মফঃস্বল সাংবাদিকরা সংবাদপত্রের প্রান। এ কথাটি  রূপক অর্থে অনেক সময় বলা হয়ে থাকে। বাস্তবতা হচ্ছে এর উল্টো। মফঃস্বল সাংবাদিকরা সব ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন। কোন সংবাদপত্র নিজেকে জাতীয় হিসেবে মর্যাদা পেতে হলে তাকে মফঃস্বল সাংবাদিকদের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত অধিকাংশ জাতীয় সংবাদপত্রের সারা দেশে সংবাদদাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। ঢাকায় ডেস্কে বসে মফঃস্বল সংবাদদাতাদের যিনি নিয়ন্ত্রন করেন  তিনি হচ্ছে মফঃস্বল বার্তা সম্পাদক। বর্তমানে দেশে ৮টি বিভাগ, ৬৪টি জেলা, ৪৯৫ টি উপজেলাসহ বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয় ও বন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সংবাদদাতারা কাজ করেন। প্রতিদিন সারাদেশ থেকে অসংখ্য সংবাদ কেন্দ্রীয় ডেস্কে যায়। এগুলোকে বাচাই ও সম্পাদনা করার দায়িত্ব মফঃস্বল বার্তা সম্পাদকের। সংবাদদাতারা সকলই চান তার প্রেরিত সংবাদটি পরদিন পত্রিকার পাতায় ছাপা হরফে দেখতে। পত্রিকার স্বল্প পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটি বাচাই করা, প্রত্যেক অঞ্চলের সংবাদ সমন্বয় করা, স্থান নির্ধারণ করা খুবই কঠিন কাজ। এ কাজটি করতে গিয়ে অনেকেই ব্যর্থ হন। সংবাদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে পক্ষপাত,অনৈতিক সুযোগ সুবিধা গ্রহন, ইত্যাদি অভিযোগ প্রায়ই শুনা যায়। আমার এ লেখাটি মফঃস্বল সাংবাদিকতা নিয়ে নয়। একজন সৎ নিষ্ঠাবান প্রতিশ্রæতিশীল মেধাবী মফঃস্বল বার্তা সম্পাদক সদ্য প্রয়াত শাহজাহান কমরকে নিয়ে। যিনি মফঃস্বল সাংবাদিকতার শেখর থেকে শিকরে উঠে ছিলেন। ১৯৬৫ সালে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার কালাইউড়া গ্রামে তার জন্ম। ২০০০ সাল থেকে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার গ্রামতলা গ্রামে পরিবারের অন্যন্য সদস্যদের সাথে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। ২০০৩ সালে একই উপজেলার গাজিটেকা গ্রামের স্বপ্না বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আাবদ্ধ হন।

জলডুপ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে এসএসসি পাশের পর ঢাকার হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ থেকে এইচ,এস সি, সিলেট এমসি কলেজ থেকে বি এ  পাশ করেন। এর পর সিলেট ‘ল’ কলেজে ভর্তি হন। তিনি সিলেট এমসি কলেজ ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক ও সিলেট ল কলেজ ছাত্র সংসদের এজিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালে সাপ্তহিক জৈন্তাবার্তার এমসি কলেজ প্রতিনিধি হিসেেেব সাবাদিকতায় হাতেকড়ি নেন। এর পর দৈনিক আজকের সিলেট, সিলেটের ডাক, দৈনিক বাংলাবাজার ও দৈনিক ঘোষণা পত্রিকার মফঃস্বল বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সাত ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলের মা বাবার ৬ষ্ঠ সন্তান। নিঃসন্তান ছিলেন বলে হয়তো তার মনে হয়ত কিছুটা দুঃখ ছিলো কিন্ত কাজে কর্মে ব্যবহারে এর কোন প্রতিফলন ছিলো না। তিনি মফঃস্বল সাংবাদিকদের পাল্স বুঝতেন . দুর্বলতা, মান মর্যাদা, তাদের কাজের বাস্তবতা বুঝতেন। তিনি দৈনিক আমাদের সময়ের জন্মলগ্ন থেকে এর সাথে যুক্ত হন। আমিও এর প্রস্তুতি সংখ্যা থেকে নিয়মিত সংবাদ পাঠাচ্ছিলাম। অফিসে গিয়ে কোন দিন তদবির করিনি। কাউকে চিনতামও না। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারী সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া সদর উপজেলার লস্করপুর ইউনিয়নের বৈদ্যের বাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এক জনসভা শেষে গ্রেনেড হামালায় নিহত হন। তার সাথে তার ভাতিজা মঞ্জুরুলহুদাসহ আরো ৫জন আ.লীগ নেতা নিহত হয়েছিলেন আরো ৭০ জন নেতাকর্মীর গুরুতর আহত হন। এ নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। ঢাকা থেকে বিভিন্ন মিডিয়ার সিনিয়র রিপোর্টার এসে ভিড় জমান। বিভিন্ন এজেন্সি প্রকাশ্যে ও গোপনে ঘটনার রহস্য উদঘাটনে তৎপর হয়ে উঠেন। আমারা স্থানীয় সাংবাদিকরাও প্রতিদিন এ ঘটনা নিয়ে সংবাদ পাঠাতে থাকলাম। হঠাৎ একদিন জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিচিত একজনের কাছে জানতে পারলাম ঘটনা স্থলে আমেরিকার ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) তদন্ত সংস্থার প্রতিনিধিরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসছেন। দিন বললেও কখন অসবে তা জানা গেলো না। সারাদিন ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। দুপুরে তারা কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেন। তবে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন না। তবে তাদের পরিদর্শনের খবরটি অনেক সংবাদকর্মী জানতেন না। আমি দেরি না করে তাদের পরিদর্শনের খবরটি আমাদের সময়ে পাঠিয়ে দেই। পরদিন ঢাকা থেকে ফোন পেলাম “আপনি কি রুহুল হাসান শরীফ বলছেন, জি¦, আপনি আমি শাহজাহান কমর বলছি” আপনি কি কোন সিভি পাঠিয়েছেন আমি বললাম জি¦ পাঠিয়েছি, তিনি বললেন আবার নতুন করে একটি সিভি পাঠান আর নিয়মিত সংবাদ পাঠাবেন। এভাবেই দৈনিক আমাদের সময়ের হবিগঞ্জ প্রতিনিধি নিয়োগ পেলাম। সারা বাংলাদেশে প্রতিনিধিদের খবরাখবর নখদর্পনে ছিলো কমর ভাইয়ের। ডেস্কে নির্দেশনা ছিলো সব প্রতিনিধিকে এক পাল্লায় তুলে মাপা যাবে না। পারফর্মেন্স, ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করে তাদের সাথে ব্যবহার করতে হবে। আমি একজন সৌভাগ্যবান কমর ভাইয়ের কাছ থেকে ভালবাসা, সম্মান সব কিছুই পেয়েছি। তার এসাইনমেন্ট দেয়ার পদ্ধতি ছিলো খুবই চমৎকার। সেখানে একটি দিক নিদের্শনা থাকতো, কাজটি কি ভাবে সহজে করা যাবে সেটাও বলে দিতেন। তার দিক নিদের্শনায় সাংবাদিকতা শিক্ষার উপাদান থাকতো। সংবাদের গুরুত্ব বিবেচনায় সারাদেশের সংবাদই তিনি নিরেপেক্ষ ভাবে বাচাই করতেন। তারপরও আমরা বৃহত্তর সিলেটের প্রতিনিধিরা তার বিশেষ নজরে ছিলাম। চেষ্টা করতেন ছোট করে হলেও সিলেট বিভাগের কোন না কোন জেলার সংবাদ যাতে স্থান পায়। কোনো প্রতিনিধির সাথে তার কোন পৃথক কোন সখ্যতা ছিলো না, কারো কাছ থেকে কোন বিশেষ সুবিধা নেননি। কোন আবদার করেননি। কোন প্রতিনিধি তাকে উপহার হিসেবে কোন কিছু দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। তিনি মফঃস্বল সাংবাদিকদের দুঃখ বুঝতেন নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে। তিনি উপজেলা থেকে আসেন সিলেট জেলা শহরে। সেখানে স্থানীয় সাপ্তাহিকে কাজ শুরু করেন।


এরপর সিলেটের কিছু দৈনিকে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে চলে যান ঢাকায়, সেখানে বাংলাবাজার পত্রিকার স্টাফ হিসেবে যোগদেন। আর তাকে পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। নৈতিকতার প্রশ্নে অনেক সময় থাকে প্রতিকুলতার মধ্যে দিয়ে চলতে হয়েছে। কিন্ত হাল ছাড়েননি। সাংবাদিকতাকে দেখতে চেয়েছেন মানুষের কল্যাণ হিসেবে। তার দায়বদ্ধতা ছিলো বিবেক আর দেশের জনগণের কাছে। তিনি কোন দলাদলি কিংবা গ্রæপিংয়ে বিশ^াস করতেন না। সংবাদপত্রের ন্যাশনাল ডেস্কের সহ সম্পাদকদের থেকে মফঃস্বল সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয় অনেক সময়। তাদের বেশীর ভাগেই তৃণমূল পর্যায়ের অভিজ্ঞতা কম থাকে। কিন্তু কমর ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম। কমর ভাইয়ের অকাল মৃত্যুতে দৈনিক আমাদের সময়ের মফঃস্বল ডেস্কের যে শুন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে পুরণ হওয়ার নয়। ১০ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যু সংবাদ দৈনিক আমাদের সময়ের সকল জেলা উপজেলা প্রতিনিধিদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। সবাই নিজেকে অভিভাবক শুন্য মনে করতে থাকেন।

বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিনিধিরা ছুটে আসেন বড়লেখার গ্রামতলা গ্রামে। শরিয়তপুর প্রতিনিধি রুমন আকন্দ সামান্য সময়ের জন্য প্রথম জানাজা ধরতে পারেননি। পরে ২য় জানাজায় শরীক হতে তিনি বিয়ানীবাজার কালইউড়া গ্রামে যান। ময়মনসিংহ প্রতিনিধি মো. নজরুল ইসলাম, আমি নিজে আমাদের মাধবপুর প্রতিনিধি মো. অলিদ মিয়া, বাহুবল প্রতিনিধি আাব্দুল আ্ওয়াল তবিলদারসহ মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলা প্রতিনিধিরা গ্রামতলা জামে মসজিদে ১ম জানাজায় শরিক হতে পেরেছি। আমাদের সাথে মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি, ভাস্কর হোম, নবগিঞ্জ উপজেলা  প্রতিনিধি সলিল বরণ দাশ উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকা থেকে এসেছিলেন সিনয়র সহ সম্পাদক আবুল হাসান হৃদয় ও মো. আকতারুজ্জামান। কমর ভাইয়ের জানাজায় শরীক  হতে পেতে নিজেকে কিছুটা হালকা অনুভব করছি তা না হয়ে একটা অপরাধবোধ আজীবন লালন করতে হতো। পরিচ্ছন্ন ও কোলাহলমুক্ত শান্ত  গ্রামতলা গ্রামটি কমর ভাইয়ের মৃত্যুতে আরো যেন শান্ত হয়ে গেছে। কমর ভাই নেই তার কর্ম বেঁচে আছে আমাদের সময়ের প্রতিটি কর্মী ও সাংবাদিকের অন্তরে। অনন্তকাল শান্তিতে ঘুমান কমর ভাই এই দোয়াই করি।

 

লেখক: রুহুল হাসান শরীফ, সাংবাদিক।