বহুমুখী তদবিরের পরও রক্ষা পেলেন না ছাগলকাণ্ডের সেই আলোচিত এনবিআর সদস্য মতিউর রহমান ও তার স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ। বুধবার সকালে তাদের রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
তাদের অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সাত দিনের রিমান্ড আবেদনসহ আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালত মতিউরের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। তার স্ত্রী লায়লা কানিজের রিমান্ড আবেদন শুনানির জন্য ১৯ জানুয়ারি দিন ধার্য করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
ডিএমপির উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, গ্রেপ্তারের সময় তাদের বাসা থেকে একটি অবৈধ পিস্তল উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় ভাটারা থানায় অস্ত্র আইনে বুধবার একটি মামলা হয়েছে। এর আগে গত ৬ জানুয়ারি অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে মতিউর রহমান ও তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ, ছেলে তৌফিকুর রহমান ও মেয়ে ফারজানা রহমানের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর আগে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর মতিউর ও দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলীর বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করে দুদক।
গত বছরের ঈদুল আজহার আগে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কিনতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হন মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে এক তরুণ। শুরু হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। খবর প্রকাশ হয়, ইফাতের বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য ও সোনালী ব্যাংকেরও পরিচালক। তিনি ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালেরও প্রেসিডেন্ট।
একপর্যায়ে মতিউর একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দিয়ে দাবি করেন, ইফাত তার ছেলে নয়; তিনি ইফাত নামে কাউকে চেনেন না। বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা শুরু হয়। কালবেলাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে মতিউর পরিবারের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ এবং বিলাসী জীবন-যাপন নিয়ে নানা তথ্য প্রকাশ হয়। এ অবস্থায় মতিউরকে এনবিআর সদস্য ও সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
ছাগলকাণ্ডে নানা আলোচনা-সমালোচনার মুখে ফের বোম ফাটান মতিউরের স্ত্রী। ছাগলকাণ্ড প্রকাশ হওয়ার সপ্তাহ দুয়েক পর নরসিংদীতে মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকী বলেন, ‘ঢাকার ও নরসিংদীর জাতীয় পত্রিকা ও টিভির বড় বড় সাংবাদিকদের কিনে ফেলেছি। তারা আর কিছু করতে পারবে না। সব থেমে যাবে।’ বিষয়টি নিয়ে ফের সমালোচনার ঝড় ওঠে।
ছাগলকাণ্ড থেকে বাঁচতে মতিউর সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ বেশ কয়েকজনকে দিয়ে তদবির করান। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান মঈন আব্দুল্লাহ তার সহপাঠী ছিলেন। তাকে দিয়ে বিভিন্ন তদন্ত ও অনুসন্ধান প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন।
এ ছাড়া ৫ আগস্টের পরে মতিউর নানা কৌশলে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেন। পাসপোর্ট জব্দ থাকায় তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে তিনি গত নভেম্বর মাসে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। গত ২৫ নভেম্বর তার করা রিট আবেদনটি বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি মুবিনা আসাফের বেঞ্চ ‘উত্থাপিত হয়নি’ মর্মে খারিজ করে দেয়। ওই রিটে দুদক চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছিল। মতিউরের স্ত্রীও পাসপোর্ট ফিরে পেতে নিম্ন আদালতে আবেদন করেন।
গত বছর কোরবানির জন্য রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাদেক এগ্রো থেকে ১৫ লাখ টাকায় একটি ‘উচ্চ বংশীয়’ ছাগল কেনেন ইফাত। ইফাতকে ছেলে হিসেবে অস্বীকার করেন মতিউর। গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে তৎকালীন ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী জানান, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। মতিউর রহমানই ইফাতের বাবা। নিজাম উদ্দিন হাজারী বলেন, ইফাত এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর ছেলে।
ওই ছাগল ছাড়াও মতিউর সাদিক এগ্রোসহ ঢাকার বিভিন্ন খামার থেকে ৭০ লাখ টাকার গরু কেনার খবর আসে। ইফাতের দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি, গাড়ি, আলিশান জীবন-যাপন, মতিউর রহমান ও পরিবারের সদস্যদের নামে রিসোর্ট, শুটিং স্পট, বাংলো বাড়ি, জমিসহ নামে-বেনামে সম্পত্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সামনে আসে মতিউরের অন্য ছেলেমেয়ের বিলাসী জীবন-যাপন নিয়েও।
গত বছরের ২৩ জুন মতিউরের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে দুদক। ২৫ জুন মতিউর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব, মোবাইল ফোনের আর্থিক সেবার (এমএফএস) হিসাব ও শেয়ারবাজারের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয় বিএফআইইউ। মতিউর ও পরিবারের স্থাবর-অবস্থাবর সম্পদ জব্দ করা হয়।
এ ছাড়া কোরবানির পশু বিক্রির নামে প্রতারণা ও নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরু বিক্রি ও রাখার অপরাধে উচ্ছেদ করা হয়েছে বহুল আলোচিত সাদিক এগ্রো। জানা গেছে, অস্ত্র মামলায় রিমান্ড শেষ হলে দুদকের মামলায় রিমান্ডে নেওয়া হবে মতিউর ও তার স্ত্রীকে।
সৌজন্যে: দৈনিক কালবেলা
সিলেটভিউ২৪ডটকম/ডেস্ক