প্রকাশিত: ৩১ মে, ২০২২ ১২:৪৭ (শনিবার)
মহিয়সী সুহাসিনী

যুগে যুগে এই বঙ্গভূমিতে জন্মেছেন অনেক ক্ষনজন্মা মানব-মানবী। এক এক অঙ্গনে ছিল তাদের অবদান। নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে এঁরা মানবসমাজ তথা দেশ ও দশের অপার কল্যাণ সাধন করে গেছেন। অতি নগন্য যে কয়জন মহিয়সী নারী এদেশে জন্মেছেন তাদের মধ্য শ্রীযুক্তা সুহাসিনী দাশ অন্যতম। খুব বেশি প্রচার-প্রসার না থাকলেও তিনি ছিলেন সর্বত্যাগী সমাজসেবী ও ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের একনিষ্ঠ কর্মী। আরাম-আয়েশকে বিসর্জন দিয়ে স্বাবলম্বী ও বস্তুনিষ্ঠ কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে হয়ে ওঠেন এক উজ্জল নক্ষত্র।


ক্ষণ গণনায় সময়কাল ১৩২২ বঙ্গাব্দ। ইংরেজি ১৯১৫ সাল। তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমার জগন্নাথপুরে বাস করেন প্যারীমোহন রায় ও শোভা রাণী দম্পতি। ঐ বছরের পহেলা ভাদ্র তারিখে এই দম্পতির প্রথম সন্তান হিসেবে কোল আলো জন্ম নেয় এক কন্যা-শিশু। পিতা-মাতার আদুরে নাম সুহাসিনী। সময়ের ব্যবধানে এ শিশু-কন্যাই পরিণত হলেন এক মহিয়সী নারীরূপে।


যে সময়টিতে তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, সেটি আজ থেকে প্রায় শতাব্দীকাল আগের। তখনকার দিনে নারীশিক্ষা প্রায় নিষিদ্ধ একটি প্রথা। তারপরও পিতা-মাতা সাহস করে মেয়েকে ভর্তি  করে দেন বিদ্যালয়ে শিক্ষিত করে তোলার প্রত্যাশা নিয়ে। সেসময় নারী-শিক্ষার প্রচলন না থাকায় সাধারণভাবে অভিভাবক মহলে প্রচলিত প্রথা ছিলো কন্যা সন্তানদের দ্রæত পাত্রস্থ করা। তাই সদিচ্ছা থাকা সত্বেও, প্যারীমোহণ-শোভা দম্পতি সেই প্রথার খুব বেশি বাইরে যাওয়ার দুঃসাহস দেখালেন না। কন্যার বয়ঃক্রম দশ না পেরোতেই, মেয়ে স্কুলে কি শিখলো তার সন্ধান না করে পাত্রের সন্ধানে তারা অধিকতর তৎপর হলেন। অবশেষে সুহাসিনীর পিতা-মাতা তাদেরই মতো আরেক ধনাঢ্য পরিবারে মেয়ের বিয়ে ঠিক করলেন। বাংলা ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের এক শুভদিনে কৈশোর না পেরোতেই মাত্র পনের বছর বয়সে পিতা-মাতার আদরের দুলালী বসলেন বিয়ের পিড়িঁতে। গ্রামের চঞ্চল-উচ্ছল জীবনকে পেছনে ফেলে কিশোরী সুহাসিনী নৌকো আর পালকি চড়ে চলে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে। পাত্র সিলেটের তৎকালীন কোঁটিচাঁদ প্রেসের মালিক শ্রীযুক্ত কোঁটিচাঁদ দাশের তৃতীয় পুত্র কুমুদ চন্দ্র দাশ।


বিয়ে পরবর্তি দিনগুলি তার মোটেই সুখকর হয়নি। দাম্পত্য জীবনের উষালগ্নেই নেমে আসে দুঃখের ছায়া। তার পিতা-মাতার দেয়া সুহাসিনী নামটির মর্যাদা রক্ষিত হয়নি। দাম্পত্য জীবনের শুরুতেই জীবন থেকে হাসির রেখা মিলিয়ে গিয়ে মাত্র বিশ বছর বয়সে অকাল বৈধব্য বরণ করেন। কিন্তু সেই দুঃখ সিন্ধুর মধ্য থেকেই জেগে উঠে এক অসম-সাহসী দেবী। এক ঐশ্বরিক আহবানে অকাল-বৈধব্য বরণকারী গৃহবধু তার অবগুন্ঠন ফেলে দিয়ে পা রাখলেন এক বিদ্রোহী অথচ অহিংস জগতে। গৃহের, সংসারের তথা সকল বাধা-বন্ধন তার কাছে তুচ্ছ হয়ে এক অজানা অগ্নিমন্ত্রের দিক্ষা তাকে এক সাহসী যোদ্ধায় পরিণত করলো। একদিন মিশে গেলেন দুঃখী আর ব্যথিত জনতার মাঝে। স্বদেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার টানে একদিন পর্দা প্রথাকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীনতা সংগ্রমে সক্রিয় অংশগ্রহন করেন। ব্রিটিশদের কবল থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার দৃপ্ত-শপথ নিয়ে লড়াই শুরু করেন। জীবনভর অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেও অভিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে গেছেন। এক পর্যায়ে শ্রমজীবি আর দরিদ্র শ্রেণির মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিজ্ঞা করেন, সারাজীবন খদ্দরের কাপড় পরিধান করবেন।  শুধু তাই নয়, পরনের শাড়ি থেকে শুরু করে বিছানার চাদর, জানালার পর্দা, সর্বত্র খদ্দর। তাঁর ধারণা, মিলের কাপড়ের টাকা যাবে ধনিক শ্রেণির পকেটে, আর খদ্দর কাপড়ের টাকা পাবে শ্রমজীবী গরীব লোকরা।   


উনিশ’শ বিয়াল্লিশ সালে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে গোটা ভারতবর্ষ উত্তাল। আর সেই আন্দোলনে বিপ্লবী ভুমিকার জন্য সুহাসিনী গ্রেফতার হন পুলিশের হাতে এবং কারাবরণ করেন। পরের বছর বৃটিশ শাসকগোষ্টির প্রথ্যক্ষ মদদে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে সেই দাঙ্গা মোকাবেলায় এবং আর্ত মানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন সুহাসিনী।
উনিশ’শ তেতাল্লিশ সাল পূর্ববঙ্গের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়। নোয়াখালিতে শুরু হয এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। অসংখ্য মানুষ নিহত ও নির্যাতিত হয়। দাঙ্গা নিরোধে স¦য়ং মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত ছুটে এলেন সেখানে। সেই অভিযানে সামিল হলেন সুহাসিনীও। গান্ধীজীর সাহচর্যে এসে দাঙ্গা প্রতিরোধে প্রাণপন চেষ্টা ও দূর্গতদের সেবা প্রদান করেন।


দেশবিভাগের পর ১৯৫০ সালে দাঙ্গার পর দলে দলে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা যখন দেশ ত্যাগ করছিলো তখনো তিনি ছিলেন নির্বিকার। প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে না গিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করেন আর্তমানবতার সেবায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও যুদ্ধের স্বপক্ষে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। হানাদার পাকবাহিনী যখন গনহত্যা চালাচ্ছিলো তখন তিনি তাঁর আরেক প্রাণের প্রতিষ্ঠান রঙ্গিরকুল আশ্রমে থেকে দুঃখী মানুষের সেবা করেছেন।

