আমাদের বাংলা সাহিত্যাকাশে এখনও যারা আলো ছড়ায় বিশ্ব ভূবন মাঝে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বজন সেই আলোটুকু অনুধাবন করতে পারলে ভালো। তবে আমরা বুঝি এবং খুঁজি। তাই আমাদের সাহিত্য আড্ডায় নিজের লেখা বা বাংলা সাহিত্য সংশ্লিষ্ট কোনো আলোচনায় পাশাপাশি প্রাধান্য পায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই লেখার দ্বারা রবীন্দ্রনাথকে আমি আপনার কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছিনা। আপনি বাঙালি, তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপনার মাঝে আছেন। বাঙালি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ আমার সাথেই থাকেন।

 


দেশের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ও ভূ-রাজনৈতিক নিয়ম মেনে স্বাধীন এই বাংলাদেশে সরকার বদল হয়। বিদ্যালয়ের বই এবং সিলেবাস বদলে যায়। সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষা নীতিতে নানান রকম কৌশলী পরিবর্তনও ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মুখ থেকে " আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।" গানটি এখনও কেউ একটি দিনের জন্য কেড়ে নিতে পারেনি কিংবা এর পরিবর্তে অন্য কিছু ভাবতে পারেনি। এই হচ্ছেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলার এই বহুমুখী প্রতিভাবান লেখকের গান ভারত ও শ্রীলঙ্কা তাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে গাইছে এবং এভাবে তারাও কবিকে ধারন করে আছে। কাজেই বাঙালি হিসেবে এমন একজন বিশ্ব বরেণ্য লেখকের জন্য আমরা গৌরব অনুভব করি।

 

আমাদের দেশে রবীন্দ্র - নজরুল জন্মজয়ন্তী একই সাথে পালন করা হয় বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে। এই দুই মনীষী বাংলা সাহিত্যের জ্বলজ্বল তারা।   রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালনকালে অনেকেই সমীহ করে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এতো বড় মাপের একজন কবি যে তার সম্পর্কে কথা বলার দুঃসাহস দেখাই না। ওই বিদগ্ধ জনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও মমতা রেখে আমি বলি, বাংলা সাহিত্যে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আছেন যিনি সবার জন্য লিখেছেন। তাই সকলেই তাঁরে চিনি ও বলতে পারি কিছু কথা। স্বশিক্ষিত রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত 'গীতাঞ্জলি' এবং অন্যান্য কাব্যের কবিতা মিলিয়ে ইংরেজিতে অনূদিত ' Song Offerings ' গ্রন্থটির জন্য  নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন ১৯১৩ খ্রীষ্টিয় সালে। তিনি বিশ্ব সাহিত্যে বাংলাকে পৌঁছে দিয়েছেন আর আমরা হয়েছি গৌরবাহ্নিত। ১৯১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত বাংলা কাব্যগ্রন্থ 'গীতাঞ্জলি' আর ইংরেজীতে অনুদিত ' song offerings' এক নয়। তাঁর রচিত গীতালী, গীতিমাল্য, খেয়া, উৎসর্গ ইত্যাদি কাব্য থেকে কবিতা নিয়ে হয়েছে Song Offerings নামের গ্রন্থটি। তাঁর সৃষ্টি কর্ম বিশাল। সবটুকু আমি ছুঁতে পারবো কিনা জানা নেই। তবে যেটুকু পেয়েছি তাও কম নয়। আমরা দুষ্ট ছেলের দল সেই ছোট্ট বেলায় ভুল করেই পড়েছিলাম _ বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠুকুর। বড় হতে হতে আরো অনেক পড়েছি এবং রবীন্দ্র সংগীত কয়েকটি যে কেউ গাইতে পারতাম। এখনও গেয়ে যাই কতো গান আপন মনে। রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে গেয়ে উঠি _ " চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো ; ও-- রজনী গন্ধা তোমার গন্ধ সূধা ঢালো।" এমনি শত শহস্র গান লিখে গেছেন। তাঁর কবিতার ভান্ডারে কতো কথা, কতো ভাব। এর মাঝে তাঁর 'সোনার তরী ' কবিতায় পাই কৃষকের বেদনার কথা। আমরা রবীন্দ্রনাথ এর ' গোরা ' উপন্যাসে তৎকালীন সমাজের এক ধারনা পাই। আবার ' শেষের কবিতা ' উপন্যাস যারা পড়েছি তাদের মনে গেঁথে রয় অমিত এর মুখে ভালোবাসার সেই প্রকাশ, " কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালোবাসারই, কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল _ প্রতিদিন তুলব,প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যর সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা সে রইল দিঘি, সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে। " রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধ লিখে গেছেন। তাঁর ' সাহিত্যের তাৎপর্য' প্রবন্ধ পাঠ করলে, সাহিত্য কাকে বলে _ তার একটা নির্ভেজাল জবাব পেয়ে যাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর দার্শনিক চিন্তার খুঁজ মিলে ' মানুষের ধর্ম ' প্রবন্ধ গ্রন্থে। গ্রন্থটি ১৯৩৩ খ্রীষ্টিয় সালের মে মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম প্রকাশ হয়। তাঁর 'মানুষের ধর্ম' পাঠে পাই _ তিনি বলেন, "আমাদের জন্মভূমি তিনটি, তিনটিই একত্র জড়িত। প্রথম পৃথিবী। মানুষের বাসস্থান পৃথিবীর সর্বত্র।... মানুষের দ্বিতীয় বাসস্থান স্মৃতিলোক। অতীতকাল থেকে পূর্ব পুরুষদের কাহিনী নিয়ে কালের নীড় সে তৈরী করেছে। এই কালের নীড় স্মৃতি দ্বারা রচিত, গ্রথিত।... তাঁর তৃতীয় বাসস্থান আত্মিকলোক। সেটাকে বলা যেতে পারে সর্ব মানব চিত্তের মহাদেশ।" মানবতাবাদী কবি রবীন্দ্রনাথ মানুষ ও প্রকৃতিকে ভালোবেসেছেন। তিনি মনে করতেন, অহং এর মধ্যে সীমাবদ্ধ যে জীবন সেটা মিথ্যা। এদেশের ছোট বড় সকলের প্রিয় গান, তাঁর লেখা আমাদের জাতীয় সংগীত দেশমাতৃকা ও প্রকৃতির প্রতি এক গভীর মমতার গান। জানা আছে নিশ্চয় তাঁর কথামালা পৃথিবীর অন্যদেশে জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়। বিশ্বে আর কোনো লেখকের এমন কৃতিত্ব নেই। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বাংলার আকাশ ও মৃত্তিকার কাছাকাছি যে প্রকৃতি আছে আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে, তাকে আরও নিবিড় ভাবে বুঝতে ও কাছে পেতে শিখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতা, গল্প ও গানে। তাঁর 'এসো হে বৈশাখ এসো এসো ' গানের মাধ্যমে যে গ্রীষ্মকে অভিবাদন জানাই, তারপর আমাদের বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত পেরিয়ে বসন্ত ঋতুতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাই। বৃষ্টিতে যেমন রবীন্দ্রনাথ তেমনি রবী'র আলোতেও রবীন্দ্রনাথ। জোনাকিদের ভীরে যেমন রবীন্দ্রনাথ তেমনি এইখানে আমাদের মাঝে শত শত পাঠকের ভীরে রবীন্দ্রনাথ। মনেপড়ে সেই বিখ্যাত গানের কথা "
ও জোনাকী, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ।

 

আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ॥
তুমি নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্র, তোমার তাই ব'লে কি কম আনন্দ।
তুমি    আপন জীবন পূর্ণ ক'রে আপন আলো জ্বেলেছ॥"

 

শুরুতে বলেছি এই বড় মাপের কবি যেহেতু আমাদের সকলের জন্য লিখে গেছেন, তাই আমরা তাঁর সম্পর্কে শ্রদ্ধা ভরে কিছু বলতে পারি। তবে সবটুকু বলতে গেলে অনেক কিছু বাদ পড়ে যাবে। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে ২৫ শে বৈশাখ ১২৬৮ বাংলা সনে (৭ মে ১৮৬১ খ্রীষ্টিয় সাল) পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাতা সারদা সুন্দরী দেবীর ঘরে জন্ম নেয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে অনেক সাহিত্যিক তাঁদের শ্রদ্ধাপূর্ণ কথামালা তুলে ধরেছেন। মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর ' ন হন্যতে ' উপন্যাসে যেভাবে গুরুর প্রতি হৃদয়ের টান প্রকাশ করেছেন তার তুলনা হয়না। এতো শ্রদ্ধা, প্রেম ও ভক্তি একজন লেখক হিসেবে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ পেয়েছেন। জমিদার হলে এমন জমিদার হওয়া চাই, সকল বাঙালি মানুষের মনের জমিনে যে যুগে যুগে করে নিয়েছেন ঠাঁই।।

 

 

লেখক - মোহাম্মদ আব্দুল হক, কলামিস্ট ও সাহিত্যিক