প্রকাশিত: ১৮ মার্চ, ২০২৩ ২১:১৫ (বৃহস্পতিবার)
রেকর্ডময় ম্যাচে বাংলাদেশের দাপুটে জয়

‘প্রথম দিনের সূর্য’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন “প্রথম দিনের সূর্য / প্রশ্ন করেছিল / সত্তার নতুন আবির্ভাবে- / কে তুমি? মেলে নি উত্তর।”

কখনো কখনো উত্তর আসলেই মেলে না!

প্রথম প্রহরের সূর্য দেখে নাকি দিনটা কেমন যাবে, সেটা বলে দেওয়া যায়। কিন্তু কখনো কখনো এর উল্টোটাও তো হয়! ১৬.৩ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে ৮১ রান করা বাংলাদেশ পরের ৩৩.৩ ওভারে (২০১ বল) ২৫৭ রান করে বসবে, সেটা কে ভেবেছিল!

আবার বড় লক্ষ্যের পানে ছুটতে গিয়ে ১১.১ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে ৬০ রান তুলে ফেলা আয়ারল্যান্ড যে পরের ১৬ রান তুলতে ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলবে, সেটাই বা কে ভেবেছিল!

শুরু দেখে শেষটার উত্তর তো আসলেই মেলেনি বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড প্রথম ওয়ানডেতে! রেকর্ডময় ম্যাচটিতে আয়ারল্যান্ডকে ১৮৩ রানে হারিয়ে দাপুটে জয় পেয়েছে টাইগাররা। নিজেদের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়ের রেকর্ড।

ম্যাচজুড়ে ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের ঝলক। ব্যাটিংয়ে সাকিব আল হাসান আর তৌহিদ হৃদয় অল্পের জন্য মিস করেন সেঞ্চুরি। সাকিব পৌঁছান দুটি মাইলফলকে। হৃদয় খেলেন অভিষেকে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। মিডল অর্ডারে ঝড় তুলেন মুশফিকুর রহিম। তাতেই ওয়ানডে ম্যাচে নিজেদের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ৩৩৮ রান পেয়ে যায় বাংলাদেশ। এরপর বোলিংয়ে ইবাদত হোসেন চৌধুরী, নাসুম আহমেদ, তাসকিন আহমেদরা কাজটা করে গেছেন ঠিকঠাক। আইরিশদের শুরুর প্রতিরোধ গুড়িয়ে দিয়ে উইকেট তুলে নিয়েছেন টপাটপ। তাতেই বাংলাদেশে পেয়েছে রেকর্ড ১৮৩ রানের ব্যবধানে জয়।

এর আগে এই সিলেটের মাঠেই ২০২০ সালে জিম্বাবুয়েকে ১৬৯ রানের ব্যবধানে হারানো ছিল বাংলাদেশের বড় ব্যবধানের জয়।

সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টসে হেরে বাটিংয়ে নামা বাংলাদেশের শুরুটা খুব বেশি আশাজাগানিয়া ছিল না। পঞ্চাশ রানের মধ্যে তামিম ইকবাল আর লিটন দাস ফিরে যান। দলীয় ৮১ রানে বিদায় নেন নাজমুল হোসেন শান্তও।  তিন উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ যেন খানিকটা নড়বড়ে।

এরপরই দুর্দান্ত এক জুটি। আজই ওয়ানডে অভিষিক্ত হওয়া তৌহিদ হৃদয় এসে জুটি গড়ে তুলেন সাকিবের সঙ্গে। সাকিব ছিলেন ছনমনে, হৃদয় ঝলমলে। এ দুজনের জুটিতে রান ওঠে পাল্লা দিয়ে। তাদের ১২৫ বলে ১৩৫ রানের দারুণ জুটি ভাঙে সাকিবের বিদায়ে। চতুর্থবারের মতো নড়বড়ে নব্বইয়ে থেমে যান এই অলরাউন্ডার। ৮৯ বলে নয়টি চারে তার ৯৩ রানের ইনিংস থামে হিউমের বলে ক্যাচ দিয়ে। এর মধ্যে হ্যারি টেক্টরের এক ওভারেই সাকিব মারেন পাঁচটি চার!

বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে নড়বড়ে নব্বইয়ে চারবার আটকে যাওয়ার রেকর্ড একার ছিল মুশফিকের। সেই রেকর্ডে ভাগ বসালেন সাকিব।

সেঞ্চুরি না পেলেও সাকিব ছুঁয়েছেন দুটি মাইলফলক। এ ম্যাচের আগে ৭ হাজার রান থেকে ২৪ রান দূরে ছিলেন সাকিব আল হাসান। ব্যাটিংয়ে এসে ইনিংসের ১৯তম ওভারে যখন ২৪ রান পূর্ণ করেন, সাকিব ৭ হাজার রানের তীরে নোঙ্গর ফেলেন। সাকিবের আগে একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে তামিম ইকবাল এই মাইলফলক পেরিয়ে গেছেন। ২৩৩ ওয়ানডেতে ১৪ সেঞ্চুরি ও ৫৫ ফিফটিতে তামিমের রান ৮১৪৬।

সাকিব আল হাসান এখন ওয়ানডে ক্রিকেটের সেই তিন ক্রিকেটারের একজন, যাদের ৭ হাজার রান ও ৩০০ উইকেট আছে। এই তালিকার অপর দুজন শ্রীলঙ্কার সনাৎ জয়াসুরিয়া ও পাকিস্তানের শাহীদ আফ্রিদি। অবশ্য এ দুজনের চেয়ে অনেক কম ম্যাচে এই কীর্তি গড়েছেন সাকিব। আফ্রিদির লেগেছিল ৩৪১ ম্যাচ, জয়াসুরিয়ার ৩৯৭। আর সাকিব মাত্র ২২৮ ম্যাচেই ছুঁয়ে ফেললেন অসাধারণ এই মাইলফলক।