এর পর একের পর এক বিপ্লবী ভূমিকা পালন করে পরিণত হয়েছেন এক ঐতিহাসিক চরিত্রে। অর্ধ শতাব্দিরও বেশি সময় ধরে আজীবন আর্ত-মানবতার সেবায় নিয়োজিত থেকে এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। উনিশ’শ সাতচল্লিশ সনে দেশ বিভাগের পর শত-সহ¯্র বিপদগ্রস্ত নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, দেশ ত্যাগ না করার প্রচার চালিয়েছেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পূনর্বাসনের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। ১৯৬২ সনে সিলেটের চালিবন্দরে শ্রীযুক্ত নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামী কর্তৃক ‘উমেশ-নির্মলা’ ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় সহযোগিতা করেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা লাভের পর যুদ্ধবিদ্ধস্ত সিলেটে পুনর্বাসনের কাজ করেছেন। সমাজে অনাথ ও আশ্রয়হীন ছেলেমেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘শ্রীকৃষ্ণ সেবাসদন’। ঐ সেবা প্রতিষ্ঠানে অনেক অনাথ ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও বিভিন্ন কর্মমূখী কাজের ব্যবস্থা করা হয়।

তিনি কয়েকটি আন্তর্জাতিক কর্মসূচিতেও দেশের প্রতিনিধি হয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৭৩ সালে বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এক মহাসম্মেলন দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে সুহাসিনী দাসও ওই সম্মেলনে যোগ দেন। সেখানে তাঁর সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু, সর্দার বল্লবভাই প্যাটেল, আচার্য বিনোবাভাবে, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, ড. জাকির হোসেনের বিশ^বরেণ্য নেতৃবৃন্দ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি স্বয়ং তাদের অভ্যর্থনা জানান।


দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, নিঃস্বার্থ জনসেবা এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, জাগতিক আরাম আয়েশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, সবকিছু ত্যাগের দৃষ্টান্ত তাঁকে ইতিহাসে এক মহিয়সী নারী রূপে স্থান লাভ করার গৌরব এনে দিয়েছে। তিনি শিখিয়েছেন, নিজের ধর্মে নিষ্ঠাবান থেকেও অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করা যায়। তিনি বুঝিয়েছেন, দেশের নারীসমাজ সুশিক্ষায় শিক্ষিত না হলে জাতি উন্নত হতে পারে না।
তিনি আরও শিখিয়েছেন, প্রয়োজনে প্রতিবাদী হতে ও নির্ভয়ে সত্য কথা বলতে। তিনি শিখিয়েছেন মাতা আর মাতৃভূমি প্রত্যেক মানুষের পরম শ্রদ্ধার বস্তু। সুহাসিনী কারো কাছে ছিলেন দিদি, কারো কাছে মাসীমা, আবার কারো কাছে জননী সমতুল্য। তার স্মৃতি জেগে আছে ভক্তকূল ও আপামর জনগনের হৃদয়ে। সৌভাগ্যের বিষয়, এই মহিয়সীর প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ তার নামে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হলের নামকরণ করা হয়েছে। তবে এই যথেষ্ট নয়। দেশ ও সমাজের কাছে এই মহিয়সীর রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু প্রাপ্য। তাঁকে উপযুক্ত সম্মান জানানো হলে সকলের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।


মানুষের গড় আয়ু বিবেচনায় তিনি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘজীবী ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৯৪ বছর। সম্ভবত অতি সাধারণ সন্ন্যাসীসুলভ জীবনাচার ও কঠোর পরিশ্রম তাঁর দীর্ঘজীবন লাভে সহায়ক হয়েছে। তারপরও তাঁর ভক্তকূল ও শুভানুধ্যায়ী মহলের কাছে এটি যেন ছিলো অকালমৃত্যু। তাঁর কাছে দেশ ও সমাজের চাওয়া-পাওয়া যেন শেষ হয়েও হইলো না শেষ। যদি তাঁর পার্থিব জীবন আরও একটু দীর্ঘ হতো, তাঁর অকৃপন সেবায় দেশ ও সমাজ আরও ধন্য হতে পারতো । তাঁর প্রয়াণে অগণিত ভক্তকূল যেন হারাালো এক ¯েœহময়ী জননীকে।

ইংরেজি ২০০৯ সালের ৩০ মে ক্ষণজন্মা এই মহিয়সী পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। তাঁর ত্রয়োদশ প্রয়াণ দিবসের প্রাক্কালে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে জানাই অকুন্ঠ শ্রদ্ধা।


লেখক: অধ্যাপক, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।