প্রকাশিত: ০৪ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৪:০৩ (মঙ্গলবার)
মানুষের মুক্তি ও কাঠগড়ায় জেফারসন

হজরত মুহাম্মদ (সা.) জানান দিয়েছিলেন মানবমুক্তির শুভ সূচনার–ক্রীতদাস মুক্তির অমোঘ বার্তার। তারও পরে হাজার বছর পেরিয়ে এলেও পৃথিবীকে দেখতে হলো মার্কিন মুল্লুকে আঙ্কেল টমসদের আর রুটস’র কুন্তা-কিন্তের অমানবিক দুর্বিষহ জীবন যন্ত্রণাগুলো।

দীর্ঘ ১৮৭ বছর পর নিউইয়র্ক শহরের সিটি হল (মেয়রের অফিস) ভবনের কাউন্সিল অধিবেশন কক্ষ থেকে মানব-মুক্তির ত্রাতা বলে খ্যাত মার্কিন মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পূর্বপুরুষ তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন, যিনি নিজের হাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রস্তাবনাটি লিখেছিলেন এই বাক্য-সমষ্টি দিয়ে:

অল মেন আর ক্রিয়েটেড ইকুয়্যাল, দ্যাট দে আর এনডাউড বাই দেয়ার ক্রিয়েটর উইথ সারটেইন আনএলাইনেবল রাইটস, দ্যাট অ্যামাং দিজ আর লাইফ, লিবার্টি অ্যান্ড দ্য পারস্যুট অব হ্যাপিনেস।  

(যেহেতু সকল মানুষকেই সৃষ্টি করা হইয়াছে একই রকম করিয়া, ফলে তাহারা তাহাদের স্রষ্টার কাছ হইতে জন্মগতসূত্রেই কিছু অবিচ্ছেদ্য অধিকার লাভ করিয়াছে, যেগুলির মধ্যে রহিয়াছে জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখীজীবনের অন্বেষণ করা।)

সেই মহান ব্যক্তিত্বের মূর্তিটি নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের সদস্যদের ভোটে সম্প্রতি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কারণ, যে মানুষটি ‘সকল মানুষ’কে একই নিক্তিতে মাপার, ওজন করার কথা বলে মার্কিন সংবিধানের সূচনাংশ লিখেছিলেন ও প্রকৃতপক্ষেই সারা জীবন মানবমুক্তি ও স্বাধীনতার সপক্ষে লড়াই করে গেছেন, সেই মানুষটির বিরুদ্ধে অভিযোগ—উনি সকল মানুষকে ‘এক ও অবিভাজ্য’ বলে ঘোষণা দিলেও প্রকৃতপক্ষে উনি সকল মানুষকে ‘এক’ বলে ব্যক্তিজীবনে গ্রহণ করেননি। তাই তিনি সকল মানুষের ‘মুক্তির’ কথা বলেও ক্রীতদাস রাখতেন!

একজন নয়, দুজন নয়, তখনকার আভিজাত্যের নিশানা–প্রমাণস্বরূপ ছয় শতাধিক ক্রীতদাস রাখতেন! তখনকার দিনের রীতি আর চল ছিল সেটাই! সবাইকে ‘মানুষ’ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও ক্রীতদাসদের ‘মানুষ’ বলেই গণ্য করা হতো না বিধায় দেশে দেশে সব মানবমুক্তির ত্রাতা ও প্রগতিশীল মানুষেরা ওইভাবেই ক্রীতদাস রাখতেন আর অন্য সব মানুষের মুক্তি আর স্বাধীনতার জন্য কাজকর্ম করতেন! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাসংগ্রামের উদ্গাতারা সবাই মানুষের অধিকার ও মানবমুক্তিরই বন্দনা করেছিলেন কিন্তু সেই ‘মানুষের’ তালিকায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে ‘ক্রীতদাস’রা ছিল না! সেই ক্ষত ও হ্রদের রক্তক্ষরণ আজও, প্রায় আড়াই শ বছর পরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামোতে এবং অর্থনীতিতে মুখ ব্যাদান করেই বিদ্যমান।

বিগত অপশাসক ট্রাম্প মাত্র চার বছরের অপশাসনে সেই সত্যটিকে আরও বেশি করে সামনে এনে দিয়েছেন! তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিগত আড়াই শ বছরের শাসন একেবারেই শূন্যগর্ভ আস্ফালন নয়, সে কথা বলাই বাহুল্য। আর সে কারণে আজ এই প্রায় আড়াই শ বছর পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিতে সেই সব অবহেলিত-বঞ্চিত মানবসন্তানেরা, সেই চির পরিত্যাজ্য ক্রীতদাসদের সন্তানেরা আপন যোগ্যতা নিয়ে উঠে আসতে পেরেছেন, পারছেন রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামোর সিঁড়িগুলোতে! ফলে ‘ক্রীতদাস’ বংশধর হয়েও বারাক হোসেইন ওবামা বিশ্বের সর্বশক্তিধর ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে উত্থানের মধ্য দিয়ে। এখন এই আড়াই শ বছর পরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠছে ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান বা বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’!

কিন্তু আজকের বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতৃত্বের সেই মানবমুক্তির মহান চেতনা ও বাণী ‘অল মেন আর ক্রিয়েটেড ইক্যুয়াল’কে কলুষিত করেছে ক্রীতদাস, নারী শ্রেণি ও শক্তিকে ‘সকল মানুষের’ পর্যায়ভুক্ত না করার কারণে, না করতে পারার কারণে! তাই সেই পাপের দণ্ড ভোগ করলেন টমাস জেফারসন, নিউইয়র্ক সিটি হলের চেম্বার থেকে নির্বাসিত হয়ে।

এই আড়াই শ বছর ধরে যাদের এত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল, যাদের সজ্ঞানে অধিকারহীন করে রেখে মানবেতর জীবনের ঘানি টানতে বাধ্য করা হয়েছিল, আজ তারাই উঠে দাঁড়াচ্ছে ‘কালের শীর্ষে’! ফলে পূর্বপুরুষদের প্রতি দেখানো সেই অশ্রদ্ধা ও নিষ্ঠুরতার ‘প্রতিশোধ’ নিতে যুক্তরাষ্ট্রজুড়েই এখন চলছে সেই ‘কলুষতাভুক্ত’ ইতিহাসকে কলুষতামুক্ত করে নেওয়ার; অতীত পাপের দায়ভার নিয়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকালীন পিতৃদেবদের সব উল্লেখযোগ্য ও দৃশ্যমান স্থান থেকে দূরে সরিয়ে রাখার!

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার পিতৃপুরুষেরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকালে ভীষণভাবেই উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ফরাসি বিপ্লবের চেতনা ও অঙ্গীকারনামা দিয়ে। যে ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম উদ্গাতা ছিলেন দার্শনিক জ্যঁ জ্যাক রুশো, যাঁর একটি বহুল উদ্ধৃতিযোগ্য উক্তি হলো: ‘ম্যান ইজ বর্ন ফ্রি বাট এভরিহোয়্যার ইজ ইন চেইন’–মানুষ জন্ম-স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্রই শৃঙ্খলিত! রুশোর ভক্ত-অনুরক্ত হয়েও যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাকালীন পিতৃপুরুষেরা সেই চেতনাধারায় সিক্ত হয়েও টমাস জেফারসনের মতো মুক্তবুদ্ধির মানবপ্রেমিক অল মেন আর ক্রিয়েটেড ইক্যুয়াল আপ্তবাক্যটি মুখে তুলে নিয়েও ‘সকল মানুষের’ মুক্তিকে নিশ্চিত করতে পারেননি। ফলে অতীত যুগের কালের নায়কদের অন্যকে অবজ্ঞা-তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার ‘অপরাধের’ দণ্ড দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে এভাবেই আজ এ কালে-এ যুগে প্রতিশোধ নেওয়ার মাধ্যমে! তবে আজকের মানদণ্ডে অতীত চিন্তা-চেতনাব্যবস্থার বিচার করলে খুব একটা সুবিচার করা যাবে না, সে কথাও সত্য। আদিম ‘পশু-মানুষ’কে মানুষ হয়ে সভ্যতার উষালগ্নে এসে পৌঁছাতে হাজার হাজার বছর লেগেছে। সব বিশ্বাস-সত্য-ধ্যান-ধারণা
মুহূর্তের মধ্যেই পরিবর্তন হওয়া বা করার বিষয় এটি নয়।

এই আত্মোপলব্ধি বহু সাধনার ধন আর হাজার বছরের সভ্যতার যাত্রাপথে দেখে দেখে, ঠেকে ঠেকে অর্জন করার বিষয়। এই ক্রীতদাস প্রথা ছিল ‘সেই যুগের ধর্ম’! ফলে জ্ঞানী-গুণী-আলোকিত লোকেরাও দেশে দেশে চলমান প্রথা-পদ্ধতিকে ছাপিয়ে চলে যেতে পারেননি। বিশ্বজুড়েই এই অমানবিক ক্রীতদাস প্রথা ছিল অন্যতম লাভজনক ব্যবসা। ফলে সভ্যতা-জ্ঞান-আলোকিত আত্মা—সবকিছুই ওই ব্যবসায়িক লাভালাভের আঁধারে ঢেকে গিয়েছিল। তবু যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র আড়াই শ বছর আগের জ্ঞানী-গুণী-আলোকিত লোকেরা ক্রীতদাস প্রথাকে উপড়ে ফেলতে পারেননি সত্য, কিন্তু তারও বহু আগে, ১৪০০ বছরের আগে আরব দেশের নৈরাজ্যময় সামাজিক জীবনে আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে ইসলাম ধর্মের বাণী-বন্দনায় হজরত মুহাম্মদ (সা.) জানান দিয়েছিলেন মানবমুক্তির শুভসূচনার—ক্রীতদাস মুক্তির অমোঘ বার্তার। তারও পরে হাজার বছর পেরিয়ে এলেও পৃথিবীকে দেখতে হলো মার্কিন মুল্লুকে আঙ্কেল টমসদের আর রুটস’র কুন্তা-কিন্তের অমানবিক দুর্বিষহ জীবন যন্ত্রণাগুলো।

তবে টমাস জেফারসনদের দার্শনিক আপ্তবাক্য আওড়ানো ও ব্যক্তিজীবনের মধ্যে যতই ফারাক থাকুক না কেন, এ কথা স্বীকার করতেই হবে ওই সব উল্লিখিত ও আওড়ে যাওয়া আপ্তবাক্যের কৌলীন্যেই মানবসভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ সম্ভব হয়েছে আর মানুষ আঁধার পেরিয়ে আলোকেরই ঝরনাধারায় ভেসে যেতে পেরেছে, পারছে আজও!

*লেখক: সেলিম রেজা নূর, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাসরত সাংবাদিক।

(আজকের পত্রিকার সৌজন্যে)
সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে