গোপন তদন্তের মুখে পড়েছেন শেখ হাসিনা সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ সদস্যরা। এরই মধ্যে সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের বেশ কয়েকটি ব্যাচের গোপন তদন্ত শুরু হয়েছে। নন-ক্যাডার পুলিশ সদস্যদের বিষয়েও চলছে একাধিক গোপন তদন্ত। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এই তদন্ত পরিচালনা করা হচ্ছে। তদন্তে হাসিনা সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের অতীত ইতিহাস যাচাই শুরু করেছে সরকারের বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থা। পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরের এক নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুলিশ বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উচ্চাভিলাষী অপেশাদার কিছু পুলিশ কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে পুলিশের বিভিন্ন আইন ও প্রবিধান লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেন। একইভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক তদবিরে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এমনকি বিসিএস পুলিশ ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়োগেও ব্যাপকহারে দলীয়করণ করা হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রাক-চাকরি জীবনবৃত্তান্ত যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।’
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত নথি থেকে জানা গেছে, ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১১টি বিএসএস পরীক্ষায় মোট ১ হাজার ৩৮৩ জন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) নিয়োগ ও নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এর বাইরে উপপরিদর্শক (এসআই), সার্জেন্ট ও কনস্টেবল পদেও বড় নিয়োগ হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তাদের বিষয়ে গোপন তদন্ত পরিচালনা করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে ক্যাডেট এসআইদের বিষয়েও অনুসন্ধান করার পরিকল্পনা পুলিশের রয়েছে।
সম্প্রতি কালবেলার কাছে আসা একটি নথিতে দেখা যায়, গত ২০ অক্টোবর থেকে ২৮, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৪০ ও ৪১তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া প্রার্থীদের নির্দিষ্ট একটি অংশের নাম উল্লেখ করে ফের প্রাক-চাকরি বৃত্তান্ত যাচাইয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে প্রার্থীর সম্পর্কে একজন কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা বজায় রেখে অনুসন্ধান সম্পন্ন করার জন্য বলা হয়। যেসব বিষয় অনুসন্ধান করতে বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে নাম, জন্মতারিখ, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, সচল এবং একাধিক মোবাইল নম্বর, ই-মেইল ও ফেসবুক আইডি, টিআইএন (যদি থাকে), পাসপোর্ট নম্বর (যদি থাকে) উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া নিয়োগ পাওয়া পুলিশ সদস্য অতীতে যে স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন তার নাম, সেশন ও অধ্যয়নের বিষয় এবং অবস্থান বা আবাসিক হলের নাম, ওই সময় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। নিয়োগ পাওয়া পুলিশ সদস্য অন্য জেলায় অধ্যয়ন করে থাকলে সংশ্লিষ্ট জেলায় যোগাযোগপূর্বক তার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হতে হবে (রক্ষিত মূল ভেরিফিকেশন নথি থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম করে ফের অধ্যয়নকালীন রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার তথ্য সংগ্রহ করতে হবে)। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন করে বন্ধুর নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর উল্লেখ করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট থানার রেকর্ড (সিডিএমএসের তথ্য যাচাই) করতে বলা হয়েছে। ওই প্রার্থী বা কর্মকর্তার রাজনৈতিক সংশ্লেষণ (যদি থাকে) যাচাই করা এবং কোনোরূপ জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় জড়িত কি না যাচাই করতে বলা হয়েছে। প্রার্থী সম্পর্কে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, গ্রহণযোগ্যতা আছে এমন জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক এবং তার সমসাময়িক স্কুল বা কলেজ জীবনের সহপাঠীদের ধারণা বা মন্তব্য যাচাই করতে বলা হয়েছে। প্রার্থীর পরিবার বা নিকটাত্মীয়, স্বজনের নাম ও পদবিসহ পেশার বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে ২৮তম বিসিএসে এসএসপি পদে ১৮০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই সময় থেকে পুলিশে রাজনৈতিক পরিচয়ে লোক নিয়োগ শুরু হয়। ২০১৭ সালে ৩৫তম বিসিএসে নিয়োগ দেওয়া হয় ১১৪ জনকে। ২০১৮ সালে ৩৬তম বিসিএসে নিয়োগ দেওয়া হয় ১১৫ জনকে ও ২০১৯ সালে ৩৭তম বিসিএসে নিয়োগ দেওয়া হয় ৯৭ জনকে। এ ছাড়া ২০২২ সালের ১ নভেম্বর ৪০তম বিসিএসে ৭১ জন এএসপি নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ৬২ জনই ছিল ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হওয়ার পর গত সপ্তাহে এই ৬২ জন শিক্ষানবিশ এএসপির সমাপনী কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়েছে।
তবে এই বিসিএসে কেবল পুলিশ ক্যাডারের এএসপি পদই নয়, সহকারী কমিশনার (প্রশাসন), সহকারী পরিচালক (আনসার), সহকারী মহা-হিসাবরক্ষক, সহকারী নিবন্ধক (সমবায়), সহকারী কমিশনার (শুল্ক ও আবগারি), সহকারী সচিব (পররাষ্ট্রবিষয়ক), সহকারী কমিশনারসহ (কর) প্রায় সবকটি ক্যাডারেই বেছে বেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়োগের সুপারিশ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকে মেধার জোরে নিয়োগের চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে শেষ পর্যন্ত তাদের ‘বিএনপি বা শিবির’ উল্লেখ করে নিয়োগ আটকে দেওয়ারও অভিযোগ ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ দেওয়া ৪০তম বিসিএস বাতিলের দাবিও উঠেছে এরই মধ্যে।
এদিকে ২০২৩ সালে ৪১তম বিসিএসে এএসপি পদে ১০০ জনের নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। তাদেরও বড় একটি অংশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বলে অভিযোগ রয়েছে। ৪০তম বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের ট্রেনিং শেষ হয়েছে। তাদের সমাপনী কুচকাওয়াজ সম্পন্ন হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রশিক্ষণ শুরু হবে।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া ২০১১ সালে ২৯তম বিসিএসে ৩৫ জন, ২০১২ সালে ৩০তম বিসিএসে ১৮৪ জন, ২০১৩ সালে ৩১তম বিসিএসে ১৮৪ জন, ২০১৪ সালে ৩৩তম বিসিএসে ১৫৫ জন ও ২০১৬ সালে ৩৪তম বিসিএসে ১৪৮ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদেরও গোপন অনুসন্ধানের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে।
এর বাইরে ২০২৩ সালের ৪০তম ক্যাডেট এসআইদের মধ্যে ৮২৩ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ১৭৬ জন অমুসলিম ছিলেন। ৪০তম ক্যাডেট এসআইদের মধ্যে ৯৩ জন অমুসলিমসহ ২৫২ জনকে ইতোমধ্যে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ সদস্যদের বিষয়ে গোপন তদন্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘এ ধরনের কোনো তদন্ত বা অনুসন্ধানের বিষয়ে আমার জানা নেই।’
সিলেটভিউ২৪ডটকম/ডেস্ক/মিআচৌ