প্রথমে জানতাম বাংলাদেশ। পরে শুনলাম দক্ষিণ এশিয়া। এর পর মাত্র কিছুদিন আগেই জানা যায়, সারা পৃথিবীর মধ্যে বানিয়াচং হলো সবচেয়ে বড় গ্রাম। বলছি সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার অন্তর্গত বানিয়াচং গ্রামের কথা। এত বড় গ্রাম বাংলাদেশে, আর সেখানে যাব না ঘুরতে, তা কী করে হয়! অধিক সদস্য সংখ্যার ভয়ে চুপেচাপে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের সাত ভ্রমণবন্ধু এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মাইক্রো করে ছুটলাম। যেতে যেতে শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভা কার্যালয়ে ব্রেক।

 


রাত তখন প্রায় দেড়টা। আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন পৌর নির্বাহী অফিসার কাজী কামাল মনির ভাই। উনি আরেক পাগলু ট্রাভেলার। আমাদেরকে পেয়ে পাগলামির পারদ তার তুঙ্গে। এ যেন  হরেকরকম পাগল দিয়া মিলাইছিল মেলা! গভীর রাতেই আমাদেরকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবি, আমি আর কি পাগল! তার চেয়ে বড় পাগলের পাল্লায় পইড়া রাতের ঘুম হারাম। হা হা হা। প্রথমে নিয়ে গেলেন বিরামচরের সাহেববাড়ির পুকুরে। সারি সারি সুপারি গাছের ফাঁক গলে অর্ধচন্দ্রের আলোতেও পুকুরের চারপাশটা বেশ আলোকিত ছিল। চাঁদ-তারা- এসব নক্ষত্রের আসল সৌন্দর্য অন্ধকারেই বেশ বোঝা যায়।

 

এর পর নিয়ে গেলেন জমিদার গিরিশ চন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে। চমৎকার স্থাপত্য। দারুণ সব নকশা। তবে দীর্ঘদিন অযত্ন-অবহেলায় পরিত্যক্ত হয়ে উঠেছিল। এর পর ইউএনও মিনহাজুল সাহেবের তৎপরতায় জমিদারবাড়িটি সংস্কার করা হয়। যা বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাড়ির সামনে শান বাঁধানো পুকুরটাও বেশ দৃষ্টিনন্দন। পুকুরঘাটেও চলল একচোট আড্ডা। ওদিকে বানিয়াচংয়ের তরুণরা আমাদের অপেক্ষায় প্রায় নির্ঘুম। তাই আড্ডার ছেদ টেনে পৌর কার্যালয়ের ফ্লোরে বেডিং বিছিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য সবাই চিতপটাং।

 

মরিচপোড়া ঘুম দিয়েই সাতসকালে সবাই রেডি। নাশতা সারতেই মাইক্রো চলল। যেতে যেতে বানিয়াচং সড়কে উঠতেই মায়াবী প্রকৃতির  দুই চোখে ধরা দিল। বড় বাজার পৌঁছার আগ পর্যন্ত বারংবার থামতে হলো। আসলে প্রকৃতি আমাদেরকে থামতে বাধ্য করেছে। চোখের সামনে ফুটন্ত লাল শাপলার বিল, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠসহ আরও কত কী! এ রকম সব মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতেই বড় বাজার পৌঁছে যাই। সেখানে অপেক্ষমাণ স্থানীয় যুবক দিহানের সঙ্গে যৎসামান্য হাই-হ্যালো করেই ছুটলাম হান্নির হাওরে। যেতে যেতে পথে দেখা মিলল শুকিয়ে যাওয়া বিল ঝিল ডোবা নালা থেকে মাছ মারার দৃশ্য। হায়রে মাছ! মাছ আর মাছ। কত পদের যে মাছ! শহুরে বাজারগুলোতে এখন না আসা বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন জাতের মাছেরও দেখা পেলাম। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি হান্নির হাওরে পৌঁছে যায়। দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। মাঝে মধ্যে দু-একটা গ্রাম মাথা উঁচু করে একপায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাতটা এখানেই কাটাব। তাই যার যার দায়িত্ব অনুযায়ী কেউ তাঁবু গাড়তে লাগল, কেউবা বাজার-সদাই লেখার লিস্ট করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

 

এরই মধ্যেই রাতভর মাছ মারতে যাওয়া জেলেরা, নৌকাভর্তি মাছ নিয়ে ফিরতে শুরু করেছে। মাছের প্রাচুর্য দেখে চোখ আমাদের কপালে। নামমাত্র মূল্যে হরেক পদের মাছ কিনি। বোয়াল মাছের কেজি মাত্র ৩৫০ টাকা। সঙ্গে কাইক্কা, পুঁটি ফ্রি। মজার মজার মাছ খেতে চাইলে আর কেন দেরি! মাছ, কাঁচাবাজার ও রাত্রি নিবাসের তাঁবু টানানো শেষ।

 

যাই এবার লক্ষ্মী বাঁওড়। মাদ্দের বিলের গাঙ পাড়ি দিয়ে হাঁটা শুরু করি  হাওড়ের বুক চিরে। দেশি গরুর পিছু পিছু, কখনো-বা আবার মাছ ধরার ফাঁদে চোখ বুলাতে বুলাতে কোমরসমান পানি কেটে গিয়ে পৌঁছাই লক্ষ্মী বাঁওড়ের প্রান্তরে। যতই ভিতরে যেতে থাকি, ততই মুগ্ধতা ভর করতে থাকে। হিজল-কড়ই গাছের ছড়াছড়ি। গাছগুলোর আকার-আকৃতি অনেকটাই রাতারগুলের পরিবেশ লক্ষ্মী বাঁওড়ে ভর করেছে। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে মেছো বিড়ালের পায়ের ছাপ। বর্ষায় পানি থাকে টইটুম্বর।

 

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মিঠাপানির জলাবন। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে প্রায় সমান। এই বনের আয়তন সাড়ে তিন কিলোমিটার। আকার ও আয়তনে লক্ষ্মী বাঁওড় রাতারগুলের চেয়েও অনেক বড়। পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে পারলে দেশ-বিদেশের প্রচুর ভ্রমণপিপাসুর সমাগম হবে নিশ্চিত। পেটে টান পড়তেই চলে যাই অস্থায়ী নিবাস নূরপুর। মৎস্যজীবীদের বাবুর্চি আমাদের করা বাজার দিয়ে আগেভাগেই রান্নাটা সেরে রেখেছিলেন। এসেই শুধু গপাগপ ভাতের লোকমা। কাইক্কা মাছের ভুনা এতটাই জোশ ছিল যে, অন্যান্য মাছের তরকারির স্বাদ পুরাই ম্লান।

 

সময় কম। খেয়েদেয়েই ছুটলাম কমলা রানীর দীঘি। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাই দীঘির প্রান্তরে। প্রথম দেখায় ভালো না লাগলেও কাছাকাছি যাওয়ার পর বিস্মিত হই এর সৌন্দর্যে। নীলাভ পানি। আসমানের রঙ আর পানির রঙ মিলেমিশে একাকার। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দীঘি। সাগরদীঘি নামেও এর পরিচিতি রয়েছে।

 

দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজা পদ্মনাভ প্রজাদের পানির কষ্ট লাঘবের জন্য গ্রামের মধ্যভাগ দিয়ে দীঘিটি খনন করান। কিন্তু খননের পর পানি না ওঠায় রাজা চিন্তিত হয়ে পড়েন। একদা রাতে রাজার স্ত্রী রানী কমলাবতী স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে আত্মবিসর্জন দেন বলে এই অঞ্চলে জনশ্রুতি রয়েছে। এই দীঘির পাড়ে বসে পল্লীকবি জসীম উদদীন রানী কমলাবতীর দীঘি নামক একটি কবিতা লিখেছিলেন।

 

সূর্য হেলে পড়েছে। যাই এবার বানিয়াচং রাজবাড়ি। বর্তমানে রাজবাড়ির উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ইমারত অবশিষ্ট নেই। যাও একটি ঘর রয়েছে, সেটাও থাকে তালাবদ্ধ। তবে বাড়ির উঠোনটা বেশ চমৎকার। রাজা গোবিন্দ সিংহ বানিয়াচং রাজ্যের অধিপতি হওয়ার পর এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল। চারপাশ ভর করে সন্ধ্যা এলো নেমে। মাগরিব আদায় করেই ফিরলাম তাঁবুতে।

 

ভাটিয়ালি গানের আসর বসল নাজমুলের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু আকাশে জ্বলজ্বল করা তারার মেলা আমাদেরকে সেদিকেই বেশি আকৃষ্ট করে।  হাওড়ের প্রান্তরে নিঝুম এক পরিবেশে গাড়া তাঁবুতে বেশ একটা ফুরফুরে ঘুম দিয়ে, সুবহে সাদিকের অপার্থিব ও নজরকাড়া সৌন্দর্যের স্মৃতি নিয়ে ঢাকার পথ ধরি।

 

সিলেটভিউ২৪ডটকম / মাহি-৩