতর আহত হন সাংবাদিক এটিএম তুরাব।

 
গুরুতর অবস্থায় সহকর্মীরা তাকে এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ঘণ্টা দুয়েক পর পরিবারের সিদ্ধান্তে তাকে সহকর্মীরা মহানগরের সোবহানীঘাট এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন সেখানের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। 


পরদিন শনিবার (২০ জুলাই) বেলা ২টায় মহানগরের মানিকপীর (রহ.) মাজার সংলগ্ন এলাকায় তার প্রথম জানাযা শেষে মরদেহ গ্রামের বাড়ি বিয়ানীবাজার পৌর এলাকার ফতেহপুরে নেওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্তানে দাফন করা হয় লাশ। 

 

তুরাবের মৃত্যুর ঘটনায় ২৪ জুলাই তার বড় ভাই বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়েরের উদ্দেশে কোতোয়ালি থানায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।  তবে পুলিশ সেটি জিডি (সাধারণ ডায়েরি) হিসেবে নেয়। অভিযোগপত্রে ৮-১০ অজ্ঞাত পুলিশকে অভিযুক্ত করেছেন তুরাবের ভাই। 

 

অভিযোগে বাদী উল্লেখ করেন -১৯ জুলাই দুপুর ১ টা ৫৫ মিনিটের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য মহানগরের বন্দরবাজার এলাকার কোর্ট পয়েন্টে অবস্থান করছিলেন তুরাব। এক পর্যায়ে বিএনপির মিছিল শুরু করলে তুরাব মিছিলের পিছনে অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে অবস্থান নেয়। মিছিলটি পুরানলেন গলির মুখে পৌঁছলে সশস্ত্র পুলিশ বিপরীত দিকে অবস্থান নেয়। ওই সময় হঠাৎ লাগাতার গুলিবর্ষণের শব্দ শুনা যায় এবং তুরাব চিৎকার করে মটিতে লুঠিয়ে পড়ে। তখন সহকর্মী ও পথচারীরা তাকে দ্রুত সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসাতালে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় এবং তার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য মহানগরের সোবহানীঘাট এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় ওই দিন সন্ধ্যা ৬টা ৪৪ মিনিটের সময় সে মৃত্যুবরণ করে। গোলাগুলির স্থিরচিত্র ও ভিডিও চিত্র সেদিন সেখানে কর্তব্যরত সাংবাদিকদের কাছে রয়েছে।  


অভিযোগ দায়েরের পরদিন কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মঈন উদ্দিন শিপন সিলেটভিউ-কে বলেন- এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে আগেই একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সেটির তদন্ত চলছে। বুধবার রাতে পরিবারের পক্ষ থেকে দায়েরকৃত অভিযোগটি আমরা রেখেছি এবং জিডি হিসেবে রেকর্ড করেছি। 

 

এক প্রশ্নের উত্তরে ওসি সে সময় বলেন- কার এবং কোন দিক থেকে আসা গুলিতে বিদ্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন, এসব বিষয় তদন্ত করা হচ্ছে। এখনই নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। পরিবারের লিখিত অভিযোগ ও পুলিশের মামলাকে সমন্বয় করে তদন্ত এগুচ্ছে। 


এটিএম তুরাব সিলেটের বিয়ানীবাজার পৌরসভার ফতেহপুর গ্রামের মরহুম আব্দুর রহিমের ছোট ছেলে। তাদের পরিবার বর্তমানে সিলেট  মহানগরের শাহজালাল উপশহর এলাকার যতরপুরে একটি বাসায় বসবাস করেন। 

 

মাত্র দুই মাস আগে বিয়ে হয়েছিল সাংবাদিক এটিএম তুরাবের। বিয়ের কিছুদিন পর দেশ ছেড়ে চলে যান তার যুক্তরাজ্য প্রবাসী স্ত্রী তানিয়া ইসলাম। কথা ছিল, তুরাবকেও সেখানে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করবেন তানিয়া, কিন্তু তা আর হলো না। এমনকি ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় মৃত স্বামীর মুখও দেখতে পারেননি প্রবাসী স্ত্রী।  

 

তুরাবের বড় ভাই আবুল আহসান জানান, গত ১৩ মে বিয়ে করেন তুরাব। বিয়ের এক মাসের মাথায় তার স্ত্রী তানিয়া ইসলাম লন্ডন চলে যান। স্বামীর মৃত্যুর পর সেখানে তানিয়া মুষড়ে পড়েছেন। তুরাবের মৃত্যুর খবর শুনে পরদিনই তানিয়া দেশে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফ্লাইটের টিকিট না পাওয়ায় আসতে পারেননি। এমনকি ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় শেষবারের মতো স্বামীর মুখও দেখতে পারেননি তিনি।

 

এদিকে, তুরাবের মা মমতাজ বেগম ছেলেকে এভাবে হারিয়ে এখনও স্বাভাবিক হতে পারেননি তিনি। বার বার বিলাপ করছেন ও মুর্ছা যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। 

 

কাউকে পেলেই তিনি প্রশ্ন করছেন, ‘পুলিশ কেন আমার ছেলেকে মারল?’

 

তুরাবের লাশের ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান শামসুল ইসলাম জানিয়েছেন, নিহতের শরীরে ৯৮টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। গুলিতে তার লিভার ও ফুসফুস আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মাথায় ঢিলের আঘাতও ছিল। 

 


সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডালিম