সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ছাত্র-জনতার চলমান সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিন রবিবার (৪ আগস্ট) সংঘর্ষ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগে মহানগরসহ প্রায় পুরো সিলেট ছিলো অগ্নিগর্ভ। জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলায় সংঘর্ষের গুলিতে ৩ জন মারা গেছেন। মহানগরসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন পুলিশসহ প্রায় ৫ শত জন। বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করেছেন আন্দোলনকারীরা।
রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মহানগরের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবকলীগ পরষ্পরবিরোধী অবস্থানে ছিলো। থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে পুরো সিলেট মহানগরজুড়ে। সন্ধ্যার পর থেকেই যেন ভুতুড়ে মহানগরে পরিণত হয়েছিলো সিলেট। রাস্তাঘাটে মানুষ ও যানবাহন চলাচল প্রায় ছিলোই না বলা চলে।
সংঘাতের শুরু রবিবার দুপুর ১২টা থেকে। কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মহানগরের বন্দরবাজারের কোর্ট পয়েন্টে জড়ো হতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনে সাধারণ ছাত্র ছাড়াও ছাত্রদল ও শিবির ছিলো বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তারা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে শুরু করলে ১২টার দিকে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া ও পরে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। এসময় আন্দোলনকারীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে এবং পুলিশ তাদের দিকে গুলি, টিয়ার সেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।
এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তাদের বড় একটি অংশ জিন্দাবাজারের দিকে আসে। কিছুক্ষণ পর ফের তারা বন্দরবাজারের দিকে যায় এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে এসে যোগ দেন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা। এসময় তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন অস্ত্র দেখা যায়। তারা এসে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে নয়সড়কের যায় এবং এ জায়গাসহ নাইওরপুল ও উপশহর পয়েন্টে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। দকে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্দরবাজার এলাকার ছাত্রলীগ-যুবলীগের দখলে ছিলো।
এদিকে, বিকাল ৪টার দিকে সিলেট আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশন অফিস ও এর পার্শ্ববর্তী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে আন্দোলনকারীরা। এসময় নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুটি মোটরসাইকেল ও দুটি জিপ গাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের টিম গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, বেলা ২টা থেকে মহানগরের শাহজালাল উপশহর পয়েন্টে কয়েক শ আন্দোলনকারী জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এসময় তাদের হাতে লাঠি-সোটাসহ বিভিন্ন রকমের অস্ত্র দেখা যায়। বিকাল ৪টার দিকে হঠাৎ তারা পয়েন্ট সংলগ্ন সিলেট আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশন অফিস ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনে হামলা ও ভাঙচুর শুরু করেন। নির্বাচন কমিশন অফিসের সামনে থাকা দুটি মোটরসাইকেল ও গ্যারেজে থাকা দুটি জিপ গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। এতে গাড়িগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এছাড়া নির্বাচন কমিশন অফিসের বিভিন্ন কক্ষে ঢুকে আন্দোলনকারীরা ব্যাপক ভাঙচুর চালান।
অপরদিকে, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনের ভেতরে ঢুকতে না পেরে গ্লাস ভাঙচুর করে তারা।
খবর পেয়ে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম গিয়ে নির্বাচন অফিসের গ্যারেজের আগুন নিভায়।
এদিকে, বিকেল পাঁচটার দিকে আন্দোলনকারীরা মেন্দিবাগ কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট অফিসে হামলা চালায়। এসময় অফিসের বাহিরের দিকে গ্লাস ভাঙচুর করে তারা। একই সময় কর ভবনেও হামলা হয়। এসময় ভেতরে থাকা কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় এক ঘন্টা ভেতরে অবরুদ্ধ ছিলেন তারা। পরে পুলিশে এসে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
জানা গেছে, দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মহানগরের জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, বারুতখানা, জেলরোড, হাওয়াপাড়া, মিরবক্সটুলা, নয়াসড়ক ও আম্বরখানাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের খন্ড খন্ড সংঘর্ষ হয়। সন্ধ্যার দিকে কুমারপাড়া এলাকায় কয়েকটি মসজিদে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের ঠেকাতে ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে ওই এলাকায় আন্দোলনকারী ও এলাকাবাসীর সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
