বন-জঙ্গলের রাজ্যের ভিতরে বেশকিছু খালও আছে ছোটো ছোটো নালা আছে যেগুলো দিয়ে বয়ে চলে প্রবহমান পানির স্রোত এবং শোনা যায় কলকল ধ্বনি। বড়ো বন-জঙ্গল তাই সিংহ বাঘ হায়েনা নেকড়ে শিয়াল খরগোশ হরিণ বানর ইত্যাদি প্রাণী এবং আরও আছে পাখি পোকা ও কুমির গুইসাপ টিকটিকি প্রভৃতি সরীসৃপ জাতের প্রাণী। স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শক্তির দিকে সিংহ ও বাঘ অন্য সকল হিংস্র প্রাণীর তুলনায় এগিয়ে। নেকড়েও হিংস্রতায় কম যায় না। তাই বন-জঙ্গলের অন্য সকল প্রাণী সিংহ ও বাঘ ভয় পায়। তবে শিয়াল হচ্ছে চতুর এবং তেলবাজ, এরা বাঘ ও সিংহ উভয়কেই সুবিধামতো কখনও বাঘকে আবার কখনও সিংহকে সমীহ করে চলে এবং এতে শিয়ালের ভাগে খাদ্যের অভাব হয় না। শিয়াল কৌশলে কখনও কখনও ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে যায়।

 


 

বন-জঙ্গলের রাজত্ব দখলকে কেন্দ্র করে সারাবছর বাঘ ও সিংহের বিরোধ দেখা যায়। একবার জঙ্গলে বাঘ ও সিংহের তুমুল লড়াই শেষে বাঘকে হটিয়ে সিংহের রাজত্ব কায়েম হলো। দীর্ঘদিন সিংহের অন্যায় ও জুলুমের রাজত্ব চললো। কিন্তু; দিনে দিনে বন-জঙ্গলের অন্য সকল প্রাণীর ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হলো এবং সকলে মিলে সিংহের দিকে তাড়া করলো। সিংহ ভয়ে বন-জঙ্গলের রাজত্ব ছেড়ে পালিয়ে গেল। সিংহের সাথে সাথে তার প্রধান সহযোগিদের অনেকেও পালিয়েছে। এবার সিংহের পলায়নের পর বাঘের সুযোগ সৃষ্টি হলো। কিন্তু; এখানে বন-জঙ্গলের সকল প্রাণী একজোট। তারা-ই সিদ্ধান্ত নিবে কে হতে পারে এই বন-জঙ্গলের পরবর্তী রাজা। তাই বাঘ আপাতত বনের সকল প্রাণীর সঙ্গে সখ্যতা গড়তে শুরু করলো এবং সেভাবেই ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে থাকলো। এদিকে চতুর শিয়াল আপাতত চোখকান খোলা রেখে বন-জঙ্গলের রাজনীতির গতিবিধি লক্ষ্য করে মাঝে মাঝে কথা বলে। 

 

 

কিছুদিনের মধ্যেই বন-জঙ্গলের সকল প্রাণী মিলে সিদ্ধান্ত নিলো — 'আমরা শান্তি চাই, তাই শান্তির জন্য অপেক্ষাকৃত শান্ত ও বুদ্ধিমান প্রাণী খরগোশ হোক এই বন-জঙ্গলের রাজা।' এমন সিদ্ধান্তে প্রজাপতি ফড়িং রঙিন ডানা মেলে উড়ে উড়ে 'কি মজা কি মজা' করতে লাগলো। তাদের সাথে বন-জঙ্গলের অন্য সকল প্রাণীও আনন্দ ধ্বনি তুললো। খরগোশের খোঁজ করা হলো। খরগোশ এলো এবং সকলের অনুরোধে রাজাসনে বসলো।

 

 

খরগোশ বুদ্ধিমান প্রাণী। তার কথা কম এবং কাজে তার দ্রুত গতি। সে বুঝে শুনে সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। খরগোশ আবার কৌশলে অনেককে দূরে রাখে। যেহেতু বিগত বছরগুলোতে সিংহের রাজত্বে জুলুম নির্যাতনের ভয়ে থাকতো হিংস্র বাঘ আর নেকড়ে। তাই খরগোশ মশাই আরও বুদ্ধিমান সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে এবং কৌশল অবলম্বন করে। তারা জানে সিংহ পালিয়ে গেলেও যেকোনো সময় সে আবারও ফিরে আসতে পারে। তাছাড়া, বন-জঙ্গলের বিশাল রাজ্যে সিংহের সমর্থকরাও আপাতত লুকিয়ে আছে। তারা যেকোনো সময় প্রকাশ্যে আসতে পারে। তাই সিংহ ও সিংহের অনুসারীরা পলায়নের পরে রাজাসনে বসে খরগোশ মশাই আপাতত বাঘ ও নেকড়েকে কিছুটা নড়াচড়া করার সুযোগ দিলো যাতে করে এদের তর্জন গর্জন শুনে খুব তাড়াতাড়ি আবার সিংহ বাহিনী আসতে না-পারে। কিন্তু; খরগোশ মশাই ও তার বাহিনী দেখলো কিছুটা নড়াচড়া করার সুযোগ পাওয়ার পরে বাঘ, নেকড়ে, শিয়াল, কুমির এবং আরও কিছু বিচ্ছু ধরনের প্রাণী ক্ষমতাসীন খরগোশ বাহিনীর উপর চাপ দিতে শুরু করেছে। বাঘের কথা হলো যেখানে সিংহ পালিয়ে গেছে এবং সিংহের অনুসারী ও সমর্থকরা ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকছে সেখানে এই বন-জঙ্গলে তার উপর অন্য কেউ মাতব্বরি করবে এটা হতে পারে না। এখানে আবার বাঘের সাথে মিলে আরও কিছু প্রাণীও ক্ষমতায় যেতে নানান রকম কৌশল অবলম্বন করে চলেছে। কেউ কেউ খরগোশ মশাইকে ভয় পাইয়ে দিতে কখনো কখনো হুংকার দিলেও আবার যখন হুঁশে ফিরে বুঝতে পারে খরগোশ মশাই একা নয় বরং সারা বন-জঙ্গলের সকল নবীন প্রাণী এবং তাদের অভিভাবকদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে খরগোশ বাহিনীর উপর, তখন কিছুদিন চুপ থাকে। তবে শিয়াল এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, সে খুব বেশি হুংকার না-দিয়ে বরং; অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে যথেষ্ট হিসাবনিকাশ করে এগুচ্ছে।

 

 

সময় যায়, বর্ষা শেষে শরতকাল গড়ায় হেমন্তে। এদিকে খরগোশ মশাই তার বাহিনী নিয়ে যথেষ্ট দাপটের সাথে আছে বন-জঙ্গলের শাসন ক্ষমতায়। কিন্তু; বাঘের কি আর এতো দেরি সয্য হয়! সে এবার নেকড়ে, কুমির, দাঁড়কাক, শকুন, সাপ, বেঁজি, বিচ্ছু ও কাঁকড়া ধরনের প্রাণীদের সমর্থন নিয়ে বন-জঙ্গলের রাজাসনে বসা খরগোশ বাহিনীর উপর জোরেশোরে চাপ প্রয়োগ করতে লাগলো। এদিকে খরগোশ বাহিনীর কেউ কেউ বেইমানি করে তলেতলে বাঘের সাথে সখ্যতা গড়ে তুললো। এতে করে খরগোশ মশাই কিছুটা দুর্বল হলো। বাঘ সারা বন-জঙ্গলে অস্থিরতা সৃষ্টি করে খরগোশ মশাইকে বন-জঙ্গলের শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগে গেল। কিন্তু; চতুর শিয়াল এখন পর্যন্ত বুঝতে পারলো যে, এ পর্যায়ে বাঘের সাথে মিলে তার খুব সুবিধা হবে না। তাই শিয়াল খরগোশ মশাইকে নানান কৌশলী কথায় সমর্থন দিয়ে নিজের অনেক বিষয়ের দাবিদাওয়া আদায় করে নিতে সচেষ্ট রইলো। কিন্তু; একের পর এক ঋতু বদলের পালায় বছর শেষে বাঘের সমর্থক ও শক্তি আরও বৃদ্ধি পেলো। 

 

 

বন-জঙ্গলের রাজ্য পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী খরগোশ পালিয়ে যাওয়া সিংহের লুকিয়ে থাকা সমর্থকদের গর্ত ও আড়াল থেকে বের হয়ে আসার ইঙ্গিত দিলো। খরগোশ বাহিনী সিংহের সমর্থকদের বললো তোমরা আর লুকিয়ে না-থেকে বের হও এবং বাঘের সাথে আগের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে একটু একটু করে বন-জঙ্গল দখল নিতে চেষ্টা করো। খরগোশ মশাইর আশ্বাস পেয়ে এতোদিন পালিয়ে ও লুকিয়ে থাকা সিংহ বাহিনী এখন একটু একটু করে প্রকাশ্যে নড়াচড়া করতে লাগলো। এ খবর পৌঁছে যায় বাঘের কাছে। বাঘ এখন দেখলো এ-তো আরেক সমস্যা হলো। বাঘ চিন্তা করলো কোনভাবেই সিংহ বাহিনীর পুনরুত্থান হতে দেয়া যাবে না। তাই যেখানেই সিংহ বাহিনীর প্রকাশ্যে নড়াচড়া করতে দেখা যায় সেখানেই বাঘের বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে হামলা করে এবং সিংহ বাহিনীও পাল্টা হামলা করতে থাকে। এভাবে দিনে দিনে বন-জঙ্গলে বাঘের বাহিনী ও সিংহ বাহিনীর মধ্যে ঝগড়াঝাটি চলতে লাগলো।

 

 

বাঘের বাহিনী ও সিংহ বাহিনীর মারামারিতে যখন বন-জঙ্গলের রাজ্য অস্থির, তখন খরগোশ বাহিনী বন-জঙ্গলের সকল প্রাণীদের সাধারণ সভা আহবান করে তাদের সমর্থকদের বুঝাতে লাগলো, 'তোমরা নিশ্চয়ই দেখতে পারছো বাঘ ও সিংহ বাহিনীর উপদ্রবে শান্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কাজেই বন-জঙ্গলের শান্তির জন্য তোমাদেরকে আবারও জোড়ালো ভূমিকা নিতে হবে। এখন তোমাদেরকে আগের মতো আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকল অশান্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আমাদের বন-জঙ্গলের রাজত্বে যতো হিংস্রতা আছে আবারও এদেরকে তাড়া করতে হবে। আমাদের বন-জঙ্গলের রাজত্ব হবে শান্তিময়। এখানে কোনো মারামারি ও হিংস্রতা চলতে পারে না।' খরগোশ বাহিনীর প্রতিনিধির বক্তৃতা শুনে আবারও বন-জঙ্গলের সকল প্রাণী একজোট হয়ে সমস্ত বন-জঙ্গলের রাজ্যের জলে স্থলে পাহাড়ে দিনেরাতে পালাক্রমে পাহারা দিতে লাগলো। খরগোশ বাহিনী আবার বন-জঙ্গলের রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হলো। 

 

 

বন-জঙ্গলের রাজ্যে খরগোশ মশাই ও তার বাহিনীর নবীন ও প্রবীণ সমর্থকদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আপাতত বন-জঙ্গলে বাঘের বাহিনী ও সিংহ বাহিনীর উপদ্রব কিছুটা কমেছে। এদিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানা গেছে, শকুন ও শকুনি সিংহ বাহিনী ও বাঘের বাহিনীকে কিছু শর্তসাপেক্ষে খরগোশ বাহিনীর বিরুদ্ধে একজোট করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে খরগোশ বাহিনীও সারা বন-জঙ্গলের রাজ্যে সতর্ক দৃষ্টি রেখে রাজ্য শাসন করে চলেছে।। 

 

 


লেখক : কলামিস্ট মোহাম্মদ আব্দুল হক

[email protected]