ছোট্ট একটি শিশুর ছবি। সিংহাসনের উপড় বসে আছে হাতে একটি নাড়ু নিয়ে, কিংবা বসে আছে একটি বাঁশি নিয়ে। শিশুরা নাকি বড়দের খেলনাস্বরূপ। এই শিশুটিও যেন সেরকম একটি খেলনা বিশেষ। মায়াময় একটি মুখ, আর আদর কেড়ে নেওয়া চাহনি। মনেই হবে না যে, সে একজন দেবতা।
অন্যকথায় স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুর মানবরূপী অবতার। দেখলেই কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে। নাড়ু হাতে যখন মিটিমিটি হেসে তাকায়, তখন তাঁকে বাড়ির আদরের ছোট্ট খোকাটির মতই মনে হবে। ইচ্ছে করবে আদরে আদরে ভরিয়ে দিই। ক্ষনিকের জন্যও মনে হবে না, বড় হয়ে এই শিশুটিই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে পান্ডব বীর ধনুর্ধর অর্জুনকে মনুষ্য জীবনের সারাৎসার বুঝাবেন, আর সেই মর্মবাণীই একদিন সকল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ ‘শ্রীমদ্ভাগবত গীতা’ রূপ নেবে। ইনিই হস্তিনাপুর রাজসভায় নির্যাতিতা পাঞ্চালীর সম্ভ্রম রক্ষা করবেন। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করার জন্যই নররূপে নারায়ণ আবির্ভুত হবেন দ্বাপর যুগে। একজন প্রজাবৎসল রাজা হিসেবে দ্বারকা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। আবার বংশীবাদক একটি রাখাল বালকরুপে বৃন্দাবনের কদমতলায় আপন মনে বাঁশি বাজাবেন।
জন্মাষ্টমীর দিনটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস থেকে শুরু করে লোকাচারসহ অন্যান্য কাহিনি। বিভিন্ন উৎস থেকেই এটি প্রতীয়মান হয় যে, শ্রীকৃষ্ণ ইতিহাসমান্য এক চরিত্রবিশেষ। ভগবান বিষ্ণুর মানব অবতার কৃষ্ণ। মথুরার অত্যাচারী রাজা কংসকে বধ করার জন্য তাঁর জন্ম হয়েছিল। তিনি দেবকী ও বসুদেবের অষ্টম সন্তান। জ্যোতিষশাস্ত্রের গনণা অনুসারে কৃষ্ণের জন্মতারিখ হলো খৃষ্টপূর্ব ৩২২৮ সালের ১৮ জুলাই এবং তাঁর মৃত্যুর দিন খৃষ্টপূর্ব ৩১০২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। শ্রীকৃষ্ণ মানব পরিচয়ে মথুরার যাদব বংশের বৃষ্ণি গোত্রের মানুষ ছিলেন।
কথিত আছে, স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু কারাগৃহে উপস্থিত হয়ে দেবকী ও বসুদেবকে দর্শন দেন এবং তাঁদের পূর্বজন্মের তপস্যা সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি জানা, তপস্যার পুণ্যফলেই দেবকী ও বসুদেবের কাছে তিনবার অবতার হিসেবে আবির্ভুত হওয়ার প্রতিশ্রæতি দেন। বিষ্ণু দেবকীকে জানান, প্রথম জন্মে বৃষ্ণীগর্ভ নামক এক পুত্র হয়। দ্বিতীয় জন্মে দেবকী যখন দেবমাতা অদিতি ছিলেন, তখন বিষ্ণু ছিলেন তাঁর পুত্র উপেন্দ্র এবং তিনিই বামন অবতার রূপে রাজা বলিকে উদ্ধার করেন। এবার তৃতীয় জন্মে দেবকীপুত্র কৃষ্ণ হিসেবে জন্মগ্রহন করে তাঁর প্রতিশ্রুতি পুরো করেন বিষ্ণু।
পুরাণ এবং ইতিহাস মতে, মথুরার যুবরাজ কংসের ভগিনি রাজকন্যা দেবকীর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল আরেক বৃষ্ণিবংশীয় রাজা বসুদেবের সাথে। বোন ও ভগ্নিপতি যুবরাজ কংসের নিকট অত্যন্ত প্রিয় ছিল। এমন কি বিবাহের পর তিনি নিজে রথ চালিয়ে দেবকী ও বসুদেবকে পৌঁছে দিতে চলেছিলেন তাদের রাজ্যে। পথিমধ্যে দৈববাণী হয় কংসের উদ্যেশে যে, তিনি যাকে এত সমাদরে রথে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সেই দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান-ই তারর মৃত্যুর কারণ হবে। চকিতে কংসের চিত্ত বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তখনই কংস হত্যা করতে উদ্যত হন দেবকীকে। এই সময় বসুদেব প্রতিশ্রুতি দেন যে, তারা তাদের প্রতিটি সন্তানকে জন্মের অব্যবহিত পরেই তুলে দেবেন কংসের হাতে। কিন্তু তাতেও কংস সংশয়মুক্ত হতে পারলেন না। বোনকে চোখে চোখে রাখার জন্য কংস দেবকী ও বসুদেবকে মথুরায় ফিরিয়ে এনে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। এমনকি পিতা রাজা উগ্রসেন বিরোধিতা করার কারণে দুরাচার কংস তাঁর পিতাকেও সিংহাসনচ্যুত করে কারাগারে পাঠিয়ে মথুরার সিংহাসনে আরোহন করেন।
শ্রাবণ মাসের দ্বিতীয় পক্ষ অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীতে রোহিণী নক্ষত্রের বুধবার মধ্যরাতে কৃষ্ণ জন্ম নেন মথুরার কারাগারে। জন্মের পরেই শিশুটিকে মেরে ফেলা হতে পারে এই আশঙ্কায় তাকে বৃন্দাবনে বসুদেবের মিত্রবর নন্দরাজের বাড়িতে রেখে আসা হয়েছিল। যাওয়ার লগ্নে অলৌকিকভাবে কারাগারের দরজা খুলে যায়, প্রহরীরা ঘুমিয়ে পড়ে। অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে, দুর্দান্ত যমুনা পার হয়ে সেই শিশুকে নিয়ে বসুদেব বৃন্দাবনে পৌঁছে যান। সেখানে বসুদেব গোপনে সেই সন্তানকে নিদ্রিত নন্দ ও যশোদার কাছে রেখে আসেন। তার পরিবর্তে নন্দ ও যশোদার কন্যা সন্তানকে নিয়ে আসেন বসুদেব, যাতে তাঁদের অষ্টম সন্তান কৃষ্ণের কোন খোঁজ না পান কংস। ওই কন্যাসন্তানকে তারা তুলে দেন কংসের হাতে। কিন্তু কংস যখন তাকে হত্যা করতে উদ্যত হন, তখন সেই কন্যাসন্তানই মহামায়ার রূপ ধারন করেন এবং কংসের সকল কুকর্মের জন্য সতর্ক করে দেন।
গোকুলে গোপগৃহে দেবকী ও বসুদেবের সেই সন্তান বড় হয়ে উঠতে থাকে। ঋষি গর্গ তাঁর গায়ের রং কালো বলে তাঁর নাম রাখেন কৃষ্ণ। শৈশব থেকেই অত্যধিক চঞ্চল এই শিশুর দৌরাত্ম্যে অস্থির ছিল গোকুল, মাখন এবং ননী চুরি ছিল তাঁর নিত্যকর্ম। কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী ভগবানের এই বাল্যলীলার উদ্যেশেই নিবেদিত।
মূলত অসুরদের বিনাশ করে প্রেমধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। যদিও এটি তাঁর মনুষ্যরূপ, আর সেইরূপেই তিনি আবদ্ধ, তবুও প্রকৃতপক্ষে তিনি অসীম ও সর্বশক্তিমান। তিনি ভগবান, কিন্তু মনুষ্যরূপ ধারণ করে মনুষ্যলোকে অবতীর্ণ হয়েছেন জীবের আদর্শ হয়ে জগতের মঙ্গলের জন্য। শ্রীকৃষ্ণের বাঁশীর সুমধুর সুরেই সমগ্র জগতবাসীর জীবন হয়ে উঠুক সঙ্গীতময়, সুন্দর ও সমৃদ্ধ।
লেখক: অধ্যাপক, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।