গত ৬ জুন সিলেটের জালালাবাদ থানাপুলিশ ১৪টি ট্রাকভর্তি ভারতীয় চোরাই চিনির সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে বড় চালান জব্দ করে। বিশাল চালানটি গত ৩ জুলাই সিলেটের আদালতে নিলামে বিক্রি হয়। এদিন বাজারমূল্য থেকে বাড়তি দামে চিনিগুলো কিনে আলোচনায় আসেন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লতিবপুরের মৃত উস্তার আলীর ছেলে ও কালিঘাটের চাল ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন। নিলামে কেনা তার চিনির কেজি সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাটসহ দাম পড়ে ১৩২ টাকা পঞ্চাশ পয়সা। অথচ ওই দিন চিনির পাইকারি দর ছিলো প্রতি কেজি ১০২ টাকা।
নিলামের পর ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন বিভিন্ন সংবাদপত্র ও নিবন্ধিত নিউজ পোর্টালে খবরের শিরোনাম হন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তিনি প্রথম থেকেই এড়িয়ে চলছেন সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের। বিভিন্ন সময় সাংবাদিকরা তার বক্তব্য নিতে মুঠোফোনে কল দিলে তিনি নানা অজুহাত দেখিয়ে ফোন কেটে দেন। এমন ঘটনা ঘটেছে মঙ্গলবারও (৩০ জুলাই)।
জানা গেছে, ন্যায্যের চাইতে বেশি দাম দিয়ে চিনি কিনে ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন হঠাৎ নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেন। চিনির মান ভালো নয় উল্লেখ করে আদালতের কাছে জামানত ফিরিয়ে নেওয়ার আবেদন করেন। তবে আদালত সময় বাড়িয়ে দিলেও তিনি নিলামে কেনা চিনিগুলোর সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করে বুঝে নেননি। ফলে বুধবার (৩১ জুলাই) আদালতে ফের নিলামে উঠবে এসব চিনি। এছাড়া ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিনের জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করেছেন বিজ্ঞ আদালত।
তবে এ বিষয়ে গিয়াস উদ্দিনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও বাজেয়াপ্ত গুরুত্বপূর্ণ মালামাল নিলাম কমিটির সভাপতি মো. সুমন ভূইয়া স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তি সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ জুন সিলেটের জালালাবাদ থানায় দায়েরকৃত মামলায় (নং-০৫) উল্লিখিত জব্দকৃত ২ হাজার ১১৪ বস্তা (১ লাখ ৫ হাজার ৭০০ কেজি) চিনি পুনরায় নিলাম হবে। বুধবার (৩১ জুলাই) বিকাল ৩টায় সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ১ম আদালত-এর এজলাস অনুষ্ঠিতব্য এই পুনঃনিলাম কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ীদের মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতার নিকট চিনিগুলো বিক্রয় করা হবে।
নিলামের শর্তাবলী হিসেবে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়- নিলামে ক্রয়কৃত মূল্যের উপর ৭.৫% ভ্যাট প্রদান করতে হবে, নিলাম অনুষ্ঠানের ৩ কার্যদিবসের মধ্যে সম্পন্ন টাকা পরিশোধ করে মালামাল বুঝে নিতে হবে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ করে মালামাল বুঝে না নিলে জমাকৃত জামানত রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হবে, নিলামে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের ছবি সম্বলিত জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে হবে এবং নিলামের সর্বোচ্চ দরদাতাকে এই মর্মে এফিডেভিট প্রদান করতে হবে যে- তার নামে শুল্ক কর ফাঁকি দিয়ে পণ্য আনা নেওয়ার কোনো মামলা নেই।
৬ জুন সিলেটের জালালাবাদ থানার উমাইরগাঁওয়ে ভারতীয় চোরাই চিনিভর্তি ১৪টি ট্রাক ধরা পড়ে পুলিশের জালে। পরদিন জালালাবাদ থানার এসআই মো. সালাহ উদ্দিন বাদী হয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেন। সিলেটে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত থেকে সীমান্তপথে অবৈধভাবে আসা সবচেয়ে বড় চোরাচালান ছিলো এটি। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এ পর্যন্ত দুই ট্রাকচালকসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে মূল হোতারা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
এদিকে, সিলেটে ৩ থানাপুলিশের অভিযোগে জব্দকৃত চিনি গত ৮ জুলাই সিলেটের আদালতে নিলাম করা হয়। এর মধ্যে জালালাবাদে জব্দকৃত সেই বড় চিনির চালানটিও ছিলো। ওই ১ লাখ ৫ হাজার ৭০০ কেজি চিনি সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে নিলামে নেন কালিঘাটের চাল ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন। নিলামে কেনা তার চিনির কেজি সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাটসহ দাম পড়ে ১৩২ টাকা পঞ্চাশ পয়সা। অথচ সেই দিন পাইকারি দরে কালিঘাটে চিনির কেজি বিক্রি হচ্ছিলো ১০২ টাকা। বাজার মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত দরে চিনির নিলামে নেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি সেদিন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, চোরাচালানের সিন্ডিকেট ভাঙতেই তারা বেশি দরে চিনি কিনেছেন। তাই ক্ষতির বিষয়টি গুরুত্ব দেননি।
কিন্তু ওই দিনের পর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে আসে আরেকটি বিষয়। জানা যায়, বিগত দিনে আদালত থেকে নিলামে নেওয়া চিনির চালানের কাগজ ব্যবহার করা হতো চোরাচালানে। সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে চোরাই পথে আনা চিনির চালান ধরা পড়লে নিলামের কাগজ তুলে ধরা হতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে। অনেকটা রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করা এই নিলামের কাগজকে। যে কারণে চোরাকারবারিদের কাছে চিনির চেয়ে কাগজের গুরুত্ব বেশি। এজন্যই নিলামে বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দামে কিনে নেন গিয়াস মিয়া। ঠিক এসময় এই বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়, চোরাই চিনির ক্ষেত্রে নিলামের কাগজ প্রদর্শন করলেও আটকরে যাচাই করতে। এরপর থেকেই চোরাই চিনিতে বিনিয়োগকারীরা বিপাকে পড়েছেন। আর একই কারণে ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন সেই নিলামের চিনি আর নিতে চাননি।
জানা যায়, গত ৮ জুলাই নিলাম বাতিল ও জামানতের টাকা ফেরত চেয়ে আদালতে আবেদন করেন প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যে চিনি নিলামে কেনা চাল ব্যবসায়ী গিয়াস মিয়া। কোটিপতি ওই ব্যবসায়ী সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ৩য় আদালতে দেওয়া দরখাস্তে নিজেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও গরিব লোক দাবি করে নিলাম বাতিলপূর্বক জামানতের ১০ লাখ টাকা ফেরত চেয়েছেন।
আদালতে দেওয়া আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, গত ৩ জুলাই আদালতে নিলামে ১২৫ টাকায় তিনি সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হন। ৫ কেজি চিনি শুকনা এবং ভালো দেখেই নিলামে অংশ নেন। পরে সরেজমিন জালালাবাদ থানায় গিয়ে দেখতে পান- বেশিরভাগ চিনির বস্তা বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। সে কারণে ওই চিনি কিনে লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং বেশ কয়েক লাখ টাকা ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কিন্তু আদালত সেই আবেদন আমলে না নিয়ে গিয়াস উদ্দিনকে সময় বাড়িয়ে দেন। তবে তিনি নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যেও সম্পূর্ণ টাকা না দিয়ে চিনি গ্রহণ না করায় তার জামানত বাজেয়াপ্ত করেন বিজ্ঞ আদালত।
এ বিষয়ে মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) গিয়াস মিয়ার মোবাইল ফোনে কল দিয়ে জানতে চাইলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই কল বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে আবার কল দিলে তিনি পাশে থাকা একজনকে দিয়ে ফোন রিসিভ করান। তখন সেই ব্যক্তি জানান- গিয়াস উদ্দিন একটি জরুরি কাজে আছেন, কথা বলতে পারবেন না।
সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডালিম