প্রকাশিত: ০৩ মে, ২০২৩ ১৯:১৯ (বৃহস্পতিবার)
ভারতে নতুন বিতর্ক ‘দ্য কেরালা স্টোরি’

‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এর পর ভারতের রাজনীতিতে এবার ঝড় তুলেছে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’। দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী সমর্থকেরা যেমন নতুন এই সিনেমা দেখতে মুখিয়ে আছে; তেমনি খড়্গহস্ত বাম ও মধ্যপন্থী জনতা, যাঁরা মনে করছেন সমাজকে বিভাজিত করার চেষ্টায় হিন্দুত্ববাদীদের এ এক নতুন চাল। আগামী শুক্রবার সারা দেশে সিনেমাটি মুক্তি পেতে চলেছে।


ইতিমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তুলেছে ছবিটির ট্রেলার। ইউটিউবে এত দিন ধরে যে ট্রেলার দেখা যাচ্ছিল, আচমকাই তা বদলে দেওয়া হয়েছে। প্রথম ট্রেলারে বলা হয়েছিল, কেরালা থেকে ৩২ হাজার নারী সন্ত্রাসবাদী ‘ইসলামিক স্টেটে’ (আইএস) যোগ দিয়েছেন। এটা তাঁদের কাহিনি। বিতর্ক তীব্রতর হওয়ায় গত মঙ্গলবার ছাড়া হয় নতুন ট্রেলার। যাতে দাবি করা হয়েছে, এই সিনেমা রাজ্যের তিন নারীর সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি। দাবি করা হয়েছে, হাজার হাজার নিরপরাধ নারীকে ধর্মান্তর করিয়ে সন্ত্রাসী তৈরি করা হচ্ছে। জীবন ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
 

মুসলমানদের বৃহত্তম সামাজিক সংগঠন জামায়াতে উলেমায়ে হিন্দ সিনেমাটি মুক্তি বন্ধের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আরজি জানিয়েছে। কারণ, এই সিনেমা অসত্য তথ্যের আধারে তৈরি। মুক্তি পেলে দেশে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ আরও বেড়ে যাবে। তারা বলে, এমনিতেই নানা কারণে দেশের ধর্মীয় পরিবেশ অনুকূল নয়। প্রচারধর্মী এই সিনেমা সেই পরিবেশ আরও বিষিয়ে তুলবে।


এই একই আরজি উঠেছিল গতকাল মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে ঘৃণা ভাষণসংক্রান্ত এক মামলা চলাকালে। আবেদনকারীরা এই সিনেমার মুক্তি বন্ধের দাবি জানিয়ে বলেন, এটা এক নিকৃষ্টমানের ঘৃণা ভাষণ ও সেই বিষয়ে অডিও ভিজ্যুয়াল প্রচার। বিচারপতি কে এম যোসেফ ও বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন আবেদন শুনতে রাজি হননি। তাঁরা বলেন, এভাবে কিছু করা যায় না। সিনেমার মুক্তি বন্ধের আবেদন জানাতে গেলে তা প্রথামাফিক করতে হয়। তা ছাড়া এই সিনেমা সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেয়েছে। কেরালা হাইকোর্টেও এই সিনেমা বন্ধের দাবিতে জনস্বার্থ মামলা হয়েছে। ৫ মে তার শুনানি। ওই দিনই ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ মুক্তি পাওয়ার কথা।
 

‘দ্য কেরালা স্টোরি’র পরিচালক বঙ্গসন্তান সুদীপ্ত সেন। শাসকগোষ্ঠীর কাছের বলে তাঁর পরিচিতি আছে। সে জন্য গোয়ায় ৫৩তম আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তিনি জুরি হয়েছিলেন। জুরিবোর্ডের চেয়ারম্যান ইসরায়েলি পরিচালক নাদাভ লাপিড ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’কে ‘জঘন্যতম প্রচারধর্মী সিনেমা’ বলার পর সুদীপ্তর কণ্ঠে ভিন্ন সুর শোনা গিয়েছিল। ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র প্রযোজক গুজরাটি ব্যবসায়ী বিপুল অমৃতলাল শাহ।
 

সিনেমার ট্রেলার ও দাবি বদলানোর মধ্য দিয়ে এটুকু অন্তত বোঝা যায়, ছবির নির্মাতাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অন্য রকম। গতকাল দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণপন্থী ছাত্রসংগঠনের উদ্যোগে সিনেমাটি প্রদর্শনের পর সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে পরিচালক সুদীপ্ত সেন বলেন, ‘সংখ্যা বড় কথা নয়। ৩২ হাজার সংখ্যাটি মনগড়া হতে পারে। কিন্তু সিনেমাটি সত্য ঘটনা নিয়েই তৈরি।’


সিনেমার ঘটনা ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু কেরালা বলে দক্ষিণের এই বামশাসিত রাজ্যে জোট বেঁধেছে বিজেপিবিরোধী সব শক্তি। সিপিএম নেতৃত্বাধীন এলডিএফ এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ একযোগে সিনেমাটি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে।
 

ইন্ডিয়ান মুসলিম লিগের যুব শাখা মুসলিম ইয়ুথ লিগ চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছে, আইএসে যোগ দেওয়া কেরালার ৩২ হাজার নারীর প্রমাণ যিনি দিতে পারবেন, তাঁকে এক কোটি রুপি পুরস্কার দেওয়া হবে। রাজ্যের বিশিষ্ট অভিনেতা ও আইনজীবী সি শুক্কুর বলেছেন, রাজ্য থেকে আইএসে যোগ দিয়েছেন, এমন ৩২ নারীর নামধাম কেউ দাখিল করতে পারলে তিনি ১১ লাখ টাকা দেবেন। রাজ্যের বিশিষ্ট ব্লগার নাজির হুসেন আবারও বলেছেন, জবরদস্তি ধর্মান্তর করিয়ে কাউকে আইএসে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছে, কেউ প্রমাণ দিতে পারলে তাকে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার দেবেন।
 

অবশ্য সবচেয়ে বেশি পুরস্কার দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন ‘হিন্দু সেবা কেন্দ্রের’ প্রতিষ্ঠাতা প্রতীশ বিশ্বনাথ। তিনি বলেছেন, রাজ্য থেকে কেউ সিরিয়ায় আইএসে যোগ দেননি, এর প্রমাণ যিনি দেবেন তাঁকে ১০ কোটি টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। ঘটনা হলো, রাজ্যের এক নারী সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছিলেন। এটা সরকার স্বীকৃত তথ্য।
 

রাজ্যের দুই যুযুধান শিবির বাম ও কংগ্রেস জোট এ বিষয়ে একমত, বিজেপি-আরএসএস কেরালার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বিগড়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেছেন, কেরালার ভাবমূর্তিকে খাটো করতে এটা বিজেপি ও সংঘের চক্রান্ত। কংগ্রেস নেতা ভি সাথীশন বলেন, রাজ্য পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই, যাতে প্রমাণিত হয়, হাজার হাজার হিন্দু ও খ্রিষ্টান নারীকে জবরদস্তি ধর্মান্তর করা হয়েছে। পুরো কাহিনিই কাল্পনিক।
 

হিন্দু-মুসলমান ছাড়াও এই রাজ্যে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীর সংখ্যা অনেক। দুই শিবিরই মনে করছে, বিজেপি একদিকে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছে, অন্যদিকে চেষ্টা করছে খ্রিষ্টানদের মন জিততে। সে লক্ষ্যে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজ্য সফরে গিয়ে খ্রিষ্টান ধর্মযাজক ও চার্চের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বলেছেন, উত্তর ভারতের খ্রিষ্টানরা যেমন বিজেপিকে কাছে টেনেছে, কেরালার খ্রিষ্টানরাও তেমনই করবে।
 

প্রথম বিতর্ক ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ নিয়ে। সিনেমাটির প্রদর্শন বন্ধ হয়নি। তারপর বিতর্ক দেখা দেয় ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে বিবিসির তৈরি তথ্যচিত্র ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন’ নিয়ে। ভারত সরকার দেশে তথ্যচিত্রটির প্রদর্শন বন্ধ করতে সামাজিক মাধ্যমকে নির্দেশ দেয়। সরকারের ‘অঘোষিত’ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যাঁরা তথ্যচিত্রটি দেখেছেন, এমন অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এবার বিতর্ক ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নিয়ে। সরকার যদিও নির্বিকার।

 

সিলেটভিউ২৪ডটকম/ডেস্ক/এনটি