প্রচলিত কুসংস্কার মানব সমাজের প্রতি অবহেলা নির্যাতন নিপীড়ন,সাধারণ মানুষের অভাব-অনটন, যখন সমাজ অগ্রগতির বাঁধা হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়, মানুষ ও মানবতা হয় বিপন্ন তখন এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রত্যেক জাতি, সমাজ ও দেশে সময়ে সময়ে শাহানশাহের বলিষ্ঠ ভূমিকায় পদচারণ ঘটে মহা-মনীষীদের। যারা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনা বিকাশে কাজ করতে এবং সামাজিক ও জাতীয় জীবনে শান্তি প্রতিষ্টায় ইসলামী সমাজ গঠনে নিরলস কাজ করেন। যাদের পদধূলায় ধন্য হয় ধরিত্রী আর পূণ্যবৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সময়ের প্রকৃতি। তেমনি একজন কীর্তিমান ব্যাক্তিত্ব আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী রহ. (১৯১৩-২০০৮)। নিজের মেধা, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও আধ্যাত্মীকতার বলে আপন ব্যক্তি পরিচয়কে পেছনে ফেলে পূর্ণাঙ্গ তথা বর্ধিত এক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তিত করেছিলেন নিজেকে। যিনি দুনিয়াবি ক্ষমতার বাইরে থেকেও ছিলেন মুকুটহীন সম্রাট।  এতে করে বাংলাদেশ তথা সমকালীন দুনিয়ায় তাঁর পরিচিতি ও সুখ্যাতি ছিলো অপরিসীম।

‘তাঁর লেখা অনেক উর্দু ও আরবি গ্রন্থ ভারত, পাকিস্তানের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচিতে রয়েছে তার রচিত ...



আল্লামা ফুলতলী ১৯১৩ সালে বাংলাদেশের  উত্তরপূর্বাঞ্চলের জনপদ সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ফুলতলী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত আলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতা মুফতি মাওলানা আব্দুল মজিদ চৌধুরী রহ. ছিলেন একজন বিশিষ্ট ফকিহ। হযরত শাহজালাল রহ. এর অন্যতম সফরসঙ্গী হযরত শাহ কামাল রহ. বংশধর।

আল্লামা ফুলতলী ছিলেন ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ। বিংশ শতাব্দিতে যখন পবিত্র কোরআনের ভূল তিলাওয়াতের ছড়াছড়ি এই উপ-মহাদেশে দেখা দিয়েছিলো, তখন আলেমদের অনেককে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা গেলেও তিনি কিন্তু বসে থাকেননি। শুরু করেন বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের মহতী উদ্যোগ ‘দারুল ক্বিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’। সেই সময় থেকে শুরু হওয়া তাঁর যুগান্তকারী ইলমে ক্বিরাতের খেদমত বর্তমানে বাংলাদেশ তথা বিশ্বে তাজবীদী ভূমিকা পালনসহ মনগড়া ভুল কিরাত চর্চা কমে আসছে।

ফুলতলী অন্যতম একজন শিক্ষক ও পীর ছিলেন শাহ ইয়াকুব বদরপুরী রহ.। তার দিকনির্দেশনায় মাক্কাতুল মুকাররামার বিখ্যাত ক্বারী হযরত ইরকছুছ আল মিশরী রহ. ছাত্র হযরত মাওলানা হাফিজ আব্দুর রউফ করমপুরী শাহবাজপুরী রহ. কাছ থেকে ক্বিরাত শিক্ষা করে সনদ লাভ করেন। তারপর ১৩৫১ সনে তিনি মক্কা শরীফের বিশ্ববিখ্যাত ক্বারীদের উস্তাদ রইসুল কুররা হযরত আহমদ হিজাজী মক্কী রহ. কাছ থেকে সহীহ কোরআন শরীফের শিক্ষার সনদ লাভ করেন। আর এই সিলসিলাহ পর্যায়ক্রমে স্বয়ং রাসুল (সা.) পর্যন্ত পৌছেছে।

‘জীবনের শেষ দিকে এসে ফাযিলকে ‘ডিগ্রী’ ও কামিলকে ‘মার্স্টাস’ এর মান প্রদান এবং স্বতন্ত্র ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবীতে সিলেট থেকে হাজার -হাজার গাড়ী নিয়ে ঢাকা অভিমূখে ঐতিহাসিক লংমার্চ কর্মসূচি পরিচালনা করেন। সেই কর্মসূচিতে ছিলাম  ...


পরে ফুলতলীর পীর প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে প্রথমে ভারতের আদম খাকি রহ. মাজার সংলগ্ন মসজিদে পবিত্র কুরআনের বিশুদ্ধ শিক্ষা দান শুরু করেন,তারপর সিলেটের জকিগঞ্জ বারগাত্তায় সপ্তাহে একদিন ক্বিরাত শিক্ষা দান শুরু করেন। ১৯৪০ ইং সালে বর্তমান প্রধান কেন্দ্র ছাহেব কিবলাহ'র নিজ বাড়িতে সহীহ কুরআনের পাঠদান চালু করেন।পরবর্তীতে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তার পিতার নামানুসারে দারুল ক্বিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট নামে বোর্ড গঠন করা হয়। ফুলতলী ছাহেব রহ. তার সম্পত্তি থেকে প্রায় ৩৩ একর জমি ট্রাস্টের নামে ওয়াকফ করে দেন।

হাদীস হচ্ছে শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস। তিনি ইলমে কিরাতের খিতমত আনজাম দেয়ার পাশাপাশি ইলমে হাদীসের খিদমতেও বিরল ভূমিকা পালন করে গেছেন। তাছাড়া আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রহ. ছিলেন একজন দরদী অভিভাবক, সফল সমাজ সংস্কারক এবং খুব বিশ্বস্ত ভরসাস্থল। তাকে বিভিন্ন উপমায় সিক্ত করা যায়। ভক্তরা যামানার শ্রেষ্ঠ মুযাদ্দিদ, রঈসুল কুররা ওয়াল মুফাসসিরীন, উস্তাযুল মুহাদ্দিসীন, মুরশিদে বারহাক্ব, ওলীয়ে কামিল, শামছুল উলামা  ছাহেব কিবলাহ রহ. নামে অভিসিক্ত করেন। দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই তাকে ভালোবাসত, গরীব, দুঃখী, অসহায় এতীমদের নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তিনি। বিশেষ করে মুসলিম মিল্লাতের এই মধ্যমনি বিভিন্ন সময়ে ইসলামী আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতীয় এবং সামাজিক জীবনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহসী সূচনা পালন করে গেছেন।

জীবনের শেষ দিকে এসে ফাযিলকে ‘ডিগ্রী’ ও কামিলকে ‘মার্স্টাস’ এর মান প্রদান এবং স্বতন্ত্র ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবীতে সিলেট থেকে হাজার হাজার গাড়ী নিয়ে ঢাকা অভিমূখে ঐতিহাসিক লংমার্চ কর্মসূচি পরিচালনা করেন যার রাজ সাক্ষী ছিলাম আমি নিজে।

আল্লামা ফুলতলী ইসলামী খিদমত আঞ্জাম দেয়ার জন্য দেশ বিদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন গড়ে তুলেছেন এবং শত শত মসজিদ মাদরাসার পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তন্মোধ্যে ‘দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট, লতিফিয়া এতিম খানা, বাদেদেওরাইল ফুলতলী আলিয়া মাদরাসা, হযরত শাহজালাল দারুচ্ছুনাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদরাসা, বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ, বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া, লতিফিয়া ক্বারী সোসাইটি, লতিফিয়া কমপ্লেক্স, বাংলাদেশ আনজুমানে মাদারিসে আরাবিয়া, মুসলিম হ্যান্ডস বাংলাদেশ,ইয়াকুবিয়া হিফজুল কুরআন বোর্ড। যুক্তরাজ্যে ‘দারুল হাদীস লতিফিয়া, আনজুমানে আল ইসলাহ ইউকে, লতিফিয়া উলামা সোসাইটি, লতিফিয়া কারী সোসাইটি ইউকে, আল ইসলাহ ইয়ুথ ফোরাম, কিরাত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, আল মজিদিয়া ইভিনিং মাদরাসা, লতিফিয়া গার্লস স্কুল এবং যুক্তরাষ্ট্রে ‘আল ইসলাহ নামে মসজিদ, মাদরাসা, ইসলামিক সেন্টার, নিউইয়র্ক সুন্নিয়া হাফিযিয়া মাদরাসা, শাহজালাল লতিফিয়া মাদরাসা’ উল্লেখযোগ্য।

তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সুলেখক। তাফসীর, কিরাত, সীরাত, তাসাওউফের বেশ কয়েক খানা রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে ‘আততানভীর আলাত তাফসীর, মুন্তাখাবুস সিয়র, আনওয়ারুস ছালিকীন, নালায়ে কলন্দর, আল খুতবাতুল ইয়াকুবিয়া, শাজারায়ে তাইয়্যিবাহ, নেক আমল, আল কাউলুছ ছাদীদ’ ইত্যাদি। তাঁর লেখা অনেক উর্দু ও আরবি গ্রন্থ ভারত পাকিস্তানের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচিতে রয়েছে তার রচিত গ্রন্থাবলি।

আল্লামা ফুলতলী আজ আমাদের মধ্যে নেই। ২০০৮ সালের ১৬ জানুয়ারী লাখো-কোটি ভক্ত ও আশেকদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে মাওলায়ে হাক্বিক্বির ডাকে সাড়া দেন অনন্তের পথে। কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের সুন্দর সাধনা আর প্রেমময় এক উত্তম আদর্শ। রাব্বে কারিম তাঁকে জান্নাতের সুউচ্চ মাক্বাম দান করুন, আমীন।

* চেয়ারম্যান
বাংলাদেশ পল্লী ফোরাম
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন