সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর পশ্চিম ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের কাঁঠালবাড়ি গ্রামে এমন মানুষদের নিয়ে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি গঠন করা হয়েছে, যারা কেউই পেশায় মৎস্যজীবী নন। আর এই কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে খোদ সমবায় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ওই এলাকায় এখন মৎস্যজীবী বনাম অমৎস্যজীবী হিসেবে দুটো পক্ষের সৃষ্টি হয়েছে। এতে ‘মৎস্যজীবী বন্ধন’ বিনষ্টের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

 


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউপি চেয়ারম্যান ও গঠনকৃত সমিতির ১২ জন সদস্য ওই সমিতির নিবন্ধনে আপত্তি তুললেও জেলা সমবায় অফিস থেকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ আছে, এ কাজ করতে জেলা সমবায় কর্মকর্তা রহিম উদ্দিন তালুকদার মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়া উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা আকতার হোসেন স্থানীয় মেম্বার দেলোয়ার হোসেন জীবন অমৎস্যজীবীদের নিয়ে এই সমবায় সমিতি গঠনে সরাসরি কাজ করেছেন।

 

‘কাঁঠালবাড়ি গুচ্ছগ্রাম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামের ওই সমিতির সহসভাপতি নবী হোসেন  বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড মেম্বার দেলোয়ার হোসেন জীবন ও উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা আকতার হোসেন আমাদের কাছ থেকে কিছু লোকের জেলে কার্ড সংগ্রহ করেন। তখন তারা বলেন, আমাদেরকে সরকারি মালামাল ও ভাতার ব্যবস্থা করিয়ে দেবেন। 

 

এখন শুনি তারা আমাদের নামে সমবায় সমিতি খুলেছে। তাই আমরা ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে নালিশ করেছি। গত ৪ মার্চ জেলা সমবায় অফিসারের কাছে সমিতি না করার জন্য আবেদন নিয়ে গিয়েছি। কিন্তু সমবায় অফিসার আমাদের আবেদন না রেখে মামলার হুমকি দেন, খারাপ ব্যবহার করেন। পরে এই আবেদনপত্রের অনুলিপি আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কাছে দাখিল করি। সমবায় অফিসার টাকা খেয়ে এই সমিতির নিবন্ধন দিয়েছেন। তাই তিনি আমাদের আবেদন গ্রহণ করেননি।’ একই অভিযোগ করেন সমিতির সদস্য ইদু মিয়াসহ বেশ কয়েকজন।

 

অভিযোগকারীরা আবেদনপত্রে উল্লেখ করেন, আমরা কাঁঠালবাড়ি এলাকায় মৎস্যজীবী সমিতি করতে আগ্রহী নই। ৪নং ওয়ার্ড মেম্বার দেলোয়ার হোসেন জীবন এবং কোম্পানীগঞ্জ সমবায় অফিসার আকতার হোসেন মিথ্যা কথা বলে মৎস্যজীবী সমিতি করার জন্য স্বাক্ষর নিয়েছেন। আমরা কেউই মৎস্যজীবী নই। তাই কাঁঠালবাড়ি ও শিমুলতলা আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রামের নামে কোনো মৎস্যজীবী সমিতি করতে আগ্রহী নই।

 

এদিকে গত ১৬ মার্চ অমৎস্যজীবীদের নিয়ে ‘কাঁঠালবাড়ি গুচ্ছগ্রাম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি’ নিবন্ধন না করার জন্য জেলা সমবায় অফিসার বরাবর আবেদন করেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ১নং ইসলামপুর পশ্চিম ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াদ আলী। তিনি তার আবেদনে অমৎস্যজীবীদের নাম ও পেশাও যুক্ত করেন।

 

ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াদ আলী তার আবেদনে উল্লেখ করেন, ‘আমি প্রস্তাবিত কাঁঠালবাড়ি গুচ্ছগ্রাম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সব সদস্যকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। আমার জানামতে, প্রস্তাবিত মৎস্যজীবী সমিতির সব সদস্য প্রকৃত মৎস্যজীবী নন।

 

তালিকা অনুযায়ী ১৮ জন অমৎস্যজীবী হলেন-  মো. হান্নান মিয়া, তিনি ঢাকায় কাজ করেন; অটোড্রাইভার আক্তার হোসেন, গার্মেন্টসকর্মী আমির হোসেন, রাজমিস্ত্রি আব্দুল কুদ্দুস, গাড়িচালক লিলু মিয়া, নৌকার মাঝি মো. ইদু মিয়া, কৃষক এলেম খাঁ, মো. আকবর আলী, আনসর আলী, মংলা মিয়া, আলিম উদ্দিন, নবী হোসেন, মো. সুরুজ আলী, কাঠমিস্ত্রি তেরাব আলী, শ্রমিক মাসুক মিয়া, মো. জামিল হোসেন, টিউবঅয়েল মেকানিক আব্দুল হামিদ, ফেরওয়ালা মো. জুরু মিয়া।

 

ইসলামপুর পশ্চিম ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াদ আলী বলেন, ‘আমি এলাকার সবাইকে চিনি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে দেলোয়ার মেম্বার এলাকার সাধারণ মানুষকে মিথ্যা বলে তাদের জেলে কার্ড নিয়ে নতুন সমবায় সমিতি করার আবেদন করেছেন। কিছুদিন আগে এলাকায় একটি উন্নয়ন কাজের কথা বলে তিনি আমাকে দিয়ে কিছু কাগজে স্বাক্ষর করান। পরে জানতে পারি সমবায় সমিতি করার জন্য আমার কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়েছে। তাই আমি এরই মধ্যে জেলা সমবায় কর্মকর্তা বরাবর মৎস্যজীবী সমিতির নিবন্ধন না দেওয়ার জন্য আবেদন করেছি। সেখানে অমৎস্যজীবীদের তালিকাও দিয়েছি।’ 

 

গত বৃহস্পতিবার যোগাযোগ করলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুস শাকুর বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাকে একটি অনুলিপি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আবেদন যেহেতু জেলা সমবায় অফিসার বরাবর, তাই এখানে আমাদের তদন্তের সুযোগ নেই। আমাদের প্রত্যয়ন ছাড়া তো মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নিবন্ধন দেওয়ার নিয়ম নেই। কাঁঠালবাড়ি গুচ্ছগ্রাম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির জন্য আমাদের অফিস থেকে কোনো প্রত্যয়ন দেওয়া হয়নি। জেলা সমবায় অফিসারই বলতে পারবেন তিনি কীভাবে নিবন্ধন দিলেন।’ 

 

জেলা সমবায় অফিসার রহিম উদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘জেলে কার্ড দিয়ে মৎস্যজীবীরা সমিতি নিবন্ধনের জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। আমরা নিবন্ধন দিয়েছি।’ ইউপি চেয়ারম্যানের নিবন্ধন না দিতে অনুরোধের আবেদন পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাহেবও নিবন্ধনের জন্য প্রত্যয়ন দিয়েছেন। পরে আবার তিনি কারও প্ররোচনায় প্রত্যয়ন দেননি বলে জানান।’ 

 

সমিতির নিবন্ধন না দেওয়ার জন্য সদস্যদের আবেদন ও তাদের হুমকি দেওয়ার ব্যাপারে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার কাছে কেউ কোনো আবেদন নিয়ে আসেননি। এ ব্যাপারে কথা বলতে চেয়ারম্যানের ছেলে এসেছিলেন। তার সঙ্গে কিছু লোকজন ছিল। কিন্তু আমি কোনো আবেদন পাইনি এবং কাউকে হুমকি দেইনি।’

 

সমিতির নিবন্ধন দেওয়ায় এলাকায় মৎস্যজীবী বনাম অমৎস্যজীবী বিরোধ দানা বেঁধেছে জানিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াদ আলী সামাজিক সম্প্রীতি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘মৎস্যজীবী বন্ধনটাই বিনষ্ট হয়ে গেল। এতে করে গ্রামে লোকজনের মধ্যে সম্প্রীতি ক্ষুণ্ণ ও আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। যেকোনো সময় এলাকায় গোষ্ঠী-দাঙ্গাও হতে পারে। সামাজিক সম্প্রীতির স্বার্থে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করছি।’

 

সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডেস্ক / মাহি