এছাড়া সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিবের অফিসে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ চালিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। রবিবার বেলা দুইটার দিকে দক্ষিণ সুমরার চন্ডিপুলস্থ অফিসে এই হামলা হয়।
জানা গেছে, বেলা দুইটার দিকে শতাধিক আন্দোলনকারী এমপি হাবিবের অফিসের সামনে থাকা ১০-১২টি মোটরসাইকেলে আগুন দেয়। এসময় অফিসের গ্লাস ও চেয়ার ভাঙচুর করে।
এ ব্যাপারে সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব সিলেটভিউকে বলেন, আমার অফিস বন্ধ ছিলো। এক দল দুর্বৃত্ত অফিসের সামনে আগুন ধরিয়েছে। তবে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বা কেউ হতাহত হননি।
এদিকে, রবিবার দিনভর আতঙ্কে ছিলেন সিলেটবাসী। সকাল থেকেই যানবাহন চলাচল কম ছিলো। খুলেনি দোকানপাট ও শপিং মল। সন্ধ্যা থেকে সিলেট পরিণত হয় ভুতুড়ে শহরে। দিনভর কোনো দূরপাল্লার সিলেট ছেড়ে যায়নি।
অপরদিকে, সিলেটের গোলাপগঞ্জে পৃথক স্থানে গুলিতে তিনজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে পুলিশ সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। রবিবার বেলা আড়াইটার দিকে গোলাপগঞ্জ পৌর এলাকার ধারাবহরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে একজন ও এর আগে ঢাকা দক্ষিণ এলাকায় দুজন নিহতের ঘটনা ঘটে।
এর মধ্যে দুজনের মৃত্যুর বিষয়টি সিলেটভিউ-কে নিশ্চিত করেছেন গোলাপগঞ্জ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও ডা. শাহিন আহমদ। অপরজনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে স্থানীয় নির্ভরযোগ্য সূত্র। নিহতরা হলেন- ধারাবহর গ্রামের মো. মকবুল আলীর ছেলে ব্যবসায়ী তাজ উদ্দিন (৪৩), উপজেলার শিলঘাটের বাসিন্দা সানি আহমদ (১৮) ও উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের তৈয়ব আলীর ছেলে নাজমুল ইসলাম।
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, দুপুরে গোলাপগঞ্জের ঢাকাদক্ষিণ ডিগ্রি কলেজের সামনে থেকে ছাত্র-জনতা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এসময় তাদের সরিয়ে দিতে চায় পুলিশ। এসময় সেখাবে বিজিবিও উপস্থিত ছিলো। একপর্যায়ে পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে ছাত্র-জনতার তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। বিভিন্ন মসজিদে ঘোষণা দিয়ে এসময় এলাকাবাসীও সংঘর্ষে জড়িত হন। প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী সংঘর্ষে ছাত্র-জনতা ও এলাকাবাসী পুলিশ-বিজির দিকে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে এবং পুলিশ-বিজিবি গুলি, টিয়ার সেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ ও বিজিবি পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সংঘর্ষে সানি ও নাজমুল নিহত হন।
এক পর্যায়ে সংঘর্ষ গোলাপগঞ্জ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। বেলা ২টার দিকে পৌর এলাকার ধারাবহরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে কিছু মানুষ জড়ো হলে সেখানে পুলিশ ও বিজিবি আসলে উত্তেজনা দেখা দেয়। এসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে বিদ্ধ হয়ে তাজ উদ্দিন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয়রা পরে তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে তাজ উদ্দিনের লাশ নিয়ে পৌরশহরে এসে ধারাবহর এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল করেছেন।
অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলাও উত্তপ্ত ছিলো। এ পৌরশহরের আল-হেরা শপিং সিটির সামনে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষ চলে। এসময় উভয় পক্ষের প্রায় ১৫ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। পরে থানাপুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
হবিগঞ্জে সংঘর্ষে যুবক নিহত :
হবিগঞ্জে আওয়ামী লীগ বিএনপি ও আন্দোলনকারি শিক্ষার্থীদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় রিপন শীল (২৭) নামে এক যুবক নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছে অন্তত শতাধিক। নিহত রিপন শীল হবিগঞ্জ শহরের অনন্তপুর এলাকার রতন শীলের ছেলে।
এছাড়া ভাংচুর করা হয়েছে হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি আবু জাহিরের বাসভবন। আগুণ দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। রোববার দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত শহরের থানার মোড় থেকে কালীবাড়ি ক্রসরোড এলাকায় দফায় দফায় এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।
সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডালিম /এসডি-৬৩২৬