বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের এই দিনে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলো স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊর্ধ্বতন ২৭ সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে এ বৈঠকেই দেশকে স্বাধীন করার শপথ এবং যুদ্ধের রণকৌশল গ্রহণ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনকে ১১ ভাগ করা হয়। অস্ত্রের যোগান, আন্তর্জাতিক সমর্থনসহ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এই সভায়। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ওই বৈঠকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী (এম এ জি ওসমানী)। তিনি ভারতের আগরতলা থেকে এসে ওই বৈঠকে যোগ দেন।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন তৎকালীণ কর্নেল এম এ রব, মেজর সি আর দত্ত, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, লে. কর্নেল সালাউদ্দীন মোহাম্মদ রেজা, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন নাসিম, লে. সৈয়দ ইব্রাহীম, এম,পি মাওলানা আসাদ আলী প্রমুখ। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বৈঠকে অংশ নেন ব্রিগেডিয়ার শুভ্রমানিয়ম, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে এবং আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল।
ওই বৈঠক থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে পুরো দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। বৈঠক থেকে এস কে ফোর্স ও জেড ফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত আসে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বড় ভূমিকা রেখেছিল এই দুটি বাহিনী। তা ছাড়া অংশগ্রহণকারীরা একটি রাজনৈতিক সরকার গঠনের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আরও কিছু অতিগুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এসেছিল এই বৈঠক থেকেই। বৈঠক শেষে এম এ জি ওসমানী নিজের পিস্তলের ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার শপথ করানো হয়। শপথ বাক্য পাঠ করানোর পর GgGwR Imgvbx নিজের পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন| এ সভা থেকেই ১০ এপ্রিল দ্বিতীয় বৈঠক ও সরকার গঠনের প্রস্তাবও করা হয়েছিল। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে সেক্টর বিভক্ত নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও এই মিটিং ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম মিটিং এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই কারো।৩নং সেক্টর কমান্ডার মেজর কে.এম শফিউল্লাহ্ তাঁর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করেন তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। সড়ক ও রেলপথে বৃহত্তর সিলেটে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়ার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
এখান থেকে মুক্তি বাহিনী বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করা ছাড়াও তেলিয়াপাড়া চা বাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীসহ কয়েকটি সেক্টরের কমান্ডারগণ বিভিন্ন সময়ে তেলিয়াপাড়া সফর করেন। ম্যানেজার বাংলোসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সেনানায়কদের পদচারণায় মুখরিত। ১৯৭১ সালের ২১ জুনের পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের কারণে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থাপিত সেক্টর হেড কোয়ার্টার তুলে নেয়া হয়।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২, ৩ ও ৪নং সেক্টরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে তেলিয়াপাড়া চা বাগান ম্যানেজার বাংলোর পাশে নির্মিত হয় বুলেট আকৃতির মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিসৌধ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে এ স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন সেনাপ্রধান (অব:) মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ বীর উত্তম পিএসসি।
২০১১ সালের ৭ মে মুক্তিযোদ্ধাদের এক সমাবেশে সেখানে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স করার কথা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এখনও সে প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি।মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, তেলিয়াপড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান স্মৃতিবিজড়িত স্থান। অবশ্যই এটিকে সংরক্ষণ করতে হবে। অবিলম্বে সেখানে রেস্ট হাউজ, টয়লেট নির্মাণসহ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণের দাবি জানান তারা। পাশাপাশি ঐতিহাসিক বাংলোটিকে জাদুঘর করার দাবিও দীর্ঘদিনের।
সিলেটভিউ২৪ডটকম/সানাউল/ইআ-১৭