রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে ৪০তম বিসিএসের ৬৬ জন সহকারী পুলিশ সুপারের (এএসপি) পাসিং আউট/সমাপনী কুচকাওয়াজ থমকে আছে। কিন্তু দুই দফায় পাসিং আউটের দিনক্ষণ ঠিক করেও স্থগিত করা হয়। এদের মধ্যে ২৫ জনকে প্যারেডে দৌড় না দিয়ে এলোমেলো হাঁটা ও হৈচৈ করার মতো অভিযোগ দিয়ে শোকজ করা হয়েছে। ২৫ জনের মধ্যে অন্তত ২১ জনকে চাকরি থেকেই বাদ দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
চাকরি থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কায় ওই ২১ জন কর্মকর্তার পরিবার বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করে গত ৪ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পুলিশের আইজির কাছে ন্যায়বিচার চেয়ে লিখিত আবেদন করেছেন। তারপর ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখছেন না তাঁরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকলে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হবে এবং যেকোনো সময় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। কারণ দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে থাকায় কারো কারো মাঝে মাঝে দেখা দিচ্ছে মানসিক সমস্যা।
প্রশিক্ষণরত একাধিক এএসপি বলছেন, তিন মাসের বেশি পেরিয়ে গেলেও রহস্যজনকভাবে পাসিং আউট না হওয়ায় উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় সময় পার করছেন তাঁরা।
স্বজনের মৃত্যু হলেও তাঁরা বাড়ি যেতে পারছেন না। এভাবে প্রশিক্ষণরত এএসপিদের মধ্যে পুঞ্জীভূত হচ্ছে ক্ষোভ। এরই মধ্যে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছেন।
একাধিক শোকজ পাওয়া এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের ইতিহাসে প্রথম কোটামুক্ত বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বুনিয়াদী ও বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণসহ চাকরি স্থায়ীকরণের সব শর্ত পূরণ করেও উত্কণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার প্রহর গুনছেন তাঁরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এএসপি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘এ অবস্থায় আমরা চরম বিপর্যয়ের মুখে আছি। এমনকি আমাদের সামাজিকভাবে হেয় করা হচ্ছে। সবাই জানে আমরা এএসপি হয়েছি। প্রশিক্ষণ শেষ আরো তিন মাস আগে, এখন যদি আমাদের বাদ দেওয়া হয়, তাহলে আমরা ক্যারিয়ারে আর দাঁড়াতে পারব না, তখন মনে হবে এ জীবন রাখার চেয়ে না রাখাই ভালো।
’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের চাকরিতে নিয়োগের আগে এবং পরে দুইবার পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছে। ১৬ ধরনের তথ্য যাচাই করা হয়েছে। শোকজের পর আবার করা হয়েছে। তাতেও কোনো ত্রুটি না পেয়ে বিলম্ব করা হচ্ছে রহস্যজনকভাবে।’
পুলিশ একাডেমি সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে এই কর্মকর্তাদের এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। গত বছরের ২০ অক্টোবর সমাপনী কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। এ জন্য দেড় হাজারের বেশি অতিথিকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তবে আগের রাতে হঠাৎ করেই কুচকাওয়াজ স্থগিত করে দেওয়া হয়। এরপর আবারও ২৪ নভেম্বর এই অনুষ্ঠানের জন্য দিন ঠিক করে ফের স্থগিত হয় কুচকাওয়াজ।
পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ ও অতিরিক্ত আইজিপি মাসুদুর রহমান ভূঞা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, পাসিং আউটের ডেট জানা নেই। তবে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘পাসিং আউটের তারিখ নির্ধারিত হলে আমরা গণমাধ্যমে জানিয়ে দেব।’
২৫ জনের শোকজের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তা জানাতে পারেননি পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা কিংবা পুলিশ একাডেমির কোনো কর্মকর্তা। তবে তাঁরা জানিয়েছেন, সার্বিক বিষয়সহ যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তবে শিগগির পাসিং আউট হবে।
এরপর সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে (স্বরাষ্ট্র) যোগাযোগ করতে পারেন। কারণ তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।
তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, প্রশিক্ষণরত এএসপি ব্যাচের বড় অংশ দলীয়ভাবে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত বলে অভিযোগ উঠেছে। এ জন্য প্রশিক্ষণরত এসব এএসপির জীবনবৃত্তান্ত নানাভাবে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এদিকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সংস্কার প্রতিবেদনে পুলিশ ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক মতাদর্শ না দেখার সুপারিশ করা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বিরোধী কাজে লিপ্ত থাকার বিষয়ে যাচাই-বাছাইয়ের কথা বলা হয়েছে।
এর আগে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে রাজশাহীর চারঘাটে সারদা পুলিশ একাডেমিতে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণরত ২৫২ জন উপপরিদর্শককে (এসআই) অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে কুচকাওয়াজ অনুশীলনে সকালের নির্ধারিত নাশতা না খেয়ে হৈচৈ করে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টির অভিযোগ করা হয়েছিলো। এরপর পহেলা জানুয়ারি আরও আট এসআইকে অব্যাহতি দিয়ে একাডেমি থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে মাঠে নির্দেশনা না মেনে উচ্চ স্বরে হইচই করার অভিযোগ আনা হয়েছিলো।
সিলেটভিউ২৪ডটকম/ ডেস্ক /মিআচৌ