সাকিব ফিরলেও হৃদয় ছুটছিলেন দুরন্ত গতিতে। অভিষেকেই সেঞ্চুরির অনন্য অর্জন যখন তার পায়ে লুটাবে বলে মনে হচ্ছিল, তখনই বোল্ড! হিউমের খানিকটা ভেতরে ঢোকা বলে ছত্রখান হয় হৃদয়ের স্টাম্প। ৮৫ বলে আটটি চার আর দুটি ছয়ে দুর্দান্ত ৯২ রানের ইনিংস আসে তার ব্যাট থেকে।

সাকিবের পর হৃদয়ও নব্বইয়ে কাটা পড়লেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে একই ইনিংসে দুই ব্যাটসম্যানের নব্বইয়ের ঘরে আউট হয়ে যাওয়া ১১তম ঘটনা এটি।

তৌহিদ হৃদয় সেঞ্চুরি না পেলেও যা করেছেন, তা-ই বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অনন্য! বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডে সংস্করণে ১৪০তম ক্রিকেটার তিনি। আর অভিষেকেই ফিফটি করা বাংলাদেশের মাত্র তৃতীয় ক্রিকেটার তিনি। শুধুমাত্র পাঁচ নম্বর পজিশনের কথা যদি বিবেচনায় নেওয়া হয়, তবে এই পজিশনে অভিষেকে ফিফটি করা বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাটার হৃদয়।

অভিষেক ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পক্ষে এর আগে ফিফটি করেছিলেন নাসির হোসেন ও ফরহাদ রেজা। নাসির জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০১১ সালে করেন ৬৩ রান, ফরহাদ রেজা একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ২০০৬ সালে করেন ৫০ রান। এতো দিন নাসিরের ৬৩ রানই ছিল বাংলাদেশের হয়ে অভিষেকে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান। আজ তা পেরিয়ে গেছেন তৌহিদ হৃদয়।

সাকিবের বিদায়ে ক্রিজে আসা মুশফিকুর রহিম শুরু থেকেই তুলেন ঝড়। সাকিব যখন বিদায় নেন, দলীয় রান তখন ৩৭.২ ওভারে ২১৬। মঞ্চটা সাজানো। সেই মঞ্চে শুধু ভালো কিছুই আশা করা যায়।

মুশফিকুর রহিম এলেন এবং ঝড় তুললেন! সাজানো মঞ্চে চার-ছয়ের ফুলঝুরিতে উন্মাতাল করে তুললেন গ্যালারি। ২৬ বলে সমান তিনটি করে চার ও ছয়ে ১৬৯.২৩ স্ট্রাইক রেটে ৪৪ রান করে বিদায় নেন এই মিডল অর্ডার ব্যাটার।

ইয়াসির আলী চৌধুরী ও তাসকিন আহমেদ বিদায় নেন দ্রুত। বাংলাদেশ করে ৮ উইকেটে ৩৩৮ রান। ওয়ানডে ক্রিকেটে এটাই টাইগারদের সর্বোচ্চ দলীয় ইনিংস।

এর আগে ২০১৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৮ উইকেটে ৩৩৩ রানই ছিল সর্বোচ্চ। সে ম্যাচে অজিরা করেছিল ৩৮১ রান।

ম্যাচে আইরিশ পেসার হিউম ৬০ রানে নেন ৪ উইকেট।

পাহাড়সম লক্ষ্যের পানে ছুটতে গিয়ে আইরিশদের শুরুটা ভালোই হয়। স্টিফেন ডুহেনি আর পল স্টার্লিংয়ের ওপেনিং জুটি জমে ওঠে। ১১.১ ওভারে রান ওঠে ৬০। এরপরই সাকিবের ঘূর্ণিতে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন ডুহেনি (৩৮ বলে ৩৪)। স্কোরবোর্ডে আরও ১৬ রান যোগ করতে করতে আরও ৪ উইকেট হারায় আইরিশরা।

এরপর খানিকটা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন কার্টিস ক্যাম্পার ও  জর্জ ডকরেল। গড়েন ৩৩ রানের জুটি। সেই জুটি ভাঙেন সিলেটেরই ছেলে নাসুম।

পরের ওভারে এসে জোড়া আঘাত হানেন নাসুম। ফিরিয়ে দেন গ্যারেথ ডিলানি ও অ্যান্ডি ম্যাকব্রাইনকে। ২৬ ওভারে ১১৮ রানে ৮ উইকেট নেই আইরিশদের!

এরপর শুধু ম্যাচ শেষ হওয়ার অপেক্ষা। ৩০.৫ ওভারে ১৫৫ রানে গুটিয়ে যায় সফরকারীরা।

বাংলাদেশ জয় পায় রেকর্ডগড়া ১৮৩ রানের বড় ব্যবধানে।

দুর্দান্ত বোলিংয়ে ইবাদত তুলে নেন ৪ উইকেট। নাসুম ৩টি, তাসিকন ২টি, সাকিব ১টি উইকেট নেন।

ঝলমলে অভিষেক ব্যাটিংয়ে ম্যাচসেরা হন তৌহিদ হৃদয়।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে