দেশের উত্তরপূর্বের সীমান্ত উপজেলা সিলেটের জকিগঞ্জ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সীমান্তঘেঁষা এ উপজেলাকে পাক হানাদার মুক্ত করা হয় ২১ নভেম্বর। ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহযোগীতায় মুক্তিযোদ্ধারা সারাদেশের আগে জকিগঞ্জকে শত্রু মুক্ত করে লাল সবুজের পতাকা ওড়িয়ে বিজয় উৎসব উদযাপন করেন।
এ উপজেলাকে শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধে এসে বর্বর পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন ভারতীয় মিত্র বাহিনীর মেজর চমন লালসহ তাঁর অপর আরও দুই সহযোগী। মহান মুক্তিযুদ্ধে জকিগঞ্জ ছিল ৪ নং সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত। অধিনায়ক ছিলেন মেজর চিত্ত রঞ্জন দত্ত। প্রয়াত সাবেক মন্ত্রী এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী ছিলেন এই সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা। ৬টি সাব সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মাহবুব রব সাদী, লে. জহির উদ্দিন ও ক্যাপ্টেন এম.এ.রব। ২১ নভেম্বর পাক হানাদার মুক্ত হবার পর ২৮ নভেম্বর জকিগঞ্জে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়।
দেশের প্রথম মুক্তাঞ্চল দিবস জকিগঞ্জে নানা আনুষ্ঠানিকতায় উদযাপন করা হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে আজও স্বীকৃতি মেলেনি। বিজয়ের প্রভাতে স্বাধীনতার নিঃশ্বাস নেয়া এই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষসহ মুক্তিযোদ্ধাগণ দেশের প্রথম মুক্তাঞ্চল জকিগঞ্জকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা দিতে দাবী জানিয়ে আসছেন দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে। এ নিয়ে দেশ বিদেশেও নানা কর্মসূচি পালন অব্যাহত রয়েছে। তবুও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না পাওয়ায় চরম হতাশা প্রকাশ করছেন মুক্তিযোদ্ধাগণসহ সাধারণ মানুষ।
প্রতিবারের মতো দেশের প্রথম মুক্তাঞ্চল দিবস উদযাপন ও দাবী আদায়ে এবারও মুক্তিযোদ্ধাগণ নানা কর্মসূচি পালনের ডাক দিয়েছেন। জকিগঞ্জ মুক্তাঞ্চল বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আকরাম আলী ও সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিল উদ্দিন স্বাক্ষরিত একপত্রে এ কর্মসূচির ডাক দেন।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯ টায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনে সকল মুক্তিযোদ্ধা ও সূধীবৃন্দের উপস্থিতি। সকাল ১০ টায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ। সকাল ১০ টা ১৫ মিনিটে মুক্তিযোদ্ধা চত্ত¡রে চত্তরে জাতীয় পতাকা ও মুক্তিযোদ্ধা পতাকা উত্তোলন। সকাল সাড়ে ১০ টায় মুক্তিযোদ্ধা চত্ত¡র থেকে আনন্দ র্যালি ও পথ সভা অনুষ্ঠিত হবে।
কর্মসূচিতে নিজস্ব ব্যানারে যেকোন সংগঠন অংশ নিতে পারবে এবং দিনটি উপলক্ষে উপজেলার সকল কলেজ, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও প্রাথমিক বিদ্যাললে জাতীয় পাতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংঙ্গীত পরিবেশন এবং ২১ নভেম্বরের তাৎপর্য আলোচনা করার জন্য তাঁরা আহবান জানিয়েছেন।
একাত্তরের প্রথম মুক্তাঞ্চলের স্মৃতিচারণ করে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ও সাবেক পৌর মেয়র মুক্তিযোদ্ধা খলিল উদ্দিন বলেন, দেশব্যাপী যুদ্ধ শুরুর আগে সিলেটের সীমান্ত উপজেলা জকিগঞ্জকে শত্রু মুক্ত করার শপথ নেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। ২৭ মার্চ জকিগঞ্জ ডাক বাংলোয় এক গোপন বৈঠকে থানার সকল ইপিআর ক্যাম্পের পাক সেনাদের খতমের সিদ্ধান্ত হয়। ২৮ মার্চ বীর মুক্তিযোদ্ধা মেকাই মিয়া, চুনু মিয়া, আসাইদ আলী, ওয়াতির মিয়া, তজমিল আলী, মশুর আলী, হাবিলদার খুরশিদ, করনিক আবদুল ওয়াহাব, সিগনালম্যান আবদুল মোতালেব প্রমুখ প্রথমে জকিগঞ্জ ও মানিকপুর ইপিআর ক্যাম্পে অপারেশন চালিয়ে পাক সেনাদের খতম করে জকিগঞ্জে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন। প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী, এমএলএ মরহুম আবদুল লতিফ, এমএলএ আব্দুর রহিম, সেক্টর কমান্ডার চিত্ত রঞ্জন দত্ত, মিত্র বাহিনীর দায়িত্ব প্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকে, কর্নেল বাগচিসহ মাছিমপুর ক্যান্টলম্যান্টে জকিগঞ্জকে স্বাধীন করার এক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ঐ পরিকল্পনা ছিল কীভাবে কুশিয়ারা নদীর ওপারে ভারতের করিমগঞ্জের মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে জকিগঞ্জ দখল করা যায়। পরিকল্পনা মতোই ২০ নভেম্বর রাতে যৌথ বাহিনীর এক সাঁড়াশি অভিযানে ২১ নভেম্বর ভোরে জকিগঞ্জ মুক্ত হয়।
জকিগঞ্জ প্রথম মুক্তাঞ্চল দিবস নিয়ে কথা হয় সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি মহান মুক্তিযোদ্ধে ভারতের বিহার প্রদেশের চাকুলিয়ায় বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও শত্রু মুক্ত এলাকা জকিগঞ্জের প্রথম আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে জকিগঞ্জকে সারাদেশের আগে পাক বাহিনী মুক্ত করার নানা স্মৃতিচারণ করে মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ বলেন, ভারতের সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জকে পাক হানাদার মুক্ত করার পরিকল্পনা অনুসারে ২০ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রথম দল লোহারমহলের দিকে ও দ্বিতীয় দল আমলশীদের দিকে অগ্রসর হয়। মূল দল জকিগঞ্জ কাস্টমঘাট বরাবর করিমগঞ্জ কাস্টমঘাটে অবস্থান নেয়। প্রথম ও দ্বিতীয় দল নিজ নিজ অবস্থান থেকে কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে জকিগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। পাক বাহিনী খবর পেয়ে দিকবিদিক ছুটোছুটি শুরু করে। মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে ভেবে তারা আটগ্রাম-জকিগঞ্জ সড়ক দিয়ে পালাতে থাকে। এরমধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় দল জকিগঞ্জ পৌঁছে যায়। মূল দল কুশিয়ারা নদীতে রাবারের বালিশ দিয়ে সেতু তৈরি করে জকিগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। তখন পাক সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ হয় এবং পাক বাহিনীর ছুড়া বুলেটে ভারতীয় বাহিনীর মেজর চমন লাল ও তার দুই সহযোগী শহীদ হন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাগণের সাহসিকতায় বর্বর বাহিনী পালাতে থাকে। তখন কয়েকজন পাক সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটক হয়। এভাবেই মুক্ত হয় জকিগঞ্জ। একুশে নভেম্বর জকিগঞ্জের মাটিতেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়িয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। উদযাপন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় উৎসব। এ সময় পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক আটকৃত বন্দীদের জকিগঞ্জ থানা থেকে মুক্ত করা হয়। ২৮ নভেম্বর জকিগঞ্জে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়।
সিলেটভিউ২৪ডটকম/হাছিব/এসডি-৪৪৪