প্রকাশিত: ০৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ ১২:১৫ (শুক্রবার)
তুরস্কে ভূমিকম্প: যে শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশ

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা আজকাল অনেক শোনা যায়। বলা হয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই মানবসভ্যতাই পাল্টে ফেলবে, মানুষের সব কাজকর্মই যন্ত্র করবে। যন্ত্রই মানুষকে চালাবে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারে, যোগাযোগের অসীম বিস্তারে এই ধারণা শক্তিশালী হয়েছে যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে আধুনিক শিল্পসমৃদ্ধ সমাজে লোকে যান্ত্রিক জীবনযাত্রায় গা ভাসিয়ে আরামে বসবাস করবে। কিন্তু বিষয়টি যে তা নয়, তা বারবার দেখতে হচ্ছে আমাদের।

এত এত আধুনিক ব্যবস্থা, রাডার, আবহাওয়া নজরদারির ব্যবস্থা, প্রযুক্তি—কী নেই? তবুও কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো তুরস্ক ও সিরিয়ার একাংশ।ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় নিহত মানুষের সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে, আরও ছাড়াবে। ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে এই ভূমিকম্প হয়। সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের গাজিয়ান্তেপ শহরের কাছে ছিল ভূমিকম্পের কেন্দ্র। ভূপৃষ্ঠের ১৭ দশমিক ৭ কিলোমিটার গভীরে ছিল এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা ছিল ৭.৮। ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ধসে পড়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি, যার মধ্যে অনেক বহুতল ভবন রয়েছে।

প্রযুক্তি এই পর্যায়ে পৌঁছেনি যে, ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস দেওয়া যায়। প্রকৃতি এমন ভয়ংকরভাবে নিরীহ মানুষের ওপর নেমে আসবে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ভূকম্পনের ফলে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল হাজারও ভবন। তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও বহুবার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে তুরস্কে। সাধারণত, টেকটোনিক প্লেটের অবস্থান পরিবর্তনের ফলে ভূমিকম্প হয়। চারটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে তুরস্কের অবস্থান। তাই ভূমিকম্প ঝুঁকিতে যেসব দেশ আছে তাদের মধ্যে অন্যতম তুরস্ক।তুরস্কের বেশিরভাগ অংশ অ্যানাটোলিয়ান টেকটোনিক প্লেটের উপর অবস্থিত। এটি আবার ইউরেশীয়, আফ্রিকান ও অ্যারাবিয়ান টেকটোনিক প্লেটের মধ্যস্থলে।

অ্যানাটোলিয়ান প্লেট ঘড়ির কাটার উল্টো দিকে ঘোরে। অন্যদিকে, আরবীয় প্লেট নিয়মিত আঘাত করে অ্যানাটোলিয়ান প্লেটকে। বারবার আঘাতের ফলেই হঠাৎ বড় কম্পন হয়। ঠিক কোথায় ও কখন ভূমিকম্প হবে তার আগাম খবর দেওয়া অসম্ভব। অধিকাংশ বড় ভূমিকম্পের পরেই ঘটে বহুসংখ্যক ‘আফটারশক’, যেমন ঘটেছে তুরস্ক ও সিরিয়ায়। এর আগে এই অবস্থা আমরা দেখেছি নেপালেও। কিছু ক্ষেত্রে আবার প্রধান ভূকম্পের আগেও অনেক ছোট ছোট কম্পন অনুভূত হয়। বাংলাদেশে মাঝে মাঝেই ছোট ও মাঝারি কম্পন ঘটে।

অনেকেই আলোচনায় আনছেন বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। পূর্বাভাস দিতে না পারলেও বিজ্ঞান কোনো বিশেষ দেশ বা স্থান কতটা ভূমিকম্প প্রবণ, কতটা ঝুঁকিপূর্ণ সেটা অনুমান করতে পারে। এর জন্যে দরকার প্রচুর তথ্য, নিয়মিত ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ, মাটি থেকে পুরোনো ভূকম্পনের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা রাখা। প্রয়োজন যথেষ্ট সংখ্যায় উন্নত গবেষণাগার, যেখানে শুধু ভূকম্পন বিশারদরাই থাকবেন না, থাকবে মৃত্তিকা ও পাথরের বয়স নির্ধারণ করার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। দরকার আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক-এর নিবিড় যোগাযোগ। ভূবিজ্ঞানীরা ব্যবহার করছেন গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিতে এখন পৃথিবীর উপরিস্তরের প্লেট সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব।

একটি লেখায় দেখলাম, এই প্রযুক্তিতেই আমেরিকার পারডিউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এরিক কালাইস হেইতি দ্বীপে ২০১০ সালে যে এক ভয়ংকর ৭.২ মাত্রার ভূমিকম্প হবে তার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। সেই ভূমিকম্প ঘটেছিল জানুয়ারির ১০ তারিখে। ঠিক কোন দিনে হবে যদিও বলা সম্ভব হয়নি, তবে সম্ভাব্য সময়ের পূর্বাভাস বাঁচিয়ে দিতে পেরেছিল বহু জীবন ও সম্পত্তি। সিরিয়া যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ। কিন্তু তুরস্কের মতো একটি উন্নত ইউরোপীয় দেশ কেন পারল না কোনো ব্যবস্থা নিতে সেই প্রশ্ন উঠতে পারে।

প্রযুক্তি ও গবেষণা জরুরি। এর চেয়েও জরুরি ভূমিকম্প প্রতিরোধী বাসস্থান নির্মাণ করা যেটা জাপান করছে। প্রকৃতির দিকে নজর না দিয়ে যথেচ্ছভাবে বহুতল বানানোর লোভ আমাদের ঠেলে দিয়েছে আজকের এই পরিণতির দিকে। ঢাকা শহর তো ভরে গেছে, অন্যান্য শহরগুলোও পরিণত হচ্ছে উঁচু ভবনের নগরে। ভবন নির্মাণের মান, ব্যবহৃত সামগ্রী যে অতি নিম্নমানের তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই কোথাও।

আমাদেরও সতর্কতা প্রয়োজন। মানুষকে সচেতন করা প্রয়োজন। যেভাবে আমরা বিভিন্ন এলাকায়, এর মধ্যে ভূমিকম্প প্রবণ এলাকাও রয়েছে, প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করছি, তাতে ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্পই ব্যাপক জীবন ও সম্পত্তিহানি ঘটাতে পারে। রাজধানীর কথায় বেশি আলোচিত হচ্ছে। এখানে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প এলে উৎসস্থলের ১০০ কিলোমিটার বৃত্তে তুমুল ক্ষয়ক্ষতি হবে। এর জন্য পরিকল্পনাবিহীন নগরায়ণই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চার দশকে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় হাজার গুণ। যার চাপ সামলাতে প্রায় সব এলাকায় যথেচ্ছভাবে জঙ্গল কাটা হয়েছে, জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। পরিকল্পনা ছাড়াই তৈরি হয়েছে অজস্র বহুতল আবাসন ও সরকারি বেসরকারি বাণিজ্যিক ভবন। বাংলাদেশের দু’দিকের ভূ-গঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে। এর একটা হচ্ছে উত্তর-পূর্ব কোণে সিলেট অঞ্চলে ডাউকি ফল্টে, আরেকটা হচ্ছে পূর্বে চিটাগাং ত্রিপুরা বেল্টে পাহাড়ি অঞ্চলে।

এখানে দুটি বড় ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। যেকোনো সময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা অমূলক নয়। কাজেই এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা কতটা প্রস্তুত সেটা বিবেচনায় আনা খুবই জরুরি।


লেখক: সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন