বাজারে গোয়েন্দা নামিয়েও লাগাম টেনে ধরা যায়নি ব্রয়লার মুরগি সিন্ডিকেটের। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তৎপরতায় ব্রয়লার মুরগির কেজি ৩০০ টাকা থেকে ২০০ টাকায় নেমে এলেও ফের অস্থির হতে শুরু করেছে দাম। গতকাল প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২২০ টাকার নিচে বিক্রি হয়নি রাজধানীর কোনো বাজারে।
মুরগির দামের অস্থিরতার পেছনে কারা রয়েছে, তা উঠে এসেছে বাজার তদারকির দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে। এসব প্রতিবেদন ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা হয়েছে। এই গোপন প্রতিবেদনে ব্রয়লার মুরগি ও মুরগির খাবার (ফিড) উৎপাদনকারী চারটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে। প্রতিদিন বাজারে গড়ে ২ হাজার টন মুরগি সরবরাহ করে থাকে এসব বড় কোম্পানিগুলো।
এরই মধ্যে ওই চার প্রতিষ্ঠানকে ডেকে ভোক্তা অধিদপ্তর সতর্ক করলেও ফের তারা কলকাঠি নাড়তে শুরু করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে সিন্ডিকেট করে অবৈধ উপায়ে ক্রেতাদের জিম্মি করে বাজার থেকে পোল্ট্রি খাতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করা হচ্ছে। ভোক্তা অধিদপ্তরের তলবের পর তারা হাজির হয়েও সিন্ডিকেটবাজির কথা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
একাধিক গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাজী ফার্মস লিমিটেড, আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড, সিপি বাংলাদেশ ও প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড, ৭১ ফিড, নারিশ পোল্ট্রি ফিড অ্যান্ড হ্যাচারি, নাহারসহ ১২টি বৃহৎ কোম্পানি গোটা ব্রয়লার মুরগি ও এ মুরগির খাবারের (পোল্ট্রি ফিড) বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা তালিকাভুক্তির নামে ছোট ছোট পাইকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জোট বেঁধে মুরগির বাজার অস্থিতিশীল করছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আনারও সুপারিশ করা হয় ওইসব গোপন প্রতিবেদনে।
বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, গেল বছরের আগস্ট মাস থেকে মুরগির বাজারে বিশৃঙ্খলা চলছে। সে সময় প্রতি কেজি ব্রয়লারের দাম ২০০ টাকা ছাড়ায়। এরপর তা দফায় দফায় বেড়ে চলতি মাসে ২৫০ টাকা ছাড়িয়ে ২৮০-৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। অথচ সরকারি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে তথ্য উঠে এসেছে, ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৩৫ থেকে ১৬০ টাকা পর্যন্ত। এ মুরগি বাজারে ২০০ টাকার বেশি বিক্রি হওয়া অযৌক্তিক। অর্থাৎ প্রতি কেজি মুরগি ভোক্তাকে অন্তত ৫০-১০০ টাকা বেশি দামে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছিল। এই অতিরিক্ত টাকার পুরোটাই চলে যায় কারসাজিকারীদের পকেটে।
এদিকে প্রান্তিক খামারিরা বলছেন, করপোরেট কোম্পানিগুলো তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ খামারিদের জন্য মুরগির বাচ্চার দর সব সময়ের জন্য ৩৫ টাকা এবং ফিডের বস্তা ২৬০০ টাকা নির্ধারণ করে রেখেছে। আর যেসব প্রান্তিক খামারিরা তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়নি, তাদের একেকটি বাচ্চা কিনতে হয় ৮০-৮৫ টাকায়। এক বস্তা ফিড কিনতে হয় ৩৭৪০ টাকায়। এতে চড়া মূল্য দিয়ে বাচ্চা ও ফিড কিনে মুরগি উৎপাদন করতে গিয়ে লোকসানে পড়ছেন প্রান্তিক খামারিরা। আবার প্রান্তিক খামারিদের মুরগি বাজারে আসা শুরু করলে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কম দামে মুরগি বিক্রি করে। এতে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ে বাজার থেকে ছিটকে পড়ছে খামারিরা।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের পরিসংখ্যান বলছে, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে এক লাখ প্রান্তিক খামারি তাদের পোল্ট্রি খামার বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। মাত্র ৬০ হাজার প্রান্তিক খামারি এখনও লড়াই করে যাচ্ছেন এই করপোরেটদের মারপ্যাঁচের মধ্যেই। তবে টিকতে না পেরে এই ৬০ হাজার খামারির মধ্যে ১২ হাজার ইতোমধ্যেই করপোরেট কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছে।
প্রান্তিক খামারিরা জানান, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ক্ষেত্রে প্রান্তিক খামারিদের সঙ্গে স্ট্যাম্পে চুক্তি করা হয়। এ ছাড়া খামারির দুটি ব্ল্যাংক চেক, জমির দলিলের ফটোকপিও নিয়ে নেওয়া হয়। লোকসান হলে খামারি টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে ২০ হাজার টাকা পাওনার বিপরীতে ২০ লাখ টাকার মামলা করে করপোরেটগুলো। শুধু তাই নয়, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে প্রতিকেজি মুরগিতে খামারিকে লাভ দেওয়া হয় ১০ থেকে ১২ টাকা। কিন্তু এর মধ্যে ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ খরচ এবং শ্রমের দাম খামারিকেই বহন করতে হয়। লোকসানের ভয়ে অনেক প্রান্তিক খামারি বাধ্য হয়েই এই চুক্তিতে যাচ্ছেন।
সংগঠনটির দাবি, দেশে প্রতিদিন মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হয় ২০ লাখ। এসব বাচ্চা কোম্পানিগুলো উৎপাদন করে। একেকটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে খরচ হয় ২৮ থেকে ৩০ টাকা, যা চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ছিল ১০ থেকে ১৫ টাকা। অথচ প্রতিটি বাচ্চা এখন ৬২ থেকে ৬৮ টাকায় দেওয়ার কথা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। ফলে প্রতি বাচ্চায় ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করছে করপোরেট কোম্পানিগুলো।
অন্যদিকে ভোক্তা অধিদপ্তরের সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকে গত ২৩ মার্চ পোল্ট্রি খাতের বড় চার প্রতিষ্ঠান- কাজী ফার্মস লিমিটেড, আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড, সিপি বাংলাদেশ ও প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড খামার থেকে ১৯০-১৯৫ টাকায় পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে মুরগি বিক্রি করার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে রহস্যজনকভাবে পরদিন তারা ১৬০ টাকায় মুরগি বিক্রি করে ছোট খামারিদের কারসাজির প্যাঁচে ফেলে দেয়। যা বাজার তদারকি করতে গিয়ে ধরে ফেলে ভোক্তা অধিদপ্তর। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রয়লার মুরগির কেজিতে ৭০ থেকে ৮০ টাকা দাম কমে। তবে গতকাল থেকে ফের বাড়তে শুরু করেছে দাম। এ বিষয়ে ঢাকাটাইমসকে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশগুলো মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়। আমাদের দিক থেকে পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অযৌক্তিক দামে মুরগি বিক্রি হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ডাকাও হয়।’ এছাড়া মুরগির বাজারের সিন্ডিকেট খুঁজতে গোয়েন্দা নামানোর কথাও জানান ভোক্তার ডিজি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারওয়ান বাজারের একজন পাইকারি মুরগি ব্যবসায়ী বলেন, পাইকাররা দাম বাড়াতে বা কমাতে পারে না। এখনো রসিদ ছাড়াই মুরগি কেনা-বেচা হয়। রসিদ থাকলেও দাম থাকে না। মোবাইল ফোনের এসএমএসের মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সে মোতাবেকই মুরগি কেনাবেচা হয়। এসব অনিয়মের মাধ্যমেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে অসাধু চক্র।
এ প্রসঙ্গে পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার ঢাকা টাইমসকে বলেন, হাতেগোনা কয়েকটি বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান গোটা পোলট্রি খাতকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা যখন ইচ্ছা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে, আবার রাতারাতি কমিয়ে দিচ্ছে। এতে তাদের কোনো লোকসান হচ্ছে না। কিন্তু ছোট খামারিরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। তিনি পোলট্রি বোর্ড গঠনের দাবি জানান।
অন্যদিকে বারবার বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে অল্প সময়ে বিপুল অর্থ লুটে নিচ্ছে সিন্ডিকেট চক্র। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, চলমান বাজার অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে গত ৫২ দিনে মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট চক্র। এর আগেও গত বছর আগস্টে ১৫ দিনে ডিম ও মুরগির বাজার থেকে ৫১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
সংগঠনটি বলছে, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে প্রতিদিন বাজারে ২ হাজার টন মুরগি আসে। সেই হিসাবে দিনে তাদের অতিরিক্ত মুনাফা হয় ১২ কোটি টাকা। এভাবে গত ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত ৫২ দিনে ৬২৪ কোটি টাকা মুরগি বিক্রির মাধ্যমে অতিরিক্ত লাভ করেছে কোম্পানিগুলো। আর এক দিনের মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে তাদের মুনাফা ৩১২ কোটি টাকা।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘আড়াল থেকে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এর আগে কয়েক দফা তাদের সঙ্গে বৈঠক হলেও কোনো সুফল মেলেনি। প্রতিযোগিতা কমিশনের মাধ্যমে মামলা হলেও তারা নানা অজুহাত দিয়ে দাম আরও বাড়িয়েছে। কিন্তু এ দফায় ভোক্তা অধিদপ্তরের কড়া হুঁশিয়ারিতে তারা সরবরাহ বাড়িয়েছে, দামও কমিয়েছে। এ থেকেই স্পষ্ট, বাজারে বড়দের আধিপত্য নিরঙ্কুশ। সরকারকে এটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
সিলেটভিউ২৪ডটকম/ডেস্ক/ইআ-০৭