ছবি : প্রতীকী

তেইশ বছরের তিশা (ছদ্মনাম) বাবা-মাকে হারানোর পর ঢাকায় আসেন। ২০১৭ সালে জামালপুর থেকে এসে তিনি ঢাকার দক্ষিণ খানে বোনের বাসায় ওঠেন। এরপর মানব পাচার চক্রের টার্গেটে পড়ে যান তিশা। নিজ জেলার পরিচয়ে প্রথমে তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে চক্রটি। পরে যশোরে একটি দোকানে শাড়ি ও সালোয়ার-কামিজে পুঁথি বসানোর ভালো চাকরির প্রলোভন দেখানো হয় তাকে। অন্যের বাসায় কাজ করা বড় বোনকেও বুঝিয়ে ভালো কাজের আশায় যশোরে পাড়ি জমান তিশা। কিন্তু এর পরই তার জীবনে নেমে আসে কালরাত্রি। যশোরে নিয়ে সীমান্ত দিয়ে পার করে ভারতে পাচার করা হয় তাকে। এরপর তিশার ঠিকানা হয় দিল্লির আগ্রার একটি যৌনপল্লিতে। এখানেই শেষ নয়। কয়েক মাস পরই ভারতীয় পুলিশের অভিযানে ধরা পড়েন তিশা। এরপর খাটেন সাত বছরের জেল। দীর্ঘ কারাবাস শেষে এক এনজিওর মাধ্যমে দেশে ফেরেন তিশা।


এ ঘটনায় জড়িত পাঁচজনের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী তিশার বোন আদালতে মানব পাচার আইনে একটি মামলা করেন। মামলার তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেয়েছে সিআইডি। সম্প্রতি আদালতে এ মামলার চার্জশিট দাখিল করেছেন সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) হাবিব-উল-বাহার। মামলার আসামিদের মধ্যে একজন মারা যাওয়ায় চারজনকে অভিযুক্ত করে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের ৬/৭/৮/১০ ধারায় চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। আসামিরা হলো গোলাপী বেগম (৩২), জুলেখা (৩৬), আবুল কাশেম দুলাল (৫০) ও ময়না বেগম (৩০)। আসামি সবাই একে অন্যের আত্মীয়। আসামিরা সংঘবদ্ধভাবে ষড়যন্ত্র করে তিশাকে যৌনপল্লিতে বিক্রির উদ্দেশ্যে পাচার করে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়।



চার্জশিটে ঘটনার বিষয়ে আরও উল্লেখ করা হয়, যশোরে যাওয়ার পর তিশার আর কোনো খোঁজ না পেয়ে তার বড় বোন প্রথমে ঢাকার দক্ষিণ খান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর আরও খোঁজাখুঁজির পর জানতে পারেন, ঢাকার দক্ষিণ খান এলাকায় আবুল মুনসুর নামে আরেক ব্যক্তির মেয়েকে তিশার সঙ্গে ভারতে পাচার করে এই চক্রটির সঙ্গে সংযুক্ত আকেটি মানব পাচার চক্র। একসঙ্গে দুজনকে নিয়ে তাদের যৌনপল্লিতে বিক্রি করা হয়। পরে মুনসুর আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করলে তিনজন আসামি গ্রেপ্তার হয়। এরপর মুনসুরের মেয়েকে উদ্ধার করে দেশে ফেরত আনা হয়। উদ্ধার মেয়েটির কাছেই খোঁজ মেলে তিশার যৌনপল্লিতে বিক্রির খবর। পরে জেল খাটার সাত বছর পর তিশা এক এনজিও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর দেশে ফেরেন। এরপর আদালতে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার জবানবন্দি দেন।


মামলার বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) হাবিব-উল-বাহার বলেন, গ্রামের সহজ-সরল মেয়ে হিসেবে তিশাকে টার্গেট করে আসামিরা। এরপর চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচার করে। মামলাটি তদন্ত করে চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছি। ১৩ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। মামলার বাদী বলেন, আমার বোনকে ফিরে পেতে এ মামলা করেছিলাম। আসামিরা সম্পর্কে আমার আত্মীয়। আমার বোনকে এ বিষয়ে বললে শুধু কাঁদে। বর্তমানে সে বৈধভাবে দুবাই গেছে। সে এখন ভালো আছে। পুরোনো ঘটনা আর মনে করতে চাই না। আমরা আর মামলা চালাতে চাই না। ঝামেলায় জড়াতে চাই না।


এদিকে মামলার চার্জশিট দাখিলের পর গত ২৩ ডিসেম্বর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইসরাত জেনিফার জেরিনের আদালত আসামিদের ভেতর জামিনে থাকা জুলেখা ও ময়নার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এ ছাড়া বাকি দুই আসামি গোলাপি ও আবুল কাশেম দুলাল পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার মানব পাচার ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য রয়েছে। এ বিষয়ে মানব পাচার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর মোস্তফা কামাল বলেন, ভারতে দক্ষিণ এশিয়ার বড় বড় যৌনপল্লি রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে এমন বহু মেয়েকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ভারতের সীমান্ত পার করে যৌনপল্লিতে বিক্রি করা হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামের সহজ-সরল মেয়ে ও গার্মেন্টসকর্মীরা মানব পাচারের শিকার হচ্ছেন বেশি। এমন বহু মামলা বিচারের জন্য আমাদের আদালতে আসে। তবে মামলা করলেও অধিকাংশ বাদীই মীমাংসা করে নেন।


সিলেটভিউ২৪ডটকম/ডেস্ক /মিআচৌ